কী আছে সেরালির মনে
সেরালির বোঝার বাকি নেই যে, তার ঘরে কতগুলো ‘ভূতের ছাও’ জন্ম নিয়েছে। লোভী ও হাঁড়কিপটে সেরালি চট করে দারুন একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে সে অনেক অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারবে।
সেরালি মনে মনে বলে, ‘এই দুনিয়ায় আমি বড়ো ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু টাকা হলে টেনে-টুনে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া যায়। টাকার উপরে আর কিছু নেই, দেখি কী আছে কপালে!’
সেরালি বাজার থেকে অনেক টাকা খরচ করে মজাদার খাবার এনে সন্তানদের খেতে দিল। ওরা মহানন্দে গপাগপ করে খাবার খেয়ে পিতার খুব ভক্ত হয়ে গেল। সেরালি যখনই ঘরে ঢুকে তখনই ছেলে-মেয়েরা ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরে। পিতার সাথে সন্তানদের গভীর সম্পর্ক হয়ে গেল। ওরা বাবা বলতে পাগল।
সেরালি একদিন সন্তানদের ডেকে নিয়ে খোসগল্প করতে বসল। সে কিছুক্ষণ গল্প করে বলল, আচ্ছা, বাবা-সোনারা, তোমরা কে কত রকমের বাঁদরামি করতে পারো আমাকে একটু করে দেখাও তো দেখি!
হায়! হায়! বলার সাথে সাথে মুহূর্তের মধ্যে ঘরে তেলেছমাতি কান্ড শুরু হয়ে গেল! ওরা চোখের পলকে রূপ পরিবর্তন করে রাজ্যের দুষ্টুমি শুরু করে দিল। কেউ সাপ, কেউ ব্যঙ, কেউ গরু, কেউ বানর, কেউ বা ভয়ঙ্কর মানুষের রূপ ধরে অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল। সেরালি এসব দেখে ভয়ে পেয়ে গেল। সে দু'চোখ বন্ধ করে বসে রইল।
এক ছেলে সেরালিকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে হাত টেনে নিয়ে বলল, বাবা, তুমি ঘুমাও নাকি। চোখ খোলো। আমাদের শয়তানি দেখবা না? সেরালি চোখ মেলে দেখে তার সামনে বিশাল হা করে আছে এক আজব প্রাণীÑযার মুখ মাটি থেকে ঘরের চাল পর্যন্ত লম্বা। চিকনালি এই হা দেখে ভিরমি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েরা তাকে টেনে-টুনে তুলে কী করল সে কিছুই টের পায়নি। সেরালির জ্ঞান ফেরার পর দেখে, রাজার পোশাক পরে হাতির ওপর বসে আছে। তার সামনে অসংখ্য শিশু আর হিংস্র পশু-পাখি আনন্দে হই-হুল্লোড় করছে। ওরা পরম শ্রদ্ধার সাথে বলছে, আমরা আমাদের পিতাকে রাজা বানিয়ে হাতির ওপর সিংহাসনে বসিয়েছি। আমরা বাবাকে ঠিক রাজার মতই দেখতে চাই আর রাজার মত করে রাখতে চাই।
আনন্দে ও গর্বে সেরালির বুকটা ফুলে উঠল। সে হাঃ হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ হিঃ করে হাসতে লাগল। সে একলাফে হাতির পিঠ থেকে নেমে রাজার ভঙ্গিতে বলল, হে বিচিত্র বৎস আমার, তোমাদের শক্তি-সামর্থ আর নৈপুণ্য দেখে আমি অভিভুত। তোমাদের মত সন্তানের পিতা হতে পেরে আমি গর্ববোধ করছি। আমার বিশ্বাস, তোমাদের নিয়ে আমি যে পরিকল্পনা করেছি, তা বাস্তবে রূপায়িত করতে তোমরা সক্ষম হবে। তোমাদের কর্মকুশলতা ও দক্ষতা আমাদের জীবনমান পাল্টে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। হে আমার প্রাণপ্রিয় বৎসসকল, তোমরা কি আমার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে পারবে?
