ডুমেলা বতসোয়ানা-২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আগের পর্ব পড়তে চাইলে-View this link
২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ঠিক উত্তরে বতসোয়ানা নামে একটি দেশে গিয়েছিলাম। ঐ দেশের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম দেখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রায় ৫ মাস ছিলাম। ২০০৬ সালের রমজান এবং ঈদ ঐ দেশে বসেই করতে হয়েছিল। বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটুকরো বিশ্ব ছিল। আমার হোস্টেল রূম। চব্বিশ ঘন্টা ইন্টারনেট কানেকশন থাকায় আমার ল্যাপটপ দিয়ে আমি একটি বিশ্ব সাজিয়ে নিয়েছিলাম।
২০০৭ এর ওয়ান ইলেভেনের আগে বাংলাদেশের অস্থির এই সময়টাতে আমাদের দেশের ভাবনাগুলো নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলাম। সময়ের প্রয়োজনে এই ভাবনাগুলো নতুন চিন্তার সূত্র হতে পারে।
এইসব ভাবনাগুলো নিয়েই ডুমেলা বতসোয়ানা ধারাবাহিকটি সাজানো। আশা করি আপনারা আমার এই ভাবনাগুলোকে নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে এবং ঈদ মোবারক।
.....................................................................................................
.....................................................................................................
১. ডুমেলা!!
এটি বতসোয়ানার কোন মেলা বা প্রদর্শনীর নাম নয়, বতসোয়ানার প্রচলিত সম্ভাষণ রীতি। বতসোয়ানার ভাষায় কাউকে সম্ভাষণ করতে ডুমেলা বলে শুরু করতে হয়। অনেকটা আমাদের দেশের ‘কি খবর কিংবা কেমন আছেন’ টাইপের অর্থ বহন করে ডুমেলা শব্দটি। নারীদের ক্ষেত্রে ‘ডুমেলা মা’ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘ডুমেলা রা’। নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ‘মা’ শব্দটি সেই আমার দেশ থেকে সাত মহাসমুদ্র পারের এ অঞ্চলেও আছে জেনে আমার বেশ ভালো লাগলো। নারীরা তো মায়েরই জাত, যুগ যুগ ধরে তাইতো জেনে এসেছি। তাই এখানকার ‘ডুমেলা মা’ সম্ভাষণটি আমার দেশের চিরন্তন বাঙ্গালী মায়ের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরে ঠিক মাথার উপর উল্টো করে বসানো হীরার মুকুটের মত মনে হয় বতসোয়ানা দেশটিকে। পুরো আফ্রিকা মহাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে বতসোয়ানাকে মনে হবে দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলের একেবারে হৃদপিন্ড। আসলেই তাই। অবস্থানগত দিক দিয়ে বতসোয়ানাকে সাউদার্ণ আফ্রিকার হৃদপিন্ডই বলা হয়। একমুঠো হীরার টুকরা যেন হৃদপিন্ডটি, শুধুমাত্র অপরিশোধিত এই যা। একটু ঘষে মেজে হীরার আসল রূপটা বের করে নেওয়ার অপেক্ষা। আসলেই এদেশটি হীরার খনির দেশ। ১৯৬৬ সালে ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ১৯৬৭ সালে হীরার খনি আবিস্কৃত হয়। আর তাতেই দেশটির ভাগ্য আমূল খুলে যায়। মোট বৈদেশিক রপ্তানী আয়ের শতকরা আশি ভাগ এবং রাজস্ব আয়ের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ আসে এই হীরা থেকে।
২. এই দেশে আছি আজ প্রায় সাড়ে তিন মাস হতে চলল। একটি নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন তার সংস্কৃতি। আমার কাছে এদেশের অনেক কিছুই নতুন মনে হয়, যা আমাদের দেশের সংস্কৃতির সাথে একদমই মানায় না। এই দেশের অনেক কিছুই আমার কাছে ভালো লাগে না। এখানে মহামারী আকারে এইডস বিস্তার করে আছে। নারী পুরুষের অবাধ যৌনাচারই এদেশে ভয়াবহভাবে এইডস এর বিস্তারের কারণ। এদেশে বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধনরীতিতে কেউ আবদ্ধ হতে চায় না। ভাল লাগল কিছুদিন