হে বিরাট নদী
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।
(চঞ্চলা, রবিঠাকুর)
ভারতের উত্তর –পূর্বাঞ্চলীয় মনিপুর রাজ্যের বরাক ও টুইভাই নদীর সংযোগস্থল টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করছে ভারত। ২০১২ সালের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে দেশটি। ১ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীনীতি লঙ্ঘন করে এ বাঁধ নির্মিত হলে বিপাকে পড়বে বাংলাদেশ।
ভারত বরাক নদীর পানি নিয়ন্ত্রন করার কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়বে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ মেঘনা অববাহিকা। মরুকরণ প্রক্রিয়ার শিকার হবে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের ৮ টি জেলা। ক্ষতিগ্রস্থ হবে প্রায় ২ কোটি মানুষ। বাঁধের ফলে একদিকে প্রয়োজনের সময় পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে না, অন্যদিকে অসময়ে বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ার কারণে অকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এছাড়া প্লাবন পদ্মতি, ভূমিক্ষয়, ভূ-প্রকৃতির ওপর প্রভাব, ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ুর ওপর এ বাঁধ বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
টিপাইমুখ বাঁধের অবস্থান-
বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসিদ সীমান্ত থেকে ১শ কিলোমিটার দূরে ভারতের মনিপুরের চারুচাঁদপুর জেল। এই জেলারই একটি স্থান টিপাইমুখ। এখানে মিলিত হয়েছে বরাক ও টুইভাই নদী। এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলের ৫শ মিটার ভাটিতে বরাক নদীতে নির্মিত হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাঁধটির উচ্চতা হবে ১শ ৬১ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩শ ৯০ মিটার। ২৮৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বাঁধের জলাধারে মোট পানির ধারণ ক্ষমতা হবে ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। ১৯৫৫ সালে মনিপুরের ময়নাধর, ১৯৬৪ সালে নারায়ণধর, এরপর ভুবনধরে এ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পরে ১৯৮০ সালে স্থান নির্ধারণ করা হয় টিপাইমুখে। প্রথমে বাঁধটি ব্রম্মপুত্র ফাড কন্ট্রোল বোর্ড- বিএফসিবি’র আওতায় ছিল। ১৯৮৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর বাঁধটিকে টিপাইমুখ পাওয়ার প্রজেক্টেও আওতায় নেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে বাঁধটিকে দেয়া হয় নর্থ ইস্টার্ন ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন নেপকোর হাতে। ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং মনিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে বাঁধের উজান এবং ভাটি অঞ্চলের মনিপুরবাসীর বিরোধিতার কারণে বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারে নি ভারত। ২০০৮ সালের ২৮ জুলাই মনিপুর রাজ্য সরকার আইন পাস করে টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত মনবাহাদুর রোডের প্রতি সাত কিলোমিটার অন্তর সামরিক পোস্ট স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের নদীর উপর প্রভাব-
বরাক নদীতে বাঁধেল ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের নদীর পানিপ্রবাহ। হুমকির মুখে পড়বে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ মেঘনা নদীর অববাহিকা। কারণ, সিলেটের অমলসিদ পয়েন্ট থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বরাক নদী। একটি ভাগের নাম হলো সুরমা, অন্যটি কুশিয়ারা। ৩শ ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সুরমা ও ১শ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কুশিয়ারা নদী হবিগঞ্জের মারকুলির কাছে প্রথমে কালনী নামে, পরে মেঘনা নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে। বরাকে ভারত বাঁধ নির্মাণ করলে বাংলাদেশের মেঘনা অববাহিকায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যাবে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপি’র এক গবেষণা অনুযায়ী (২০০৫) টিপাইমুখ বাঁধ হলে বরাক নদী থেকে অমলসিদ পয়েন্টে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদীর দিকে পানিপ্রবাহ জুন মাসে ১০%, জুলাই মাসে ২৩%, আগস্ট মাসে ১৬% এবং সেপ্টেম্বও মাসে ১৫% কমে যাবে। অন্যদিকে এই বাঁধের ফলে কুশিয়ারা নদীর পানির উচ্চতা অমলসিদ পয়েন্টে জুলাই মাসের দিকে গড়ে ১ মিটারের বেশী, ফেঞ্চুগঞ্জে ০.২৫ মিটার, শেরপুর পয়েন্টে ০.১৫ মিটার ও মারকুলি পয়েন্টে ০.১ মিটার করে নীচে নেমে যাবে। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা থেকে পানি প্রত্যাহারের হার শুকনো মওসুম আগস্ট মাসে ১৮% এবং সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে দাঁড়াবে ১৭ শতাংশ।
হুমকির মুখে প্লাবনভূমি-
টিপাইমুখ বাঁধের কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্লাবনভূমি। স্বাভাবিক মওসুমে প্লাবনভূমিতে পানি পাওয়া যাবে না। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপি’র তথ্যমতে, বাঁধের কারণে প্লাবনভূমির পরিমাণ সিলেট এলাকার শতকরা ২৬ ভাগ অর্থাৎ ৩০ হাজার ১শ ২৩ হেক্টর এবং মৌলভীবাজার এলাকার শতকরা ১১ভাগ অর্থাৎ ৫ হাজার ২শ ২০ হেক্টর কমে যাবে। আর বাঁধের কারণে পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্লাবনভূমির শতকারা ৭১ ভাগ এলাকা স্বাভাবিক মওসুমে জলমগ্ন হবে না। এয়াড়া কুশিয়ারা নদীর ডান পাশে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে প্লাবনভূমি ওয়েছে তার পুরোটাই জলহীন হয়ে পড়বে। উজানে বাঁধ নির্মাণ করার কারণে প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরন, মওসুম এবং পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী তাদের উৎসস্থল থেকে মেঘনায় পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে পাঁচটি প্লবনভূীম অতিক্রম করেছে, বাঁধের কারণে তার সবকটিতেই প্রভাব পড়বে। ফলে সুরমা, কুশিয়ারা ও১মেঘনার অববাহিকার বিশাল এলাকার চাষাবাদের জমিগুলো উর্বরাশক্তি হারাবে। সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুষ্ক হওয়ার ফলে কমপক্ষে ৭ টি জেলা- সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাম্মনবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে।
ভূমিক্ষয় ও ভূমির প্রকৃতির ওপর প্রভাব-
সাধারণত কোনো বাঁধের নীচ থেকে ভূমিক্ষয় শুরু হয়। টিপাইমুখ বাঁধের নীচ থেকেই ভূমিক্ষয় শুরু হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভূমিক্ষয় বাঁধ থেকে প্রায় ২শ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভূমিক্ষয়ের কারণে ভাটি অঞ্চলের নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাবে। এর ফলে এমনিতেই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হবে। এমনকি ভরা মওসুমে অর্থাৎ বর্ষাকালে পলি জমার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বেশ কিছু শাখা নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আবার একদিকে কিছু অঞ্চলে একেবারেই পলি পড়বে না। অন্যদিকে কিছু কিছু অঞ্চলে পলির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বর্ষাকালে নদীর পানি ধারণ করতে না পেরে অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পড়বে গ্রামাঞ্চল ও আবাদি জমি।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদীর পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়াতে মেঘনা অববাহিকায় লবণাক্ততা অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাবে। কারণ, সমউচ্চতার সমুদ্রের পানির স্তরের দিকে লবণাক্ত পানি প্রবাহিত হয়। এরই সঙ্গে নদীর স্বাভাবিক পানির পরিমাণ কমে গেলে লবণাক্ত পানি আরও বেশী এলাকাকে লবণাক্ত করে ফেলে। সাধারণত দিনে দু’বার জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা পানি নদীগুলোতে প্রবেশ করে। আবার ভাটার সময় নদীর পানি ঠেলে নোনা পানি সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়। বাঁধের কারণে নদীর পানি তলানিতে থাকলে জোয়ারের সময় যে নোনা পানি নদীতে উঠে আসবে নদীর পানি তা আর ঠেলে সমুদ্রে ফেলতে পারবে না। সমুদ্রের নোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে কৃষি জমিতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করবে। জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. খান বলেন, সমুদ্রের নোনা পানি নদীতে উঠে আসলে একই সঙ্গে পরিবেশ, কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, সমুদ্রের নোনা পানি উঠে আসার ১০ বছর পর থেকে এর প্রতিক্রিয়া যাবে। আর ৫০ বছর পরে দেশের প্রায় ষাট ভাগ অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাবে। কারণ শুধু বরাক নদীতেই নয় অন্য সব নদীতেই বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করে ভারত আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে পানির প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন করেছে।
এদিকে নদীনালায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির অভাবে বৃহত্তর সিলেটসহ আশপাশের এলাকায় নলকূপ বা গভীর নলকূপেও পানি সঙ্কট দেখো দিতে পারে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গড়ে প্রতি বছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ৪ থেকে পাঁচ মিটার নীচে নেমে যায়। বৃষ্টিপাত ও বন্যার ফলে এই স্তর আবার উপরে চলে আসে। দেশের পূর্বাঞ্চলের জলধারাগুলো পানিতে ভরপুর না থাকলে এই সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে-
পৃথিবীর ৬টি অতিভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। গত ২ শ বছরে টিপাইমুখ এলাকার আশপাশের ২শ কিলোমিটারে রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে শতাধিকবার। আর গত ১শ বছরে টিপাইমুখের ১শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১৭ বার। ১৮৯৭ সালে ঘটে যাওয়া গ্রেট আসাম ভূমিকম্পের ইতিহাস এখনো সেই ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেখানে বাঁধের কারণে ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক বেড়ে যাবে।
সূত্র:- বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন অবলম্বনে।