তার সন্তানেরা সমস্বরে বলল, হে আমাদের প্রাণপ্রিয় পিতা! আপনার ঘরে আমরা জন্ম নিয়েছি। আপনার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য আমাদের নেই। আমরা অনেক অসাধ্যকে সাধন করতে পারি। এখন আপনি যা আদেশ করবেন আমরা তা-ই পালন করব। আমাদের ওপর আপনি ষোলোআনা ভরসা রাখতে পারেন। এখন আমাদের আদেশ করুন বাবা, আমরা আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ধন্য হতে চাই!’
সেরালি গুণধর সন্তানদের কথায় যারপরনাই খুশি হলো এবং তাদের সাথে দীর্ঘ সময় শলা-পরামর্শ করে খুশিমনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
‘আঁটকুড়ার ঘরে সন্তান হয়েছে-মৃত গাছে শাখা গজিয়েছে।’ এ রকম কথা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।
ঘটনার হাত পা গজাতে শুরু করল। তারপর নানা রটনা। লোক থেকে লোকে, গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে গেল আঁটকুড়ে সেরালির বাবা হওয়ার অদ্ভুত ঘটনা। কৌতুহলী নারী পুরুষের লাইন পড়ে গেল সেরালির বাড়িতে।
‘এ খোদার সৃষ্টিরহস্য ছাড়া আর কী হতে পারে! এ এক আজব রহস্য। এ রহস্য ভেদ করার শক্তি কার আছে! খোদার লীলাখেলার শেষ নেই!’ এমন কথা সবার মুখে মুখে ফিরছে এখন।
ভূতের ফুঁয়ে বালাই নাশ
দিনে দিনে সেরালির বাড়িতে দূর-দূরান্ত হতে লোকজনের আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেল। কেউ খালি হাতে আসে না। সবাই শিশি, বোতল, লোটা-বদনা-গ্লাস নিয়ে এসেছে-সেরালি রহস্যময় সন্তানদের ‘ফু’ নেওয়ার জন্য। তাদের ধারনা ভূতের ফুঁয়ে বালাই নাশ হবে। বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা জনে মান্নত করতে আসে। সেরালির যে ছেলে ঘরের দরজায় বসে মানুষের পানিপাত্রে ফুঁ দিয়ে দেয়-তার আকার-প্রকৃতি বড়ো রহস্যময়। দেহের চেয়ে মাথা ও মাথার চুল বড়, শিঁকড়ের মত হাত-পা ও পায়ের নখ, মুখটা প্রায় মানুষাকৃতির, লম্বা মোটে দেড় ফুটের মত। সেরালির অন্য ছেলেরা থাকে অদৃশ্য হয়ে। বাড়িতে সবসময় একটা গুনগুন শব্দ বাতাস ভারী করে ঘোরাফেরা করে।
জনতার ঢল দেখে কিপটে ও লোভী সেরালি টাকা উপার্জনের একটা দারুন মওকা পেয়ে গেল। সে গভীরভাবে ভাবতে লাগল লোকজনের সীমাহীন বিশ্বাস আর কৌতূহলকে কীভাবে নিজের আয়-উপার্জনের কাজে লাগানো যেতে পারে।
সেরালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবার সামনে সাফ সাফ বলে দিল, দেবতা আমাকে যে সন্তান দিয়েছেন তাতে আমি খুশি। আমার জীবনের আশা পূরণ হয়েছে। আমার সন্তানের মাঝে মহান দেবতা কী রূপ ও রহস্য দিয়ে রেখেছেন, এর মাহাতœ্যই বা কি, এর মাঝে সৃষ্টি ও স্রষ্টার কী লীলাখেলা রয়েছে তা শুধু তিনিই জানেন।
এখন থেকে আমার সন্তানদের আর এভাবে মাগনা দেখাও যাবে না আর মাগনা ফু-ও নেওয়া যাবে না। যার বিশ্বাস হবে সে উপহার-উপঢৌকন আর হাদিয়া নিয়ে এসে আমার রহস্যছেলের ফুঁ নিতে হবে। তাকে দেখতে হলে পাকপবিত্র হয়ে আদব-লেহাজের সাথে এখানে আসতে হবে। আমার ছেলের দাম আছে।
