ব্যতিক্রমী পত্রিকা
দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর-কে পত্রিকা না বলে সপ্তাহের আপটুডেট তথ্যসমৃদ্ধ ডেটা ব্যাংক-ও বলা যায়। পণ্যের দৃষ্টিনন্দনযোগ্য বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি গ্লোবাল আপডেটস শিরোনামে দেশ-বিদেশের সংক্ষিপ্ত সংবাদের চমৎকার উপস্থাপনা পত্রিকাটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। ইংরেজি ADVERTISER শব্দটির আই অক্ষরটির মাথায় ডট চিহ্নটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এটি বতসোয়ানার পুরো বাণিজ্য জগতের ওপর সার্চ লাইট ধরে আছে। আসলেই পত্রিকাটি বতসোয়ানার পুরো বাণিজ্য জগতের সার্চ লাইট হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপননির্ভর পত্রিকা হলেও কি নেই এতে! শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, ফ্যাশন, কার্টুন, কমিকস সবকিছুই আছে এতে। পত্রিকাটির কিছু কিছু বিষয় একজন সাধারণ পাঠকের সুনির্দিষ্ট কিছু চাহিদা যেমন পূরণ করছে এর পাশাপাশি বাণিজ্যিক জগতের একজন ক্রেতা-বিক্রেতা, উৎপাদনকারী-ভোগকারীর চাহিদাও পূরণ করছে। সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বিষয়ের চমৎকার উপস্থাপনা সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এটিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছে। অর্থাৎ এমনিই নয় বরং প্রয়োজনেই মানুষ পত্রিকাটি সংগ্রহ করে থাকে। বিজ্ঞান জগৎ, ফ্যাশন জগৎ, দেশ-বিদেশের সংক্ষিপ্ত সংবাদ এবং বাণিজ্য জগতের সাপ্তাহিক তথ্য নিয়ে পরিপূর্ণভাবে সমৃদ্ধ একটি ডেটা ব্যাংক পত্রিকাটি।
দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটি বতসোয়ানা জুড়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এ পত্রিকাটি বতসোয়ানার জেনারেল পাবলিকেশন্স-এর আওতায় নিউজপেপার হিসেবে নিবন্ধিত। আমি পত্রিকাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং সম্পর্কিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জেনেছি, পত্রিকাটি এর নিজস্ব আয় দিয়েই চলছে এবং দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। পণ্যের প্রচারে বিজ্ঞাপন যেমন একটি হাতিয়ার তেমনি বিজ্ঞাপন হচ্ছে দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটির হাতিয়ার। বিজ্ঞাপন বাবদ অর্থ দ্বারাই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খরচ মিটিয়ে পত্রিকাটি সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তথ্য নির্ভর বিজ্ঞাপন এবং দেশি-বিদেশি আপটুডেট সংবাদের কারণে দিন দিন এর পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ৯০ হাজার কপি ফ্রি বিতরণ করা হচ্ছে।
বতসোয়ানার অন্যান্য পত্রিকার ভিড়ে দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটি আমার কাছে অন্য একটি আবেদন নিয়ে আছে। বতসোয়ানার বাণিজ্য নীতিকে ধারণ করেই পত্রিকাটি সর্বশ্রেণীর জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে। মাত্র ১৫ লাখ জনগোষ্ঠীর একটি দেশে এ রকম চমৎকার একটি পত্রিকা ৯০ হাজার কপি পুরো ফ্রি বিতরণ করা হয়। আমি অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পত্রিকাটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। এখানকার বাঙালিদের কাছে শুনলাম এটি পুরোপুরি বিজ্ঞাপননির্ভর একটি পত্রিকা। বিজ্ঞাপনের আয় দিয়েই পত্রিকাটি চলে। শুধু বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে একটি পত্রিকা বটসোয়ানায় জনপ্রিয়তার সঙ্গে টিকে আছে। এটি আমার কাছে খুব চমৎকার একটি আইডিয়া বলে মনে হয়। আমাদের দেশে মোবাইল কোম্পানি, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানি প্রতি বছর শত শত কোটি কোটি টাকা শুধু বিজ্ঞাপনের পেছনে ব্যয় করে থাকে। এ বিজ্ঞাপন ব্যয়টা আবার ভোক্তার কাছ থেকেই কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেয়। বিশাল পুঁজির অধিকারী একেকটি কোম্পানি বিজ্ঞাপন বাবদ প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং অন্যান্য মিডিয়ার পেছনে যা ব্যয় করে তা অবিশ্বাস্য। আমাদের দেশের সব কটি পত্রিকাই নাকি এ বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। বাংলাদেশে সবকটি পত্রিকাই একটি নির্ধারিত দামে কিনতে হয়। আমি বতসোয়ানা আসার আগে আমাদের সময় নামে দুই টাকা মূল্যমানের একটি পত্রিকা