২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ঠিক উত্তরে বতসোয়ানা নামে একটি দেশে গিয়েছিলাম। ঐ দেশের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম দেখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রায় ৫ মাস ছিলাম। ২০০৬ সালের রমজান এবং ঈদ ঐ দেশে বসেই করতে হয়েছিল। বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটুকরো বিশ্ব ছিল। আমার হোস্টেল রূম। চব্বিশ ঘন্টা ইন্টারনেট কানেকশন থাকায় আমার ল্যাপটপ দিয়ে আমি একটি বিশ্ব সাজিয়ে নিয়েছিলাম।
২০০৭ এর ওয়ান ইলেভেনের আগে বাংলাদেশের অস্থির এই সময়টাতে আমাদের দেশের ভাবনাগুলো নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলাম। সময়ের প্রয়োজনে এই ভাবনাগুলো নতুন চিন্তার সূত্র হতে পারে।
এইসব ভাবনাগুলো নিয়েই ডুমেলা বতসোয়ানা ধারাবাহিকটি সাজানো। আশা করি আপনারা আমার এই ভাবনাগুলোকে নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে এবং ঈদ মোবারক।
বতসোয়ানা দেশটির সর্বদক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্তমান এই অর্থনৈতিক যুগে দক্ষিণ আফ্রিকা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটামুটি শক্তিশালী। আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসায় স্থাপন করাও নাকি খুব সহজ। কোন রকমে ঐ দেশে পৌঁছুতে পারলেই হলো। পনের-বিশ হাজার র্যান্ড অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় দেড়-দুই লাখ টাকা হলেই ছোটখাট মুদি-স্টেশনারী দোকান দিয়ে ধুমসে ব্যবসা কর। মাসে লাভ বাংলাদেশী টাকায় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা। এই ছোট-খাট ব্যবসায় থেকে একদিন মাঝারি তারপর বড় ব্যবসায়। অল্পদিনেই কোটিপতি! এমনও শোনা যায়, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে খেটে খাওয়া পরিবারের এক সন্তান কোনরকমে দক্ষিণ আফ্রিকা এসে পৌঁছুনোর পর মুদি/স্টেশনারী দোকানের ব্যবসায় করে বাংলাদেশে এখন বিরাট বড়লোক। এখন তার গ্রামের বাড়ীতে দশ-বিশজন কামলা খাটে। আমাদের দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু যুবক-কিশোর দালালদের এইরকম গল্পের ফাঁদে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি জমাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আগে ‘পলিটিক্যাল এ্যাসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় অনেক সহজ ছিল। ফলে অবৈধভাবে আগত বাংলাদেশীরা স্থানীয় উকিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করে ‘রেসিডেন্ট পারমিট’ সহজেই পেয়ে যেত। আমার মনে হয় নেলসন ম্যান্ডেলার সময়ে মানবাধিকারের বিষয় বিবেচনা করে দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশের জন্য এরকম সুবিধা রেখেছিল। কিন্তু এখন এই আইনটির অপব্যবহারের ফলে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ আইন এখন খুব কঠোর করা হয়েছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা আসা এখন অনেকটা কষ্টকর। এই সুযোগে আদম ব্যবসায়ীরা বতসোয়ানা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার বিকল্প এবং ঝুঁকিপূর্ণ রুট বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বতসোয়ানা আসাটা অনেকটা সহজ। বতসোয়ানা সরকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে ডায়মন্ডের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ‘ট্যুরিজম শিল্প’ কে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকেও খুব সহজেই স্বাগত জানায়। তাই এখানকার বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এদেশে কেউ সত্যিকারের বিনিয়োগ করতে আসলে সহজেই আসা যায়।