একত্রে ‘লিভ টুগেদার’ করবে, ভাল না লাগলে যার যার পথে চলে যাবে, অনেকটা পাশ্চাত্য কালচারের রীতি আর কি! কিন্তু তারপরও এদেশের অনেক রীতি-নীতি আমাদের দেশ থেকে অনেক ভাল। বহু বছর আগে থেকেই এদেশে বিদেশীরা বিশেষ করে ভারতীয়, পাকিস্তানী, বাঙ্গালী, চায়নারা এসে বসবাস করতে শুরু করে। এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে ভারতীয়রা অনেকেই এদেশে এসে বিয়ে শাদী করে এদেশীয় সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা ইন্ডিয়ান মুসলিম, পাকিস্তানী এবং বাঙালি মুসলিম মিলে এদেশে মুসলমানের সংখ্যাটা ভালই বলতে হবে। এখানে বাঙালি আছে কারও কারও মতে প্রায় ৫ হাজার। বাঙালিরা এদেশে আসা আরম্ভ করে সিকি শতাব্দী আগে প্রায়। কেউ কেউ চাকরির সন্ধানে, কেউ জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে, কেউ ব্যবসা করার অভিপ্রায়ে আবার কেউবা চাকুরির খেঁজে। বাঙালি বেশ ক’জন এখানে এদেশীয় বিয়ে করে ঘর সংসার পেতেছে। বেশ ক’জন বাড়িঘর কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা-ভাবনা করছেন। এদেশটিতে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এত সুন্দর যে এখানে যারা দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন তারা এদেশে সুদীর্ঘসময় কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
এদেশে আমাদের দেশের মত এরকম বিভাগ, জেলা, উপজেলা কিংবা গ্রাম নেই। এখানে আছে বেশ ক’টি ডিস্ট্রিক্ট এবং টাউন। বাকি সব ভিলেজ। আমি একবার গ্যাবরন থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে ‘লোবাটসে’ নামে একটা ‘ভিলেজ’ এ গেলাম। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত শহর `Zeerust’ এর কাছাকাছি। কী যে সুন্দর যে লেগেছে ভিলেজটিকে। যেন ফ্রেমে বাঁধানো বিশাল আয়তনের ছবি। পাহাড়ী আঁকা বাঁকা উচু নীচু সর্পিল পথ বেয়ে যখন বিকেলের শেষ সময়ে ভিলেজটিতে পৌঁছি মনে হলো কোন এক বাগানের জগতে ঢুকছি। চারিদিকে গাছ গাছালিগুলোতে কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে! লাল ফুল, নীল ফুল, বেগুনি ফুল, আরও আরও কত রঙ্গের ফুল। আমি মুগ্ধ হয়ে যাই ফুলে ফুলে ছাওয়া লোবাটসের সৌন্দর্য দেখে। এটি নাকি বতসোয়ানার রাজধানী হওয়ার কথা ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত এদিকে খুব কাছে হওয়ায় পরে রাজধানী সরিয়ে গ্যবরন নিয়ে আসা হয়। আমার যদি কখনো কিছু টাকা হয় আমি আবার এদেশটিতে চলে আসব লোবাটসে নামক ভিলেজটিতে থেকে যাওয়ার জন্য।
৩. এদেশে মদ-বিয়ার এতটাই সহজলভ্য যে, পানির দামে এগুলো বিকোয়। পুরুষ-নারী, ছেলে-মেয়ে, সবার হাতে হাতে মদ-বিয়ারের বোতল থাকে। ওরা মদ-বিয়ার পান করে উম্মাত্তাল হয়, হয়ে রাস্তা ঘাটে সর্বত্র নাচতে থাকে। তবে মদ খেয়ে বেহেড মাতাল হয়ে মাতলামি করে না। সবাই সব সময় খুব আনন্দে থাকে। কিন্তু ওদের এই কালচারের সাথে আমি বড্ড বেমানান। তাই আমার ওসব করা হয়ে ওঠে না। আমি ক্লাশ শেষে কিংবা লাইব্রেরী ওয়ার্ক শেষে আমার রূমের ছোট্ট জগতটিতেই পড়ে থাকি। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে আমার দেশের সাথে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো পড়ি। ইদানীং দেশের খবর পড়লে বুক থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বড্ড হতাশার সেই দীর্ঘশ্বাস। তাই সবগুলো পত্রিকা তেমন একটা পড়ি না, অনেকটা ইচ্ছে করেই। কারণ এখন দেশে এমন এক অরাজকতা চলছে যে প্রতিদিনকার দেশের খবর রাখতে গেলে আমার বুকে আরও বেশি কষ্ট হবে। আমি পত্রিকাগুলোতে খুঁজি আমার দেশের কোন ভালো সংবাদ আছে কীনা, সম্ভাবনাময় কোন সংবাদ আছে কীনা। একটা দুটো