ছোটবেলা আমার খুব অপছন্দের একটা কাজ করতে হত বাধ্য হয়ে--দুপুরে ঘুম। ওই দুপুর সময়টা, যখন পুরা শহরটা ঝিমিয়ে পড়তো, ঝিকাতলার ছোট্ট গলিটায় ফেরিওয়ালাদের আনা গোনা কমে আসত, কাকেরা ক্লান্ত স্বরে ডাকত থেকে থেকে... ওই দুপুর বেলায় মনে হতো সারা পৃথিবী আমাকে ডাকছে। বারান্দার হাড়ি পাতিলগুলোতে রাতের খাবারের আয়োজন করা খুব প্রয়োজনীয় মনে হতো, অদৃশ্য কোন মানবীকে 'ভাবী, আসেন চা খাবেন?' বলে আপ্যায়ন করতে মন চাইত, কিংবা নির্জন, ঘুমন্ত বাসায় আফিয়ার সাথে লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছা করতো।
ভিলেইন হয়ে দৃশ্যপটে মায়ের আবির্ভাব। দু'টো থেকে চারটা বিছানায় চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতেই হবে, কোন মাফ নেই। কি যে ছটফট লাগত ভিতরে ভিতরে! একটু করে চোখ খুলে দেয়ালের কালো কাটার সাদা ঘড়িটা দেখতাম। ইচ্ছা হতো নিজে গিয়ে ঘড়ির কাটা এগিয়ে দিয়ে আসি।
তখন মনে হত, উফফ, আমি যদি বড় হতাম! কত্ত কিছু করতে পারতাম!
বালিকা আমি ভেবেছিলাম, বড় হলে মানুষের স্বাধীনতা বাড়ে। কি বড় ভুল!
বড় হওয়ার সাথে সাথে স্বাধীনতা একটু একটু করে কমছে। আমার আমিটা আর আমার নই। একটু একটু বড় হচ্ছি আর আমার আমির মালিকানা চলে যাচ্ছে অনেক শরীকের হাতে। ভালবাসার বিনিময়ে 'আমি'র বন্টন সম্পন্ন হচ্ছে দিন দিন, নিখুঁত ভাবে।
সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাওনাদারের পাওনা মিটিয়ে যাই। মা-বাবা-ভাই-বোন-খুব কাছের বন্ধু-মোটামোটি বন্ধু-একটু দূরের বন্ধু-সহপাঠি-টিচার-ছাত্রী... এমনকি ওই আল্লাহটাও... একটা বিশাল বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আমি। কেন্দ্রের চারিদিকে দাঁড়িয়ে পাওয়ানাদার। যত বড় শরীক, তত কাছে দাঁড়িয়ে। আমি বিলিয়ে যাই নিজেকে।
আমার আমি তো আমার নই, নিজেই নি:স্ব আমি। বারো শরীকের সাক্ষর জোগারের ক্ষমতা আমার নেই। খুব বেশি চাওয়া প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিব না তো কি করব? নি:স্বের উপর রাগতে নেই...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ ভোর ৫:১৩