-ঠ্যালার ফকির মন্টু মেয়া-
চার মাস পুর্বে হাইকোর্টের সামনে থেকে ৮/৯ বছরের একটা ছেলেকে মারাত্মক অসুস্থ্য অবস্থায় কুড়িয়ে পায় আমার পরিচিত এক সিনিয়র বন্ধু। যিনি একটা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। একই সঙ্গে তিনি হাইকোর্ট মাজার কমিটির একজন কর্মকর্তা। আমি তখোন সিঙ্গাপুর যাবো চিকিতসার জন্য।বাচ্চাটাকে অমন অসুস্থ্য দেখে আমাকে বন্ধুটি কল করে জানায়-"মারাত্মক অসুস্থ্য ছেলেটাকে কি আমার ইয়াতীমখানায় নেয়া যায়"? আমি তাঁকে জানালাম-ইয়াতীমখানায় কাউকে আশ্রয় দেয়া অনেক ফর্মালিটিজের বিশয়। প্রথমেই জানালাম-আমার ইয়াতীমখানায় ৩২ জনের ক্যাপাসিটি।কিন্তু গত বছর সিডর দুর্গতদের ভিতর থেকে বরগুনা এবং পিরোজপুর জেলা প্রশাসকদ্বয়ের এবং আমার পরিচিত জনদের অনুরোধে আমাকে আরো ৮ জন বাচ্চা নিতে হয়েছে-বর্ত্মান দুর্মুল্যের বাজারে যাদের ব্যায়ভার বহন করা খুব দুঃস্বাধ্য হয়ে পরেছে। উপরন্তু কোন বাচ্চাকে ইয়াতীমখানায় নিতে হলে থানা-পুলিশ এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ছারাও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অনেক ফর্মালিটিজ মেন্টেন করতে হয়। উপরন্তু বাচ্চার বয়স অনুর্ধ ১০ বছর হতে হবে।
আমার দীর্ঘ বক্তব্য শুনে বন্ধুবর খুব হতাশ হয়ে বললেন-"ভাই, আমি আপনার কথা ভেবে অনেক আশা নিয়ে আমার ড্রাইভার-পিওন দিয়ে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়েছিলাম"! আমি বললাম-"ছেলেটার কথা শুনে আমারো খুব খারাপ লাগছে-কিন্তু কিছুই করার নেই! আপনি বরং ওকে বাড়ী নিয়ে যান-চিকিতসা করিয়ে কিছু পুণ্য হাসিল করেন........."।
রাতে আবার সেই বন্ধুটির ফোন।"ভাই, আমি ছেলেটিকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম-কিন্তু আমার বৌ কিছুতেই ওকে রাখবেনা। ড্রাইভার চলে গিয়েছে বাসায়। গ্যারাজের ভিতর ছেলেটিকে রেখেছি-ছেলেটির চিতকার আর কান্নায় প্রতিবেশীরাও খুব বিরক্ত হচ্ছে! এখোন রাতের বেলা যদি ওকে হাইকোর্টের মাজারে রেখে আসতে যাই-তাহলে না জানি কোন বিপদে পরি"! আমি বল্লাম-"রাতটা কোন রকমের রাখেন-কাল আপনি ইয়াতীমখানায় পাঠাবার ব্যাবস্থা করলে-ইয়াতীমখানার ডাক্তার দিয়ে চিকিতসা করিয়ে ছেড়ে দেবো"। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি-আমার ইয়াতীমখানায় আমার এক কাজিন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিনা পয়সায় ইয়াতীমদের চিকিতসা সেবা দেয়-এছারাও বেশ কয়েকজন নাম করা চিকিতসক বিনা পয়সায় মান্থলী একবার এসে চিকিতসা সেবা দিয়ে আমাকে সহযোগীতা করেন-তাদের কাছে আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। ব্যাঙ্কের এমডি সাহেব তাই করলেন। সকাল বেলা ইয়াতীমখানায় বাচ্চাটা নিয়ে গিয়ে তিনি আমাকে কল করেন। আমি ইয়াতীমখানার সুপারেন্টেন্ডকে করনীয় বলে দিলাম। সুপারিন্টেন্ড ডাক্তার দেখিয়ে জানালেন-ছেলেটির ১০৫ ডিগ্রী জ্বর! সারা শরিরে দগদগে ঘাঁ! মরে যেতে পারে। অবস্থা খুব বেশী খারাপ-অনেক দিন চিকিতসা লাগবে।
আমার মন্টা কেমন করে উঠলো! ছেলে বেলা আমার চিকেন পক্স হয়েছিলো। তখোন আমাকে আমার সৎ মা আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবের থাকার ঘরে একটা মশারীর ভিতরে থাকার ব্যাবস্থা করেছিলেন। যাতে আমার থেকে বাসার অন্যদের অসুখটা না ছড়ায়! তখোন আমার বয়স মাত্র ৬ বছর। বুবু লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে আদর করতেন, খাবার খাইয়ে দিতেন......... আমি খুব কান্না করতাম। জোড়ে কান্না করতামনা। কারন আমার কান্নার শব্ধ শুনলে আমার সাথে আমার বুবুকেও বকা শুনতে হবে............
আমি সুপারেন্টেন্ডকে বললাম-ছেলেটার চিকিতসা করার জন্য শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। সেখানে আমার বন্ধু ডাঃ জিয়াকে অনুরোধ জানালাম শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিতসা দেবার জন্য। অসুখ ভালো না হওয়া পর্যন্ত রেখে চিকিতসা করানোর জন্য এবং প্রয়োজনীয় খাবার এবং কাপড় চোপড়ের ব্যাবস্থা করার জন্য-বললাম ইয়াতীমখানার সুপারিন্টেন্ডেন্টকে। আমি সিঙ্গাপুরে চিকিতসা শেষে ফিরে এসে ইয়াতীমখানায় যাই। তখোন ছেলেটি মোটামুটি সুস্থ্য। নাম মন্টু, বয়স ১০ বছরের অনেক বেশী হবে। ওর কাছে নাম কি জিজ্ঞাসা করতেই বল্লো-"মন্তু মেয়া" নাম। বাবার নাম/বাড়ী কিছুই বলতে পারেনা। কাওরান বাজার রেল গেইটে থাক্তো ওরা মায়ের সাথে। মা ট্রেনে কাটা পরে মারা যায় বেশ ক'বছর আগে। হাইকোর্ট মাজারে কোন এক ঠেলা ভিক্ষুকের ঠ্যালা গাড়ী ঠেলে ভিক্ষা করতো। বিনিময়ে ওকে খাবার দিতো। অসুস্থ্য হবার পর ঠ্যালার ভিক্ষুক তাড়িয়ে দিয়েছে এবং অন্য একটা ছেলেকে হেল্পার হিসাবে নিয়েছে! মন্টু মিয়ার কথার টোন শুনে মনে হলো-ওর বাড়ী কিশোরগঞ্জ এলাকায় হবে। ডাক্তার জিয়া আমাকে জানালেন-মন্টু মিয়ার টাইফয়েড, আমাশয় এবং খুজলী-পাচড়া অসুখ হয়েছিলো। সবগুল অসুখেরই সুচিকিতসা চলছে। মাস খানেকের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে।
