_এক_
ইদানিং আমি চার বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত অবন্তিকা নামের মেয়েটিকে বেশ অনুভব করি। এই যেমন এখনকার কথাই ধরি। আজ জ্যোৎস্নারাত। চাঁদের আলো যেনো ঠিকরে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। আকাশি নীল রঙের দুই তলা বিশিষ্ট বাড়িটা আকারে ছোটো হলেও সবকিছু খুব সাদামাটা ভাবে গোছানো, পরিষ্কার। নিচে একটা বড় হল রুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং, একটা গেস্ট রুম, দুটো বাথরুম, কিচেনের সামনে একটা বারান্দা, ব্যাক সাইডে কোর্ট ইয়ার্ড। উপরে বেড রুম, এটাচড বাথ এর সঙ্গে বেলকনি। এখান থেকে আমাদের ফুলের বাগান বেশ ভালো ভাবেই দেখা যায়। বাগানের সবুজ ঘাসের মাঝখানে হালকা নীলচে বর্ণের একটি ছোট্টো গোল টি টেবিল আর তিনটি চেয়ার। অবন্তিকার রুচি বোধের প্রশংসা করতেই হয়। অবন্তিকা বরাবরই এমন ছিমছাম পরিবেশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। তাই বিয়ের দুই বছরের মাথায়ই অবন্তিকার ইচ্ছানুযায়ী এখানে বাড়ি তুলে ফেলি। এই বাড়ির আনাচে কানাচে শুধু তারই বসবাস। পুরো বাড়ি একা হাতে যে কিভাবে সে সাজিয়েছিল সেটা আমার কাছে এক বিস্ময়।
-
_দুই_
এখন আমি বসে আছি দোতালার এই বেলকনিতে। আরামকেদারায় দুলতে দুলতে জোৎস্নাস্নান করছি। হাতে গরম ধোঁয়া উঠা এক মগ কফি থাকলে মন্দ হতো না। অবন্তিকা থাকলে বলা মাত্রই ওমনি ছুঁটে চলে যেতো কিচেন রুমে। আর কিছুক্ষণ পর হাতে এক মগ ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে এসে আমার পাশে বসতো। প্রথমেই অবন্তিকা তার কোমল গোলাপী ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁইয়ে দিতো কফির মগটিতে। এরপর আমি আয়েশ করে ভালোবাসা পূর্ণ কফি পান করতাম। এ যেনো অমৃত। এর মতো স্বাদ আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। অবন্তিকা তখন আমার কোলে মাথা রেখে গুনগুনিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কেমন যেনো এক ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম। হঠাৎ গান থেমে যাওয়ায় অবন্তিকার দিকে মুখ ফিরে চাইতাম। দেখতাম মেয়েটা কেমন ছোট্টো বাচ্চার মতো আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। চাঁদের আলোয় অবন্তিকাকে আরো বেশি মায়াবী লাগতো।
-
_তিন_
ঘরঘর করে রাস্তার পিঁচ ঘেষে কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল। চট্টগ্রামের নতুন মেয়র আসায় কোনো কিছু হোক আর না হোক। এই ব্যাপারটা বেশ ভালোই হয়েছে। প্রায় রাতেই দেখা যায় সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা রাতের এই দ্বি-প্রহরে রাস্তা পরিস্কার করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে যাই হোক, আমার এখন প্রবলভাবে কফি খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে। এই জায়গায় আমি প্রায়শই দ্বিধাগ্রস্থতায় ভুগি। কফি খাওয়া হবে নাকি কফি পান করা হবে সেটা নিয়ে। থাকুক সেসব কথা। রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে যেনো শীতের প্রকোপ ও বাড়ছে। গায়ে জড়ানো নীল রঙের শাল ভেদ করেও অনায়াসেই হাড় কাপিয়ে দিচ্ছে। এই শালটিও এমন এক শীতের সময় উপহার দিয়েছিলো আমায় অবন্তিকা। নীল