ঝাপসা জলে আঁকা স্মৃতি
অশ্রু হাসান
যখন ক্লাস থ্রি তে পড়তাম আমার ক্লাস শুরু হতো সকাল ৭.৩০ টায়। তাই ক্লাস শুরু হওয়ার অন্তত মিনিট দশেক আগে যেন স্কুলে পৌছাতে পারি এই দিকটা আমার বাবা খুব খেয়াল রাখতো। আবার ১২ টা বাজে স্কুল ছুটির আগে আগেই বাবা এসে দাড়িয়ে থাকতো, একা বাসায় ফিরতে দেয়ার কথা উনি কল্পনাও করতে পারতেন না। বড় দু’বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরে আমার বাবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিলাম আমি। ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রবল জ্বরে আমি মৃত্যুপথযাত্রী প্রায়, আমার জ্বরের কথা উনি যখন প্রথম আঁচ করতে পারলো তখনই চারিদিক হইচই ফেলিয়ে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো বাবা, সে যাত্রায় আল্লাহ্র অশেষ রহমত ও বাবার নিজের ঘুম হারাম করা সেবা যত্নের কল্যাণে সুস্থ্য হয়ে উঠেছিলাম। বাবার এমন ভালোবাসা ও আকুলতা আমার মা আদিখ্যেতা ভাবতো যদিও তবে পাশাপাশি মায়ের মনে ভয় ঘুরে বেড়াতো যে আমি এই ভালোবাসা খুব বেশীদিন কি আর পাবো?
বাবার পাশে ঘুমানো ছাড়া ঘুম আসলে কি জিনিস কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না যে আমি সে আমাকে ক্লাস সিক্সে উঠার পর আলাদা ঘরে ঘুমাতে হতো মায়ের বকাবকি শুনে। তখন একদিন মা’কে বাবা অনুযোগের সুরে বলেছিল, “নাফিসা’টা কেন যে বড় হয়ে গেলো, রাতে ঘুমাতে পারি না আমার মা’টাকে ছাড়া, তুমি ওকে আগের সেই আমার ছোট্ট মা হয়ে যেতে বলো না শাহানা, প্লিজ!” আমিও যে তখন আমার বুড়ো ছেলেটাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না আফসোস বাবাকে তখন বলতে পারিনি।
বাবার কিডনি জটিলতা অনেক আগে থেকেই ছিল, সময়ের পরিক্রমায় একদিন হঠাৎ তা ক্যান্সারে রূপ নিল। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। ব্যাপারটা যদিও তখন শুরুতে আমাকে কেউ বুঝতে দিচ্ছিল না। তবে বাবাকে নিয়ে মা, বড় দু’বোন সহ সব আত্মীয়-স্বজনের উৎকণ্ঠা দেখে আমিও একদিন জেনে গেলাম বাবার শরীরে ক্যান্সারের সরব উপস্থিতির কথা। হসপিটালে ভর্তি হওয়ার পর একটা সময় টানা পাঁচ দিন অচেতন হয়ে ছিল বাবা, কোন সাড়া দিতে পারছিল না কাউকে উনি, ঠিক পরের দিন যখন ওনার জ্ঞান ফিরল তখন তিনি দেখলেন আমি ওনার হাত ধরে বসে আছি আর বিড়বিড় করে সূরা পড়ছি। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমাকে, “আমাকে যদি আজরাইল নিয়ে যেত, তখন তুই কি করতি রে?” আমি বলেছিলাম তখন, “যদি তোমাকে আজরাইল নিয়ে যেত তখন যেন তোমার সাথে আমিও যেতে পারি তাই তো তোমার হাত ধরে বসে আছি”। কথাটা বলার পরে বাবাকে ধরে রাখা ওনার হাত আর আমার হাত ভাসিয়ে দিয়েছিলাম কান্নাকাটি করে। এর বেশ কয়েকদিন বাদে আমার বুড়ো ছেলেটা ক্যান্সারের সাথে জীবন-মরণ যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়ে মর্তলোক ত্যাগ করে ঊর্ধ্বলোকে চলে গেলো আমাকে ফেলেই।
আমার বাবা, আমার বুড়ো ছেলেটা তার এখনকার অনেক বড় হয়ে যাওয়া মা’কে হয়তো বাস্তবিকভাবে দেখতে পাচ্ছে না, তবে আমার শিশুসুলভ বিশ্বাস তিনি আমাকে এই তিরিশোর্ধ সংসারী নারী প্রতিমূর্তিকে ঠিকই দেখতে পান। বাবার দেয়া ভালোবাসার প্রতিদান অসম্ভব তা আমি জানি কিন্তু ওনার হাত ধরে বসা থাকা, তেলে জবজব থাকা মাথাভর্তি পাকা চুল আঁচড়ে দিতে পারতাম যদি এখনো তাহলে দু’দণ্ড শান্তির হিমেল বাতাস অনুভব করতে পারতাম। সংসার যুদ্ধে দাপিয়ে বেড়ানো সময়ে কখনো কোন কিশোরী মেয়েকে তার বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া দেখলে বাবার কথা মনে পড়ে শুধু, তখন যেন বাবার রেখে যাওয়া অগণিত স্মৃতি ঝাপসা চোখের জলে আমার স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:০৩