ডাক্তার এবং আমরা যত তাড়াতাড়ি আশা করেছিলাম তার চাইতে অনেক দ্রুত মন্টু মিয়া অসুখ থেকে সুস্থ্য হলো এবং খেয়ে দেয়ে তরতাজা হয়ে উঠলো। অন্য শিশুদের সাথে ওকেও পড়া শিখাতে গিয়ে সুপারেন্টেন্ড আমাকে জানালেন-"মন্টু মিয়া খুব মেধাবী, তবে বেয়াদব"! আমি মন্টু মিয়ার কাছে জানতে চাইলাম-সে এই ইয়াতীমখানায় থেকে পড়া লেখা করবে কিনা? মন্টু মিয়া রাজী হলে সুপারিন্টেন্ড থানায় এবং সোসাল ওয়েলফেয়ার মন্ত্রনালয়ের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের যথা যথ কর্তিপক্ষের কাছথেকে যাবতীয় ফর্মালিটিজ কম্পলিট করে ইয়াতীমখানার সদস্য হিসাবে আবাসিক সুবিধা দেয়া হলো।
মন্টু মিয়ার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগঃ-সে অসম্ভব দুস্টামী করে এবং অন্য ছোট শিশুদের কথায় কথায় মা-বোন তুলে নোংড়া ভাষায় গালাগালি করে। পড়তে চায়না। বার বার ইয়াতীমখানার কম্পাউন্ড ছেড়ে বাইরে বেড়ুতে চেস্টা করে বিড়ি খাবার জন্য। পালাতে চেস্টা করে, মশারীর ভিতর ঘুমায়না, শাওয়ার করতে চায়না, বাথরুম ইউজ না করে এখানে সেখানে পায়খানা-প্রশ্রাব করে। সব চাইতে সিরিয়াস অভিযোগ- রাতে সবাই যখোন ঘুমিয়ে পরে তখোন ইয়াতীমখানার অন্য ছোট ছোট শিশুদের প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে "নুনু" ধরে.........তাছারা সে ইতিমধ্যেই ৪ বার পালিয়েছিলো ইত্যাদি।
গত ফ্রাইডে আমি ইয়াতীমখানায় গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি-"মন্টু, তুমি কেনো এখানে থাকতে চাওনা? এখানেতো থাকা-খাওয়া-পড়া সবই ফ্রী-তারপরো কেনো পালাও"?
মন্টু মিয়া-"ছার, আমি ইয়ানে থাক্তাম্না, আমি হাইকুট যাইয়াম"।
আমি-"হাইকোর্ট গিয়ে কি করবা-ওখানেতো থাকার যায়গা নেই, খাবার নেই, কাপড় নেই, পড়তে পারবানা। এখানে তোমাকে সবাই আদর করে-পড়া লেখা শিখায়, বড় হলে টেকনিক্যাল কাজ শিখে ভালো কিছু করতে পারবা"।
মন্টু মিয়া-"না, আমি থাক্তাম্না, আমি হাইকুট যাইয়াম"!
আমি-"ওখানে গিয়েতো না খেয়ে থাকতে হবে, পড়া লেখা করতে পারবানা, আবার অসুখ হবে"!
মন্টু মিয়া-" হাইকুটে আমরা পৃতিদিন বিড়ানী-খ্যাচুড়ী খাই!
অসুক অইলেই বালা-বেশী ভিক্ষা পাওন যায়। আমি থাক্তাম্না, হাইকুট যাইয়াম। আমি ঠ্যালা ঠেলুম, বড় হইলে নিজেই ঠ্যালার ফকির অইয়াম"! ঠ্যালার ফকিরের অনেক ট্যাহা, ডেইলি ৪০০/৫০০ ট্যাহা থাহে-১০০ ট্যাহা ঠ্যালা বারা(ভাড়া) দিয়াও"!
আমি সুপারিন্টেন্ডেকে বল্লাম-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানা এবং সমাজ সেবা অধিদপ্তরে গিয়ে জানিয়ে দিতে-মন্টু মিয়াকে ইয়াতীমখানায় রাখা সম্ভব নয়।সুপারিন্টেন্ড সব কাজ সমাধা করে মন্টু মিয়ার জিম্মাদার আমার বন্ধু ব্যাঙ্কের এমডি সাহেবের কাছে তাকে হস্তান্তর করে দেয়া হলো।