চিরকুটে নুপূরের জন্য মেহেদি লিখছিল-
দিলাম ভাসিয়ে কাগজের ছোটো নৌকাখানি
তোমার বাড়ির দুয়ারে পৌছাবে একদিনই।
জীবন তরীর তলায় যখন মস্ত বড়ো ঢেউ
বন্ধু তোমায় খুঁজে ফিরি, সঙ্গে আছো কেউ?
আমার আছে সাগর ভরা নীল
আকাশ জুড়ে উড়ন্ত গাংচিল।
আমার যখন দিন ফুরোবে, ডুববে কাগজ তরী
বন্ধু তোমার স্নেহ দিও, দিও প্রাণ ভরি।
এটা থেকেই গল্পটার শুরু। ঘরের গ্রিল জড়িয়ে মেহেদি কাঁদছিল। বাইরে শীতের হিমশীতল বাতাস বইছে। এমন শীতের রাতে এলেই গত ক বছর ধরে এই জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মেহেদিকে কাঁদতে দেখি। একটা চিরকুট পড়ে আর নিশব্দে কাঁদে। বাইরে কুয়াশা।
গ্রিল ধরে বাইরে কুয়াশা দেখতে ভালো লাগে কার? কিন্তু ওর লাগে।বন্ধুরা বলে, যাবার সেতো গেছেই, এভাবে শীতের রাতে জানালায় তাকিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়ে কি লাভ? কিন্তু বন্ধুদের কথা শুনে আরও হাওমাও করে কাঁদে মেহেদি। ও বলে কুয়াশা দেখলেই তার ভীষণ কান্না পায়। অদ্ভুত এক ছেলেমানুষ ও।
মেহেদির গল্পটা অদ্ভুত ।
সেদিন শীতের রাতে আকাশ জুড়ে মেঘ ছিলো। হালকা হাওয়ায় নড়ছিলো গাছের পাতাগুলো। হিম হিম বাতাসের মধ্যেও ঘন কুয়াশা চারপাশে। চাদর মোড়ানো সে হাঁটছিল টিএসএসির সামনের রাস্তায়। ভাবল এ শীতে একটা আইসক্রিম খেলে কেমন হয়! রোমান্টিক। হাতে কুলফি আইসক্রিম। পথ চলতে শুরু করল কুয়াশার মধ্যে। হঠাৎ নামলো একপশলা বৃষ্টি। মেহেদি ভাবল কতোদিন ভিজিনা বৃষ্টিতে। এ শীতের ঝড়ে, আইসক্রিম খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভেজাটা দারুণ রোমান্টিক হবে। আনমনে হাঁটছিল। লাল নীল আলো পেরিয়ে যাচ্ছিল গন্তব্যহীন পথে। শীতল পরশে তার হাত মাথা মুখ ঠান্ডা। কিন্তু চলার গতিতে দেহ গরম। ভালো লাগছিল ভীষণ। হঠাৎ একটা ছাতা দোলাতে দোলাতে আসতে দেখা গেলো নুপূরকে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে আরও জোরে।
এই কুয়াশাভেজা নির্জনে একা বৃষ্টিতে একটা ছেলেকে ভিজতে দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো নুপূর। অবাক হয়ে দেখলো কেমন ভিজছে আনমনে। এরপর রিমঝিম রিমঝিম...। চোখে পড়ল চোখ। যেনো আকাশে বিদ্যুৎ খেলেলো।
কথা কয়ে উঠলো কেউ যেনো। মেহেদি ? কক্ষনো না! এমন ক্ষনে কথা বলবে সে? তবে কে বললো? বাতাস। উড়ে গেলো নুপূরের ছাতা। আরও ঝুম বৃষ্টি এলো। ঝাপসা আকাশ।
আলোর ঝলকানি মেঘে মেঘে। হৃদয় মাঝে। এরপর কতো বৃষ্টিস্নাত সময় কেটে গেলো।
দৃচোখ ভরে মেঘের বিদ্যুৎ দেখে মেহেদি। উড়াল মন সারসের মতো, আকাশ পেয়ে ডানা মেলেল চমকে দিয়ে নুপূর বললো-তুমি এমন কেনো? -কেমন আমি? -জানোনা বুঝি? -তাতো জানিনা। -আমি জানি, আমি তোমাকে জানি, আমার অন্তর দিয়ে জানি। -এটা কেমন কথা? -কেমন করে তুমি জানো?
-আমি তোমাকে একা বৃ্ষ্টিতে ভিজতে দেখেছি.আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই জানতে শুরু করেছি।
কথা বলতে বলতে দুজন একটা ছাউনির নিচে চলে এল। আবছা অন্ধকার। কেউ নেই আশপাশে। দুজন কাঁপছে শীতে। ভেজা পোশাকে। কেউ কারও মুখ ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। হঠাত মেহেদি তার গলার কাছে একটা উষ্ণ হাত টের পেল। ভেজা কিন্তু উষ্ণ। মেহেদি কথা বলতে চাইল। বলতে চাইল নুপূর। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। চোখ দুটো আবেশে বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর। গলাটা ধরে আসছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে।
মেহেদির থার্মোমিটারে রিডিং দেখাচ্ছে ১০৪। থরথর করে কাঁপছে। গলা ব্যথা, সর্দি, কাশি নানা উপসর্গ। গত রাত থেকে অনেক ভুল বকছে, উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছে। করোনা পজিটভি হওয়ার পর থেকে ঘরের গ্রিল ধরে উদাস চেয়ে থাকছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:৫০