ভালো সংবাদ আমার কাছে বতসোয়ানার মাটিতে বসে ‘হীরা কুড়িয়ে পাওয়া’ মনে হয়। বতসোয়ানা হীরার খনির দেশ। এখানে এসে শুনলাম এদেশের এমন অনেক পাহাড় আছে হীরায় ভরপুর। হলেও হতে পারে। পুরো দেশটি পাহাড়ে পাহাড়ে ভরা। আমাদের দেশের মাটির বা পাথরের পাহাড়ের মত নয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে লোহা দ্বারা তৈরি পাহাড়। আমাদের দেশের পাহাড়গুলো কত সুন্দর সবুজে ছাওয়া এবং জীবন্ত। এদেশের পাহাড়গুলো কেমন যেন আমার কাছে নিরেট মনে হয়। এরকম কোন পাহাড়ে হীরার খনি লুকিয়ে থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়।
বিশাল আয়তনের এই দেশটির কোন পাহাড়ের মধ্যে হীরা লুকিয়ে আছে কে জানে। এই হীরার খনি পেয়ে দেশটি দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, এটি বিধাতার দান। যদি এই হীরা খনি এ অঞ্চলে আবিস্কৃত না হতো তাহলে দেশটি এখনও যে অন্ধকারাচ্ছন্নই থাকতো এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এমনও শোনা যায় বতসোয়ানার মাটি খুঁড়ে ছাঁকলে নাকি হীরার টুকরা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হীরা। কিন্তু এ পর্যন্ত আমি শুনিনি যে কেউ এক টুকরো হীরা পেয়েছে। তারপরও এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হীরাগুলোর মধ্য থেকে দু-চারটা হীরা কুড়িয়ে পাওয়ার বাসনা নিশ্চয়ই অনেকের মনের মধ্যে আছে। আমিও যে এ দলের অন্তর্ভুক্ত নই সে কথা বলব না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, ইস্ হঠাৎ করে যদি একটি হীরার টুকরা পথের কোথাও কুঁড়িয়ে পেতাম! কী এমন ক্ষতি হতো। ওদের তো অনেক হীরা। এর মধ্যে একটা ছোট্ট হীরাও কি আমার ভাগ্যে পড়তে পারে না ?
এই তো সেদিন কোন একটা পত্রিকায় যেন দেখলাম আমেরিকার কোন এক পার্কে বেড়াতে বেড়াতে এক লোক কুড়িয়ে পাওয়া হীরক খন্ডের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম হীরক পেয়ে যায়। সর্ব বৃহৎটি নাকি ৬৫ হাজার ডলার বিক্রি হয়েছে। তাহলে এটি পঞ্চাশ-ষাট হাজার ডলার নির্ঘাৎ। লোকটি এটিকে অবহেলাভরে অন্যকিছু মনে করে ফেলে চলে যেতে যেতেও কেমন করে যেন বুঝে ফেলল যে দামী কিছু। একেই বলে ভাগ্য! তার অনুসন্ধানী চোখ ঠিকই হীরাকে চিনে ফেলেছে। আর তাই ভাগ্য তাকে ফেভার করেছে। অনুসন্ধানী চোখ না থাকলে আসলে ভাগ্যও খুলে না। কিন্তু এই অনুসন্ধানী চোখ তো সবার থাকে না।
৪. কিন্তু অন্যের দেশের হীরা পাওয়ার লোভ করে কি হবে। আমাদের দেশটিও যে হীরা-জহরতে সয়লাব সে বিষয়টি আমাদের দেশের ক’জন জানেন ? আসলেই আমার বাংলাদেশ একটি সোনা-হীরা-জহরতে ভরপুর একটি দেশ। শুধু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবে আমরা তা তুলে নিতে পারছি না। বতসোয়ানার জনসংখ্যা বর্তমানে মাত্র ১৫ লক্ষ। আর আমার বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। আমার দেশের আয়তন বতসোয়ানার ৪ ভাগের ১ ভাগ। কিন্তু আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চারগুণের বেশি হলে কি হবে এদেশের মাটিতো সোনাফলা মাটি নয়। এদেশের মাটিতে কখনোই সোনা ফলবে না কারণ এখানকার মাটি অত্যন্ত রুক্ষ। এতই রুক্ষ যে রাক্ষুসে মাটি বৃষ্টির পানি এক ফোঁটাও মাটিতে জমতে দেয় না, সবটুকু একেবারে নিংড়ে শুষে নেয়। এদেশে নদী-নালা, খাল-বিল ও তেমন নেই। রুক্ষ মাটি, রুক্ষ দেশ। আমার দেশের মত কোমল-কমনীয় নয় কিছুতেই। আমার দেশের মাটি হচ্ছে সোনা ফলা মাটি। সোনার ধানে সোনার পাটে আমার দেশ প্রতিবছর ভরে ভরে যায়। এই সোনা ফলা মাটিতে আছে পনের কোটি জনশক্তি। বতসোয়ানা দেশটি আয়তনে এত বিশাল হলে কী হবে, জনসংখ্যায় কিন্তু আমাদের চেয়ে ১০০ গুণ ছোট। বিশাল