বিদেশী বিনিয়োগ এবং ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে সরকারের এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে দালালচক্র বাংলাদেশীদের দক্ষিণ আফ্রিকা পাঠানোর প্রলোভন দিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় কিংবা বিনিয়োগকারী দেখিয়ে বতসোয়ানা নিয়ে আসে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সীমানার দালাল চক্রের যোগসাজসে সুযোগ বুঝে সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়। এটি অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেকসময় সীমান্তরক্ষীদের ছোঁড়া গুলি ভাগ্যাহত বাঙালির করুণ মৃত্যুর কারণ ঘটায়। তাছাড়াও ধরা পড়লে জেল-জরিমানা তো হয়ই। কিন্তু তারপরও এভাবে মানুষ পাচার বন্ধ নেই। প্রতিদিনই দু’চার পাঁচজন করে বাঙালি আসছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা পাচার হচ্ছে। বিষয়টি সম্প্রতি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার ইন্টারপোলের সহায়তায় এই বিষয়টি তদন্তে নেমে বেশ ক’জন অবৈধ বাঙালিকে ধরে এদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জ্ঞাত হয়। এর সাথে বতসোয়ানার কিছু বাঙালি এবং পাকিস্তানী আদম পাচারকারী, বতসোয়ানার কিছু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, লেবার অফিসার, লিগ্যাল এডভাইজার এর একটি চক্র জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন বতসোয়ানায় বসবাসকারী বাঙালিদের যারা অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছে তাদের এখন চরম দুঃসময়। বেশ ক’দিনে অনেক বাঙালিকে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতি ফ্লাইটে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লাখ লাখ টাকা খরচ করে সোনার হরিণ ধরার আশায় যে সমস্ত ভাগ্যাহত যুবক-কিশোররা দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে এদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কী করণীয় কিছু নেই? সরকার ইচ্ছে করলে বতসোয়ানার সরকারের সাথে চুক্তিপত্র করে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীদের এদেশে আসায় উৎসাহিত করতে পারে। (কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম সরকারিভাবে কিছু ডাক্তার রিক্রুট করা হয়েছে বতসোয়ানায়।) এদেশে বিনিয়োগের জন্য আসলে বতসোয়ানার সরকার সত্যিকারভাবেই স্বাগত জানাবে। এটি একটি বিনিয়োগ বান্ধব দেশ। কিন্তু আমাদের দেশের কতিপয় লোভী দালাল চক্র বতসোয়ানাকে দক্ষিণ আফ্রিকা গমনের ট্রানজিট পয়েন্ট বানিয়ে জনশক্তি রপ্তানির এরকম একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রকে কলুষিত করে তুলছে।
বতসোয়ানায় বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোর সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ভিজিট ভিসায় কোন আদম আনা হয়। গ্রামের অশিক্ষিত, মূর্খ আদমকে কোম্পানির ডাইরেক্টর বানিয়ে, বিদেশী ট্যুরিস্ট সাজিয়ে যখন প্লেনে উড়িয়ে এখানে নিয়ে আসা হয় তারপর অনেকেই ইমিগ্রেশনের দরজা পার হয়ে বতসোয়ানা ঢুকতে পারে না। কী করে পারবে ? এক ফোঁটা ইংরেজি না জানা এ ধরনের বিজনেসম্যান বা ট্যুরিস্ট ম্যানদের যখন ইমিগ্রেশন অফিসার প্রশ্ন করেন, ‘তুমি বতসোয়ানা এসেছ কি উদ্দেশ্যে?' হা করে চেয়ে থাকতে হয়।
কিছুদিন আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দেওয়ার প্রলোভনে বাংলাদেশ থেকে ‘ইয়েস-নো-ভেরিগুড’ ইংরেজি জানা এক আদম ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নের জবাবে না পেরে বাংলায় আবোল-তাবোল বকতে লাগল। ইমিগ্রেশন অফিসার তো থ! ইমিগ্রেশন অফিসার তাকে যা কিছুই জিজ্ঞেস করছে, ছেলেটি বাংলায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে আমাকে বতসোয়ানা ঢুকতেই হবে। ইমিগ্রেশন অফিসার ছেলেটির কথা কিছুই বুঝতে না পেরে তাকে বলল বাংলাদেশে ফেরত যেতে। এত টাকা নষ্ট করে এসেছে ফেরত সে যাবে না, মরিয়া হয়ে ছেলেটি কোনরকমে বাংলার সাথে উচ্চারণ করল ‘এনি হাউ’। ছেলেটি মনে হয় বুঝাতে চেয়েছিল “এনি হাউ, আমাকে ঢুকতেই হবে।” ব্যাস