রঙ অবন্তিকার খুব প্রিয় ছিলো। তাই প্রায় প্রতিটি জিনিসের সাথেই নীল রঙের সম্পর্ক ছিলো। এ যেনো নীলের ছড়াছড়ি। আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। বেলকনি হতে বের হলেই সরাসরি বেড রুম। টেবিল ল্যাম্পটি জ্বলে আছে। ইচ্ছা করেই বন্ধ করা হয়নি। অন্ধকারে ভয় পায় অবনী। অবনী আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমাদের বললে ভুল হবে। আমার একমাত্র মেয়ে হবে। কি সুন্দর করে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। একপাশে তার টেডি বিয়ার। আরেকপাশে তার প্রিয় ডায়েরি। এই ডায়েরিতে কি লেখা আছে সেটাও এক রহস্য। আমাকে কখনও দেখতে দেয়নি। আমিও জোর করিনি। আজ কেনো যেনো খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ডায়েরিটা নিয়ে বসে পড়লাম। প্রায় প্রতিটা পাতা জুড়েই তিনজনের ছবি স্কেচ করা। আমি জানি এরা কারা। বামপাশের প্রথমজন হলাম আমি। তার পাশে ছোট্টো হাসিখুশি মেয়েটা অবনী। আর সবশেষে অবন্তিকা। পাতা উল্টিয়ে ডায়েরির মাঝখানে চলে এলাম। আজকের তারিখ সেখানে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পষ্ট লেখা আছে।
“আজ আব্বু-আম্মুর বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু এই আম্মুটা যে কি? আজকের দিনেও সে এলোনা। আম্মু তুমি এত্তোগুলা পচাঁ!”
আমি বেশ অবাক হলাম। আট বছর বয়সের এই ছোট্টো মেয়েটা কতো কিছু বুঝে। কতো কিছুই না মনে রাখে! এই দিনটির কথা আমার নিজেরও মনে ছিলো না। আলতো করে অবনীর কপালে একটা চুমু দিয়ে উঠে পড়লাম। ঘর লক করে পেছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সামনে দিয়ে বের হলে আবার দাড়োয়ান ভাবতো এতো রাতে আমি কি কাজে বের হচ্ছি এই অবস্থায়। পড়নে সেই নীল রঙের শাল ই আছে। তাই ঠান্ডাও খুব ভালো করেই অনুভব করছি। পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে সিগারেট জ্বলালাম। বাসায় থাকলে এতোক্ষণে তুলকালাম কান্ড করে ফেলতো অবনী। এসব পছন্দ করেনা সে। একদম অবন্তিকার মতো হয়েছে মেয়েটা।
-
_চার_
ছাত্রজীবন পুরোটুকু কোনো প্রেমজনিত সম্পর্ক ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। এজন্য বন্ধু মহলেও কম কথা শুনতে হয়নি। ভেবেছিলাম বিয়ের পরেই প্রেম করবো। তার কাছে সব ভালোবাসা উজার করে দিবো। যে হবে আমার প্রথম প্রেম। একজন সাদাসিধে বাঙ্গালী কন্যাকেই সবসময় মনের গহীনে কল্পনা করে এসেছিলাম। সারাদিনের অফিস শেষে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরব সে আমার হাত থেকে অফিসের ফাইলটা নিয়ে সুন্দর করে রেখে দিবে। কিছুক্ষণ পর তড়িঘরি করে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসবে। রাতে খাবার সময় হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠবে, ‘আজ অফিসে অনেক কাজ ছিল তাইনা?’
‘অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘তোমার মুখ ওমন শুকিয়ে গেছে কেন?’
‘দুপুরে ঠিকমতো সব খেয়েছো?’
‘রাস্তায় আসার সময় কি প্রচুর জ্যাম ছিল?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি মুগ্ধ হয়ে তার চিন্তিত মুখ দেখবো। হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে উঠবো, ‘তুমি খেয়েছো তো?’