আয়তনের এই দেশটিতে আছে শুধু হীরার খনি। এত বড় একটি দেশে মাত্র পনের লক্ষ জনসংখ্যা তাও আবার ২০৫০ সালে নাকি তা কমে দাঁড়াবে মাত্র ১১ লক্ষে। এইডস্ এর ভয়াবহ করাল গ্রাসে দেশটির অবস্থা সত্যিই নাজুক। তবে সরকার নানানভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এইডস্ এর প্রকোপ কমাতে। এইডস্ এর বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা, বিভিন্ন সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সরকার নিয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। নিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন, সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ইত্যাদি ব্যাপারে রেডিও টিভিতে প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর একটি বিষয় চোখে পড়ার মত, তা হচ্ছে বিনা মূল্যে কনডম সরবরাহ। বতসোয়ানার সর্বত্র যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস, থানা, বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক প্লেস, স্টেশন ইত্যাদিতে সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে বক্স স্থাপন করা আছে। বক্সের গায়ে নিজেকে এবং সঙ্গীকে যৌন নিরাপদ রাখার আবেদন সম্বলিত নানা শ্লোগান। বক্সগুলোতে কৌতুহলবশত আমি তাকাই। কি শ্লোগান লেখা আছে তা পড়ি। কিন্তু সবসময়ই বক্সগুলো খালি দেখি। আমার মনে হয় ফ্রি বিতরণ করতে গিয়ে সরকার যোগান দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এখানকার এক বাঙালি ডাক্তারের কাছে শুনলাম দোকানে, ফার্মেসীতে কনডমের খুব উচ্চ মূল্য।
৫. চারিদিক দিয়ে স্থল বেষ্টিত এই দেশটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আবহাওয়া বিরূপভাবাপন্ন। শীতের সময় তীব্র শীত এবং গরমের সময় তীব্র গরম। গরমকালে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়, শরীর থেকে সহজে ঘাম বের হয় না। এখানকার আবহাওয়ায় আর্দ্রতা একেবারেই কম। ঘাম হওয়ার সাথে সাথে তা শুকিয়ে যায়, তাই আমাদের দেশের মত একেবারে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয় না কেউ। ভিজা কাপড় রৌদ্রে না দিয়ে ঘরের এককোণে মেলে রাখলেই চলে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। আরেকটি মজার তথ্য জানলাম সেদিন। শরীর কেটে চিরে গেলে ও নাকি আবহাওয়ার কারণে তেমন রক্তপাত হয়না এবং ঘা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। মরুভূমির দেশের আবহাওয়া, হলেও হতে পারে। চীনের কোন অঞ্চলে নাকি কিছুদিন আগে হাজার বছর আগের একটি মমি পাওয়া গিয়েছে। ওখানকার তাপমাত্রা এরকম ছিল যে তাপের কারণে মমিটি শুকিয়ে শুটকি হয়ে গিয়েছিল, পচে যায় নাই। এখানে অবশ্য কোন জিনিস সহজে পচে না। শাক-সবজি, ফল-ফলাদি অনেকদিন ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। কাঁচামাল ব্যতীত প্রতিটি ভোগ্য পণ্যের গায়ে উৎপাদনের তারিখ সবসময় লেখা না থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকে। মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর আপনাআপনিই এটি নষ্ট হয়ে যায়। যেমন দুধ। একবার দুই লিটার দুধ এর একটি ক্যান কিনে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। আমার দুধ খেতে তেমন একটা ইচ্ছে করে না তাই অনেকদিন এটি ফ্রিজে পড়ে ছিল। যেদিন চোখে পড়ল বের করে দেখলাম মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ তথা Best Before use লেখা তারিখটির আর মাত্র একদিন বাকী। ঐদিন খানিকটা খেলাম। তারপরদিন দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে দেখি তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আরেকবার