ইমিগ্রেশন অফিসার পুলিশের সাহায্যে জোর করে তাকে ফিরতি ফ্লাইটে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে গ্রামের একরকম অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত যুবকদের দক্ষিণ আফ্রিকা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে বতসোয়ানাকে ব্যবহার করে, বতসোয়ানায় প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের এখানে আগমনকে কঠিন করে তোলা হচ্ছে। বতসোয়ানা সত্যিকার অর্থেই বিনিয়োগ বান্ধব দেশ। সত্যিকার বিনিয়োগকারীরা যাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে পারেন এজন্য সরকারকে আশু কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমতঃ বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে সরাসরি বতসোয়ানায় একটি হাইকমিশন স্থাপন। বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকমিশনের মাধ্যমে বতসোয়ানার কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে বতসোয়ানায় বসবাসরত বাঙ্গালীদের জন্য খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এই সুযোগে আদম পাচারের রুট হিসেবে বতসোয়ানাকে ব্যবহার সহজ হচ্ছে যা আমাদেরকে এ অঞ্চলে জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেবে।
দ্বিতীয়তঃ সরকারি পর্যায়ে জনশক্তি রপ্তানির জন্য বতসোয়ানা সরকারের সাথে আলোচনা। এদেশে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিশেষ করে ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং আইটি ক্ষেত্রে এ অভাব খুবই প্রকট। এখানে গুটিকয় যে বাঙালি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটি অফিসার আছেন তারা উচ্চ বেতনে সরকারি-বেসরকারি চাকুরি করছেন। প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপনের জন্য ও এখানে বাঙালি ডাক্তাররা আসতে পারেন। এদেশে চিকিৎসকের চাহিদা প্রচুর। এখানকার মুদ্রা পুলার মান বাংলাদেশী টাকার চেয়ে দশগুণ শক্তিশালী হওয়ায় বাংলাদেশি টাকায় বেশ মোটা অংকের টাকা বেতন হিসেবে প্রতিমাসে ঘরে আসে যা বাংলাদেশে এই পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের কাছে স্বপ্নের ন্যয়। এখানে ফার্মাসিস্টদেরও খুবই ডিমান্ড। বাংলাদেশী হাতে গোনা ক’জন ফার্মাসিস্ট এবং ডাক্তার এখানে থেকে রমরমা কামিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটি অফিসার এর মত দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
তৃতীয়তঃ বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগকারী সাজিয়ে এনে এদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পাচার বন্ধ করার জন্য সরকার এর সংশ্লিষ্ট বিভাগ সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। বতসোয়ানায় প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা যাতে আসতে পারেন এর জন্য প্রয়োজনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে আলাদা একটি মনিটরিং সেল খোলা যেতে পারে। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারীকে যথাযথ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এ সেল খোলা হবে যাতে সে কোন হয়রানির শিকার না হয়।
এদেশে বিভিন্ন টেকনিক্যাল সেক্টরে চাকরির সুযোগ প্রচুর থাকলেও অন্যান্য সেক্টরে তেমন নেই। বড় বড় কিছু সুপার স্টোর, চেইন শপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে লেবার শ্রেণীর চাকুরি পাওয়া যায়। তাই এদেশে চাকুরি করতে আসার আগে জব মার্কেটটি ভাল করে দেখে তবেই আসা উচিত। গুগুল সার্চে গিয়ে বতসোয়ানার জব সাইট ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জব সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া যেতে পারে। এদেশে বিনিয়োগের জন্যও বতসোয়ানার বিনিয়োগ সাইট ভালভাবে ঘুরে দেখা যেতে পারে।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:১০