দেখে এসেছিলাম। আমার ধারণা, বাংলাদেশে এটিই মনে হয় সবচেয়ে কম দামের একটি দৈনিক পত্রিকা। কিন্তু এটিও জনগণের কাছে ব্যপকভাবে পৌঁছতে পারছে না। পত্রিকার দাম দুই টাকা হোক আর ১০ টাকা হোক নিয়মিতভাবে পত্রিকা কিনে পড়েন এমন পাঠকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুব কম। আরো একটি সমস্যা হচ্ছে, এ অল্প জনগোষ্ঠীর মধ্যেই আবার নানা মতের পত্রিকা পাঠক। মতাদর্শগত কারণে একেক পত্রিকার পাঠক সংখ্যাও একেক রকম। যিনি যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, তিনি সেই মতাদর্শের পত্রিকাই পড়েন। অন্য মতাদর্শের পত্রিকা কমই দেখেন। আবার সব পত্রিকাই সংবাদে, তথ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ার কারণে পাঠকরাও আপডেট তথ্য পান না।
কাউকে তার পণ্য, সেবা বা মতাদর্শ নিয়ে সব পাঠকের দ্বারে পৌঁছতে হলে সব পত্রিকাতেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে যা খুবই ব্যয়বহুল এবং অসম্ভবও বটে। দেশের আপামর জনগণের মনের কথা বলবে এ রকম একটি পত্রিকা যদি বিনামূল্যে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যেতো তাহলে বিশাল একটি পাঠক শ্রেণীর কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হতো। আমাদের দেশে এ রকম কোনো পত্রিকা নেই। না সরকারিভাবে, না বেসরকারিভাবে। যে দেশে একটি পত্রিকার চেয়ে আধা কেজি চাল কেনাই দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আরাধ্য বিষয়, সেখানে পত্রিকার পাঠক কম হবে সেটাই স্বাভাবিক। বতসোয়ানার জনগোষ্ঠী ১৫ লাখ। দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজার পত্রিকাটি যদি ৯০ হাজার কপি ফ্রি বিতরণ করা হয়, তাহলে প্রায় প্রতি ১৭ জনে একজন এ পত্রিকাটি পড়ার সুযোগ পায়। বিজ্ঞাপননির্ভর এ পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপনকে এমন একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, অল্প শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছেও এটির ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। পণ্য বা সেবাকে বিজ্ঞাপনের ভাষায় জীবন্ত করে তুলে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন- এটি আমার কাছে অভিনব মনে হয়েছে।
আমাদের দেশের সব দৈনিক পত্রিকার সর্বোচ্চ গ্রাহক বড়জোর ৮ থেকে ১০ লাখ। সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাহক আর বড়জোর ২-৪ লাখ। আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোর গ্রাহক সংখ্যা মিলে মোট সংখ্যাটা ১৫ লাখের অধিক হবে না। ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর এ দেশে মাত্র ১৫ লাখ লোকের কাছে পত্রিকা পৌঁছতে পারে আর ১৪ কোটি ৮৫ লাখ লোকের কাছে পৌঁছতে পারে না। এটি কি গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে না? একটি পত্রিকা একজন ব্যক্তির হাতে যাওয়া মানে কিছু তথ্য তার হাতে যাওয়া। আর যে ব্যক্তি তথ্যে যতো সমৃদ্ধ বিশ্বায়নের এ যুগে তার টিকে থাকার সম্ভাবনাই অধিক। আমাদের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্য পৌঁছতে পারছে না। আমরা তাই বিশ্বায়ন থেকে পিছিয়ে পড়ছি। আধুনিক তথ্যসমৃদ্ধ এ যুগের অনিবার্য পরিণতি বিশ্বায়ন। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত না করে কিংবা তথ্যে যুগোপযোগী না করে আমরা ক্রমেই বিশ্বায়ন থেকে পিছিয়ে পড়বো। আমাদের এখন প্রয়োজন বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। আর এর জন্য প্রয়োজন দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে তথ্যের মধ্যে রাখা। একজন ব্যক্তির কাছে প্রতি সপ্তাহে বা প্রতিদিন যদি বিনামূল্যে একটি পত্রিকা পৌঁছে দেয়া যায় তাহলে সে প্রতিনিয়তই তথ্যে আপটুডেট থাকবে। এটি আমাদের দেশের জন্য খুবই দরকার।