ফ্রিজে গরুর মাংস এবং মুরগীর মাংস কিনে রেখেছিলাম। সুপার স্টোর থেকে কিনে আনা মাংস। ছোট্ট ছোট্ট শোলার তৈরি ট্রেতে এক কেজি দেড় কেজি করে মাংস ড্রেসিং করে সাজিয়ে রাখা। ট্রের উপরিভাগে স্বচ্ছ পাতলা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। গায়ে ওজন অনুযায়ী মূল্য লেখা আছে। কিনে আনার পর রান্না করে খাওয়ার অলসতায় অনেকদিন ফ্রিজে পড়েছিল। একদিন বের করে দেখি মাংসগুলো কেমন কালো হয়ে গিয়েছে এবং পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে এভাবে পণ্যের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখার কোন গরজ বোধ করে না উৎপাদনকারীরা। ফলে আমরা জানতেও পারিনা পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে এবং এর ব্যবহারেরই শেষ সময় কখন।
যাহোক যা বলছিলাম এদেশের আবহাওয়ার কথা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে থাকার কারণেই কিনা কে জানে এদেশে আমাদের দেশের মত করে ঘর-দোর ভাসিয়ে বন্যা হয় না। বন্যা হবেই বা কিভাবে ? বন্যা হতে হলে আমাদের দেশের ন্যয় জালের মত নদীনালা থাকতে হবে তো ! এদেশে নদী-নালা তেমন একটা নেই বললেই চলে। সাউদার্ন আফ্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘকায় নদী ওকাভাঙ্গো (Okavango) এত বড় একটি দেশের সবেধন নীলমনি। এত বড় দেশটির উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে নদীটি বয়ে চলেছে। আমাদের দেশের বুক চিরে যেমন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বয়ে চলেছে এরকম কোন নদী এখানে নেই। কৃত্রিম কিছু বাঁধের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি আটকে রাখার জন্য জীর্ণশীর্ণ কয়েকটি খাল আছে। পানির সমস্যার কারণে এদেশে কৃষিকাজ হয়ে উঠে না। অবশ্য এদেশের বাসিন্দারা এতটাই কর্মবিমুখ যে ওরা কৃষিকাজের কথা ভাবতেও পারেনা। মাইলের পর মাইল জুড়ে অনাবাদী জমি পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ভুট্টার কিছু জমি দেখা যায়। বিদেশীরা এদেশে এসে সরকারের অনুমতি নিয়ে ভূট্টা চাষ করে, সবজি বাগান করে, ক্যাটেল পোস্ট করে কিন্তু এখানকার নাগরিকরা এ সমস্ত উদ্যোগ নিতে পারে না কিংবা জানে না। ওরা অল্প বেতনে চাকরি করবে কিন্তু কোন ব্যবসায়ের ধারে কাছেও যাবে না। তাইতো এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা বিদেশীদের হাতে। ভারতীয় এবং চীনারা এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের সিংহভাগ দখল করে আছে। সরকার কোন বিদেশী বিনিয়োগকারী এদেশে এসে ব্যবসায় করতে চাইলে তাকে স্বাগত জানায়। এদেশীয় লোকাল পার্টনার খুঁজে দিতে সহায়তা করে। এখানে BEDIA (Botswana Export Development & Investment Authority) নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের মূল শ্লোগান হচ্ছে-Investment made easy. BEDIA হচ্ছে Right location for right investor. ওদের ভাষায় তা-ই। বতসোয়ানায় বিনিয়োগ করার সুবিধা কি- এ মর্মে BEDIA প্রকাশিত কিছু অংশ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে-
১. ম্যানুফেকচারিং এন্টারপ্রাইজের জন্য মাত্র ১৫% কর্পোরেট ট্যাক্স;
২. বতসোয়ানায় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তাই মুনাফা, লভ্যাংশ এবং মূলধন দেশে পাঠানোর কোন ঝক্কি নেই;
৩. ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলছে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক সহাবস্থান এদেশটির মূল বৈশিষ্ট্য।
৪. বতসোয়ানা একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের দেশ যেখানে সব ধর্মের নাগরিকরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে;