সে লাজুক কন্ঠে বলে উঠবে, ‘তুমি খাওয়ার পর খাব।’
আমি আমার প্লেটের মাখানো ভাত থেকে তাকে দুই এক লোকমা খাইয়ে দেবো। সত্যি বলতে এর চেয়েও বেশি ভালবাসা পেয়েছিলাম আমি অবন্তিকা থেকে। সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই অবন্তিকা কেমন যেনো বদলে যেতে শুরু করলো। অকারণেই রেগে যাওয়া। না চাইতেও ঝগড়া লেগে যাওয়া। না জানিয়ে বাহিরে চলে যায়। অনেক ভেবেও এর কোনো সুরাহা করতে পারিনি আমি।
-
_পাঁচ_
এর মধ্যে অফিসের কাজে হুট করেই ঢাকায় চলে যেতে হলো আমায়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় অবন্তিকাকে না জানিয়েই চট্টগ্রামে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিবো ওকে। কিন্তু সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই যে বিশাল বড় সারপ্রাইজ পাবো কল্পনা করিনি। আমার কাছে আগে থেকেই এক্সট্রা চাবি থাকায় নক না করেই বাসায় ঢুকে পড়ি। বাহির থেকে তালা দেওয়া না থাকায় বুঝলাম সবাই ঘরেই আছে। সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও অবন্তিকাকে পেলাম না। সেসময় অবনী আর কতোটুকু বা হবে। মাত্র পাঁচ বছরের এক শিশু। বেডরুমে ঘুমোচ্ছিলো ও। হঠাৎই খেয়াল হলো গেস্ট রুম চেক করা হয়নি। সেখানে গিয়েই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটল। অবন্তিকা আর একজন পুরুষকে একই বিছানায় ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না। বাগান হতে দু'হাত খানেক লোহার রড নিয়ে ঢুকে পড়লাম ঘরে। ওরা ওদের লীলাখেলায় এতোই ব্যস্ত ছিলো যে আমার উপস্থিতি টের পায়নি। যতক্ষণে বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে রডের আঘাতে দুজনই অজ্ঞ্যান হয়ে পড়েছে। মাথা ঠিক ছিলো না আমার। মাথার মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। দুজনকে বেঁধে রেখে অবনীকে আমার কলিগের বাসায় রেখে আসি। অবন্তিকার সাথে থাকা ছেলেটার মুখে গামটেপ, হাত-পাঁ পিছু মোড়া করে বেঁধে বাথটাবে ফেলে দিয়ে রাখলাম। জ্ঞ্যান ফেরার সাথে সাথেই পৈশাচিক হাঁসি হেসে সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিলাম। এর আগে ছেলেটির ভয়ার্ত মিশ্রিত চোখ দেখে প্রচন্ড রকমের ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো শরীর হতে মাংস গলে গেলো। অবশিষ্ট রইল শুধু কিছু হাড়। অবন্তিকার সাথে এমন কিছুই করতে পারলাম না আমি। কারণ অবন্তিকাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সেই ভালোবাসার মর্যাদাও তো রাখেনি সে। তাই তাকেও শাস্তি পেতে হবে। অজ্ঞ্যান অবস্থায়ই গলার স্পাইনাল কর্ড ভেঙ্গে দেই। ব্যস, খেল খতম! পারিনি অবন্তিকাকে কষ্ট দিয়ে মারতে। তাই এই ব্যবস্থা। এরপর সময়ের ব্যাবধানে সব ধামাচাপা পড়ে যায়।
শীতের প্রকোপ আরো বেড়েছে সম্ভবত। নাহলে এতো ঠান্ডা অনুভব হতো না। সিগারেটটা যে কখন শেষ হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি। এখন আমি দাড়িয়ে আছি অবন্তিকার কবরের সামনে। প্রতি বছরই এই দিনটায় আমি এখানে আসি। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর সাথে সাথে অবন্তিকার মৃত্যুদিবস ও। বুকের বাম পাশে কেমন যেনো চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। তুমি চাইলেই আমাদের এই ছোট্টো সংসারটা অনেক সুখের হতে পারতো।
-
_ছয়_
টপ টপ করে ডায়েরির পাতায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অবনীর। এতোক্ষণ বাবার ডায়েরি পড়ছিলো সে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ থাকে সবার। অবনীও তার উর্ধে নয়। সুযোগ পেয়েই বাবার ডায়েরিটা পড়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। অবনী পাশের রুমে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘অনেক ভালোবাসি তোমায় বাবা। অনেক।’
পৃথিবী যেনো থমকে দাড়িয়েছে। অদ্ভুতভাবে বাবা-মেয়ে দুজন একসাথে কাঁদছে। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে কান্নার খুবই প্রয়োজন হয়। মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা শত কষ্ট কান্নার স্রোতে ভেসে চলে যায় নাম না জানা অজানা গন্তব্যে। সেটাই বোধহয় প্রকৃতি মাঝে মাঝে আপনা-আপনি করে দেয়। যেমনটা এখন হচ্ছে।
--- ০ ---
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৯:২১