সেরালির এ কথায় মানুষের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল এবং তা লোকমুখে দূরের এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
পরের দিন সেরালির আনন্দের আর সীমা নেই। কেউ খালি হাতে আসে না। সেরালি দু’হাতে লোকজনের কাছ থেকে পুঁটলি, টাকা-পয়সা, সোনাদানা ও হাদিয়া গ্রহণ করতে লাগল। তার প্রশান্ত চোখে-মুখে আনন্দ-হাসির রেখা ফুটে উঠল।
বিভিন্ন এলাকার লোকজন লাইন ধরে সেরালির অদ্ভুত সন্তানকে দেখছে। কে একজন আবেগে আপ্লুত হয়ে দূরে থেকে একটা চুম্বন ছুড়ে দিল সেরালির ছেলের দিকে। সেরালির ছেলে হাত ইশারা করতেই লোকটি দৌড়ে গিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিল তার সামনে। সেরালির ছেলে লোকটার গালে কষে দিল এক চুমু। এক চুমুতে গালটা লম্বা করে ছেড়ে দিতেই চটাং চট করে একটা শব্দ হলো। লোকটা প্রচন্ড কষ্ট গোপন করে এটাকে স্রেফ ‘ভাগ্যচুম্বন‘ মনে করে আনন্দের হাসি ফুটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। সেরালির ছেলের চুম্বন নেওয়ার জন্য অনেকে অনেক কিছুই করল কিন্তু ‘ভাগ্যচুম্বন’ আর কারোর ভাগ্যে জোটেনি।
এক বয়স্ক লোক সেরালিকে বিনয়ের ভঙিতে বলল, ভাই, যে লোকটাকে আপনার ছেলে চুম্বন দিল সে কী উপঢৌকন এনেছিল একটু খোলাসা করে বলেন তো দেখি! আমাকে একটা চুমু দিলে সার্থক হই।
সেরালি বুদ্ধি করে বলল, লোকটা তেমন কিছু আনেনি-কয়েকটা সোনার মোহর এনেছিল মাত্র। একথা শুনে লোকটা ‘ভাগ্যচুম্বনের’ রহস্য বুঝতে পেরে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে চলে গেল এবং পরের দিন সোনার মোহর এনে সেরালির হাতে গুঁজে দিয়ে সেরালির ছেলের চুম্বনের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রইল। সেরালির ছেলে লোকটাকে ইশারা দিতেই লোকটা ছুটে গিয়ে গালটা পেতে দিল, সেরালির ছেলে লোকটার গালে চুমুর পরিবর্তে ঠাশ করে মারল এক চড়। লোকটা চড়টাকেই ‘ভাগ্যচড়‘ মেনে নিয়ে মোলায়েম হাতে গাল হাতিয়ে খুশিমনে বেরিয়ে গেল। সে মনে মনে বলল, ‘চুমার চেয়ে চড়ের চোট বেশি। সুতরাং ভাগ্যের দিক থেকে আমি একটুও ঠকিনি; লাভ কিন্তু আমারই হয়েছে।’
এভাবে সেরালির রহস্যছেলে এলাকার লোকজনকে মুল্যবান জিনিসের বিনিময়ে লম্বা লম্বা চুমা দিয়ে গালে টোল ফেলে দিল, তারসাথে মাগনা চড়-কিল-থাপড় তো আছেই। লোকেরা ওসব পেয়ে বেজায় খুশি। তারা বলে, ‘যে গাই দুধ দেয় তার লাথিও ভালো, চনাও ভালো!’ সুতরাং সেরালির ছেলের মুখের, হাতের ও পায়ের ঘা-গুঁতো খেয়ে এলাকার লোকজন ধন্য হতে লাগল। ছেলের সুবাদে সেরালির অর্থ-সম্পদ আর মান-মর্যাদাও দ্রুত বেড়ে গেল। ক্ষেত্র বিশেষে সুযোগ বুঝে সেরালিও লোকজনকে হাতে ও পায়ে ঘা-গুঁতো মারতে ভুল করে না। এতে কেউ বেজার হয় না, রহস্যছেলের বাপ বলে কথা! চলবে...