৫. দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহান্সবার্গ এবং ডারবানের সাথে সড়ক যোগাযোগ আছে। তাছাড়াও প্রতিবেশি নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া এবং মোজাম্বিক এর সাথেও সড়ক পথে যোগাযোগ রয়েছে;
৬. শিল্প ইন্ডাষ্ট্রির জন্য বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহের সু-ব্যবস্থা রয়েছে;
৭. বতসোয়ানা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সহযোগী সদস্য। এজন্য এদেশে উৎপাদিত পণ্য ইউরোপীয় মার্কেটে ডিউটি এবং কোটা ফ্রি ঢোকার সুবিধা। তাছাড়া আমেরিকাতেও টেক্সটাইল পণ্যের অবাধ প্রবেশ। সাউদার্ন আফ্রিকা ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটির সক্রিয় সদস্য হওয়ায় এ অঞ্চলের ২০০ মিলিয়ন ভোক্তার একটি বিশাল বাজার ও আছে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের জন্য;
৮. এখানে অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজি হওয়ার কারণে শিক্ষিত ইংরেজি জানা জনশক্তি প্রচুর। এদেশে শিক্ষার পেছনে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ ব্যয় করা হয়। মজুরির হারও অনেক কম, মাসপ্রতি মাত্র ৮০ ডলার;
৯. এখানে সৌহার্দ্রপূর্ণ শিল্প সম্পর্ক বিরাজমান। শ্রমিক-মালিক যে কোন দ্বন্দ্ব লেবার কোর্টে ফয়সালা হয়। কোন ধরনের কোন অস্থিরতা, শ্রমিক বিক্ষোভ, হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদি নেই;
১০. বিনিয়োগকারীদের জন্য টেলিফোন সুবিধাও আকর্ষণীয়।
বিদেশীদের জন্য যে সমস্ত বিনিয়োগ সুবিধা এখানে বিরাজমান তা হলো-
১. টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস;
২. গাড়ি সংযোজন শিল্প, গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং অটোমোবাইল ইন্ডাষ্ট্রি স্থাপন;
৩. 3. Polishing of diamonds and semi precious stones;
৪. জুয়েলারী;
৫. ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্ট যেমন, বাইসাইকেল, মোটর সাইকেল, কংক্রীট মিক্সচার, গ্যাস সিলিন্ডার, ফ্যান, ডাই, প্লাস্টিক, কিচেন ইউটেনসিলস ইত্যাদি।
৬. চামড়া শিল্প;
৭. প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং;
৮. প্লাস্টিক শিল্প;
৯. সিরামিক এবং স্যানিটারী আইটেম;
১০. গ্লাস উৎপাদন জাতীয় শিল্প;
১১. ইলেক্ট্রিক এবং ইলেক্ট্রনিক পণ্য যেমন- টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি;
১২. ফার্মাসিউটিক্যাল।
চলবে...
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে সহসা=
কার্তিকের সকাল, হিমাবেশ, ঘুমে বেঘোর
নিস্তব্ধ পরিবেশ, এই কাক ডাকা ভোর,
দখিন বারান্দার পর্দা দিলে সহসা খুলে,
দিলে তো বাপু ঘুম থেকে তুলে!
এবার চা করো দেখি!
ছুটির আরাম চোখের পাতায়, আমি নিঝুম পুরীতে
ঘুমের বাজালে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন
গণপরিষদের সাথে বিএনপির সখ্যতার কারণ কি ?
বিএনপির নেতাদের সাথে গণপরিষদের নেতাদের ঘন ঘন সাক্ষাতের বিষয়টি মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে।বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে যখন বিএনপি হাই কমান্ড থেকে পটুয়াখালী -৩(দশমিনা-গলাচিপা) আসনের নেতাকর্মীদের কাছে চিঠি দেয়া হয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার?
সুকান্তর একটা কবিতা আছে, দুর্মর।
"সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়:, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।" মানুষের ভবিষ্যৎ বলা সহজ কিন্তু একটি দেশের ভবিষ্যৎ কি... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন