বর্তমানে বসে যখন ইতিহাসের পাতা উল্টাই তখন হাজারো প্রশ্ন আমার মনকে ক্ষত বিক্ষত করে। মনে হয় ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে যদি ভিন্নভাবে সাজানো যেত! মনে হয় যদি ১৬৯০ সালে জব চার্নকের কাছে কলিকাতা, সূতানুটি ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রাম নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা না হতো, যদি ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির অনুমতি দেয়া না হতো, যদি মীর জাফর আলী খাঁ এবং তার সহযোগীরা নবাব সিরাজদৌলার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা না করতো, তবে আজ আমরা কেমন থাকতাম?
১৭৯৩ সালে যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন না করা হতো, যদি ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০), ফরায়েজী আন্দোলন (১৮২০-৬০), পাগল পন্থীদের বিদ্রোহ, বালকি শাহের স্বাধীনতা ঘোষনা কিংবা ১৮৫৬ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যার্থ না হতো, তবে আজ আমরা কেমন থাকতাম?
১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে এ অঞ্চলে যে উন্নয়ন শুরু হয়েছিল তা যদি কংগ্রেসের বিরোধীতায় ১৯১১ সালে ব্যহত না হতো, যদি মদ্যপ জিন্নাহ (ইংরেজদে প্ররোচনায় এবং স্কটল্যান্ডের বিশেষ পানীয় এর প্রভাবে) ধর্মের দোহাই দিয়ে দ্বি-জাতি তত্বের বিষবৃক্ষ রোপন না করতো, তবে আজ আমরা কেমন থাকতাম?
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন- এ কে ফজলুল হক, স্যার আঃ রহিম, জি এম দাসগুপ্ত, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শরৎ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীকে নিয়ে "বেঙ্গল প্যাক্ট" নামে হিন্দু-মুসলমান চুক্তিনামা সম্পাদন করে যে ভাতৃত্ত্বের স্রোতধারা প্রবাহিত করেছিলেন তা যদি ব্যর্থ না হত? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যদি অকালে মৃত্যুবরণ না করতেন, তবে আজ আমরা কেমন থাকতাম?
কংগ্রেস যদি সাইমন কমিশন সমর্থন করত কিংবা গোলটেবিল বৈঠকে ভারতী প্রতিনিধরা ঐক্যমত হতে পারতো, তবে কেমন হতো আমাদের বর্তমান?
১৯৩৭ সনের নির্বাচনের পর কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে কংগ্রেস নেতারা যদি অস্বীকার না করতেন? তবে কেমন হতো আমাদের বর্তমান?
উর্দ্দুকবি আল্লামা ইকবাল যে ভূখন্ড নিয়ে পাকিস্তান শব্দের উদ্ভাবন করেছিলেন, তা নিযেই যদি জিন্নাহগং সন্তুষ্ট থাকতেন, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল জিন্নাহ যদি তা ১৯৪৬ সালে পরিবর্তন না করতেন (Independent States পরিবর্তে Independent State) বা ক্যাবিনেট মিশন প্রত্যাখ্যান না করতেন এবং তার সাথে সাথে পূর্ব বাংলার বিভীষন খাজা নাজিমউদ্দিন এবং অন্যান্য নেতারা জিন্নাহকে সমর্থন না করতেন। জিন্নাহর প্ররোচনায় খাজা নাজিমউদ্দিন যদি হিন্দু মুসলাম দাঙ্গা সৃস্টি না করতেন, তবে কি আমরা অক্ষুন্ন রাখতে পারতাম না আমার ন্যায্য অধিকার? আমরাই কি থাকতাম না উপমহাদেশের সর্বাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্র (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সব ক্ষেত্রে)। যে স্বাধিনতা আমরা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে খন্ডিত মানচিত্র নিয়ে, তা আমাদের প্রাপ্য ছিল ১৯৪৭ সালে, যা চেয়েছিলেন দুই বাংলার আপামর মানুষের আকাঙ্খা অনুযায়ী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শরৎ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী, ছাত্রনেতা শেখ মুজিবর রহমান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী ১৯৪৭ সালের ৮ এপ্রিল স্বাধিন যুক্তবাংলার প্রস্তাব করেন কিন্তু তা ব্যর্থ হয় ইংরেজ সরকার, মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসের ভারত বিভাগ মেনে নেয়ার ফলে। ভারতবর্ষে একমাত্র বাংলা প্রদেশেই ছিল মুসলিমলীগের সরকার যা ছিল মুসলিমলীগের মূলশক্তি। অথচ জিন্নাহর প্ররোচনায় খাজা নাজিমউদ্দিনের মত অবাঙ্গালী নেতা (যার জন্ম এই বাংলায়) ও তার দোসরগন জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ১৯৪৬ সনের ১৬ আগষ্ট উস্কানীমূলক ভাষন দিয়ে সৃস্টিকরে এক কলঙ্কময় ইতিহাস হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা (যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নামে অভিহিত)। ফলে চিরদিনের জন্য নিশ্চিত হয়ে যায় যে দুইবাংলা আর এক থাকা সম্ভব নয়। ভেঙ্গে যায় অখন্ড ভারতবর্ষ - সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খা জলাঞ্জলি দিয়ে অবাস্তব দূরত্বের ভূখন্ড ও বৈষম্যমূলক জীবনধারার মানুষকে নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট মুসলমান প্রধান এলাকা পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে স্বাধিন হয় পাকিস্তান। ১৫ আগস্ট বাকি অংশ নিয়ে স্বাধিন হয় ভারত। দুই বাংলা বিভক্ত হয়ে যায় চিরতের। এক দুঃর্বিসহ পরিস্থিতিতে পরে ভারতের মুসলমানগন আর সদ্য প্রসূত পাকিষ্তানের হিন্দুগন। মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র করতে গিয়ে ভারতের বাকি অংশে বসবাসরত ৪ কোটি মুসলমানকে অগ্নিকুন্ডের মধ্যে ফেলে আসি আমরা। ভারত বিভাজন কি শুধুই মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র, নাকি জিন্নাহর জাতীর পিতা হবার নির্লজ্জ স্পর্দ্ধা এবং মুসলমান ব্যবসয়ীদের জন্য একটি সিকিউরড মার্কেট প্লেস নিশ্চিত করা? যারা ভারতবর্ষে টাটা-বিড়লার মত ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিলেন না।
ভারত বিভাজনকালে যদি সীমারেখা নির্ধারনে হটকারী পদক্ষেপ গ্রহন করা না হতো, যদি হিন্দু মুসলমানদের নিজ নিজ জন্মস্থানে বসবাসের নিশ্চয়তা প্রদান করা হতো অথবা দেশ বদলকারী সাধারণ মানুষকে সরকারী পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করা হতো, তাহলে কিছুটা হলেও কি অক্ষুন্ন থাকতোনা মানবতা?
- চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৫৩