সব ঠিকই আছে, কিন্তু...
খায়রুল বাবুই
: কী ব্যাপার, বিষণ্ন মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা?
-না, সব ঠিক আছে।
: বলো কী? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একাধারে এত চরম ও গরম-এর মধ্যেও সব ঠিক?
-হুঁ। শীতকাল চলছে তো।
: কিন্তু বিরোধী চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা তো সবসময়ই বলেন, জনগণের ক্ষতি হয়-এমন কোনো আন্দোলন-হরতাল-সংগ্রামের ডাক দেবেন না তারা।
-ঠিকই তো বলেন। সেজন্যই তো তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে সম্প্রতি দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ গণমিছিলের আয়োজন করেছিল।
: কই, শান্তির তো কোনো নমুনা দেখা গেল না। তারচেয়ে বরং...
-আরে, ঢাকা শহরে অন্যান্য দিনের তুলনায় ওই দুইদিন যানজট কম ছিল। রাস্তায় প্রাইভেটকারও কম দেখা গেছে।
: কারণ ভয় আর আতঙ্ক গ্রাস করেছিল সবার মনে। অনেকেই বিনা প্রয়োজনে বাসার বাইরে বের হয়নি।
: ঠিকই তো আছে। ‘প্রাইভেট’ জিনিসের ওপর সবার মায়া থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। সেটা প্রাইভেট ‘কার’ হোক বা নিজের ‘প্রাণ’ই হোক।
: কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণ’ গণমিছিলে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে চার দলের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশসহ চার শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে গণমিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪ জন। তার বেলা?
-ঠিকই আছে। বিশৃঙ্খলাকারীদের ওপর পুলিশ তো ‘অ্যাকশন’ চালাবেই। আর অ্যাকশনে গুলি না চললে কি চলে? অতএব, ঠিকই আছে।
: ওদিকে পুলিশের কাজে বাধা, হামলা, সংঘর্ষ ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে চাঁদপুরে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় কত জনকে আসামি করা হয়েছে জানো? মোট ছয় হাজার। হা হা হা।
-হাসির তো কিছু নেই। ঠিকই তো আছে। মামলা না করলে তো ‘ওরা’ সুযোগ পেলেই আবার হামলা করবে।
: বিএনপি দাবি করেছে, নিহত ব্যক্তিরা তাদের দলের নেতা-কর্মী। তাই দলীয় নেতা-কর্মী হত্যার প্রতিবাদে পরদিন চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে আধাবেলা হরতাল ডেকেছিল স্থানীয় বিএনপি।
-নিজ দলের কর্মী প্রাণ দিয়েছে। হরতাল পালন করাটা অযৌক্তিক হয়নি। ঠিকই আছে।
: ওইদিনই এক সংবাদ সন্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, পুলিশ, র্যাব ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যৌথভাবে হামলা চালিয়ে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হতাহত করেছে। তিনি এর তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
-ঠিকই তো আছে। তীব্র নিন্দা প্রকাশ করাটাই উচিত। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে জ্বালাময়ী জবাব না দিলে চলবে?
: পৃথক ঘোষণায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
-উনি দলের প্রধান। তাই দলের নিহত কর্মীদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করবেন-এটাই স্বাভাবিক।
: আর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিক সন্মেলনে বলেছেন, জনগণের সমস্যা হয়, ভোগান্তি হয়, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়-এমন কিছুই করতে দেওয়া হবে না।
-অবশ্যই তিনি ঠিক বলেছেন। এ দেশে ডাণ্ডা না মারলে কেউই ঠাণ্ডা হয় না।
: আইজিপি সাংবাদিকদের আরও জানিয়েছেন, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
-হুঁ। এটাই তো নিয়ম। তদন্ত না করলে কীভাবে শিওর হওয়া যাবে যে ৪ জন মানুষ হত্যার সঙ্গে সত্যিই কারা জড়িত। অতএব, সব ঠিকই আছে।
: ধুর। সব যদি ঠিকই থাকে তাহলে মনটা বিষণ্ন কেন?
-শুনতে চাও?
: হ্যাঁ, অবশ্যই।।
-চাঁদপুরের আবুল হোসেন মৃধা বা লিমন ছৈয়ালকে চেনো? দু’জনই রিকশাচালক। কিন্তু তাদের পরিশ্রমী পায়ের চাপে আর ঘুরবে না রিকশার প্যাডেল। কারণ কপালে গুলি নিয়ে শুয়ে আছে লিমন। আর বুকে ও পেটে গুলি নিয়ে আবুল হোসেন মৃধাও এখন গভীর ঘুমে। তাদের সেই ঘুম ভাঙবে না আর। এবং লক্ষ্মীপুরের মো. রুবেল ও মো. আবুল কাশেমও স্বাভাবিক ঘুমের সীমানা পেরিয়ে গেছেন; চিরতরে। গুলি লেগেছে পেশায় বিদ্যুিমস্ত্রি রুবেলের ডান পাঁজরে এবং কাশেমের পেটে। সব ঠিক আছে-সবই। ঠিক নেই শুধু সেই ৪ জনের পরিবার। হঠাত্ই ভীষণ ওলট-পালট হয়ে গেছে সব। তাদের সংসারে দিনের প্রখর আলোতেও গ্রাস করে আছে ভীষণ অন্ধকার। রাতে, তাদের ঘরের চাল চুইয়ে পড়বে না অপার্থিব জোছনা-আকস্মিক স্বজন হারানোর বেদনায় গভীর রাতে কঁকিয়ে উঠবেন তাদের কেউ কেউ। নিভৃতে, একাকী চোখের জলে স্নান করাবেন প্রিয়জনের প্রিয় স্মৃতিগুলোকে।
: এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
-হ্যাঁ, সব তো ঠিকই আছে। এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই আমাদের নিয়তি।
: মানে?
-মানে ভবিষ্যতেও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মিছিল-আন্দোলনের ডাক দেবে বিরোধী দল। আর জনগণের শান্তি যাতে বিনষ্ট না হয় সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করার নামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুঁড়বেন। মৃধা, লিমন, রুবেল বা কাশেমের মতো কেউ ক্ষুধার তাড়নায় ভাত খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে গুলি খেয়ে চিরতরে ক্ষুধা মিটিয়ে আসবেন। তারপর? সাংবাদিক সন্মেলনের আয়োজন করা হবে। তীব্র নিন্দা ও শোক প্রকাশ, তদন্ত কমিটি, আধাবেলা-পূর্ণবেলা হরতাল-সবই হবে। আমরা সবই জানি। কারণ আমরা, এদেশের জনগণ নিয়মের ঘেরাটোপে বন্দি। সেই ‘টোপ’ গিলে গিলেই আমরা বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতেও হবে এভাবেই। ঠিক না?
: হুঁ? হ্যাঁ, ঠিকই তো মনে হয়!
...............................
আজকের tooফান (সংখ্যা ৩৪)-এ প্রকাশিত।
Click This Link page_id= 43