কোটি কোটি পাঠকের কাছে আপডেট তথ্যসমৃদ্ধ একটি তথ্যের ভান্ডার বিনামূল্যে পৌঁছে যাবে এটি আমার বাংলাদেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় মনে হয়। দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটি দেখে আমার এ ধারণাটা আরো বদ্ধমূল হয়েছে। পণ্যকে বিজ্ঞাপনের কাছে নিয়ে নয় বরং বিজ্ঞাপনকে পণ্যের কাছে নিয়ে গিয়ে পত্রিকাটি লক্ষ পাঠকের চাহিদা মেটাচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক ছোট উৎপাদনকারী, পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী, মাঝারি-ক্ষুদ্র এমন কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যারা নিজেদের পণ্য বা সেবা প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপনের ধারেকাছেও যেতে পারে না। বড় বড় পুঁজির অধিকারী জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বিশাল বিশাল বাজেটের বিজ্ঞাপন প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের আকৃষ্ট করছে। বিজ্ঞাপনের মোহময়ী মায়াজালে পড়ে আমরা বিজ্ঞাপিত পণ্যটি চোখ বুজে কিনে ফেলছি। পণ্যটির গুণ-মান তেমনভাবে যাচাই করে দেখছি না।
দেশীয় প্রযুক্তির সহায়তায় আরেকটি একই মানের কিংবা উন্নতমানের পণ্য শুধু প্রচারের অভাবে ক্রেতা বা ভোক্তার নজরে না আসার কারণে বাজারে টিকে থাকতে পারছে না। ছোট কিংবা মাঝারি উৎপাদনকারীর পণ্য বা সেবা জনগণের গোচরে আসতে পারছে না প্রচলিত প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উচ্চ বিজ্ঞাপন রেটের কারণে। একেকটি পণ্যের বিজ্ঞাপন ব্যয় এতো বেশি যে, অল্প পুঁজির উৎপাদনকারী কিংবা পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীরা নিজেদের পণ্য বা সেবা প্রচারে এগিয়ে আসার সাহসও করছে না। ফলে দেশীয় প্রযুক্তি এবং প্রচেষ্টায় তৈরি একটি পণ্য ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিতির অভাবে বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যের কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের দেশের পণ্য বা সেবার উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারীকে নিরুৎসাহিত করছে। এ রকম একটি পত্রিকা করার মাধ্যমে মাঝারি কিংবা ক্ষুদ্র পণ্য এবং সেবার উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যায়।
বতসোয়ানার দি অ্যাডভার্টাইজর পত্রিকাটি পুরোপুরি স্টাডি করে আমার মনে হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পণ্য বা সেবার উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারীর দোরগোড়ায় বিজ্ঞাপনকে নিয়ে গিয়ে শুধু বিজ্ঞাপননির্ভর একটি সম্ভাবনাময় পত্রিকা আমাদের দেশে হতে পারে। প্রচলিত অন্য পত্রিকাগুলোর প্রতিযোগী হিসেবে নয় বরং সহযোগী হিসেবেই পত্রিকাটি থাকবে। আমাদের দেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলো বিজ্ঞাপন বাবদ যে আয় করে এর এক সপ্তাহের বাজেট দিয়েই এ রকম একটি পত্রিকা শুরু করা সম্ভব। এক সময় পত্রিকাটি নিজস্ব লাভ দিয়েই আস্তে আস্তে সম্প্রসারিত হবে। দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ যাদের পত্রিকা কেনার সামর্থ্য নেই ক্রমান্বয়ে তাদের কাছে বিনামূল্যে এটি পৌঁছে যাবে। সরকারি প্রচেষ্টাতেও এ রকম একটি পত্রিকা চালু করা যায়। লাইফ লং এডুকেশনকে সামনে রেখে দেশের আপামর জনসাধারণকে শিক্ষিত করার প্রয়াসেও এ রকম একটি পত্রিকা চালু করা যায়।
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণকে পণ্য বা সেবার তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত আপডেট সংবাদ নিয়ে সাপ্তাহিক আকারেও এটি চালু করা যেতে পারে। এরপর নিজস্ব অর্থায়নেই এটি পাঠক জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রসারিত হবে। এক পর্যায়ে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়ে লক্ষ-কোটি পাঠকের চাহিদা মেটাবে। এভাবে ধীরে ধীরে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে পত্রিকার মাধ্যমে তথ্যসমৃদ্ধ করে বিশ্বায়নকে কাছে টেনে দারিদ্র্য বিমোচনেও ভূমিকা রাখতে পারে পত্রিকাটি। আর কে না জানে, যে ব্যক্তি তথ্যে যতো সমৃদ্ধ সে দরিদ্র থাকতে পারে না। এক দল দক্ষ তরুণ উদ্যোক্তা, একটি প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক অফিস এবং একটি সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে এ রকম একটি ধারণা বাস্তবায়িত হতে পারে। দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজরের মতো এ রকম একটি পত্রিকা আমাদের দেশের বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাবে বিনামূল্যে। বতসোয়ানার প্রতি ১৭ জনে একজনের হাতে পত্রিকাটি বিনামূল্যে পৌঁছতে পারলে আমাদের ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশে প্রতি ১৫ জনে একজনের হাতে এ রকম একটি পত্রিকা পৌঁছানো খুবই সম্ভব।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:২৩