আকর্ষণীয় পোশাক পড়া মেয়েটা ৮ নাম্বার বাসে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে উঠলো। বাসে কিলবিল করা অসংখ্য মানুষের মাঝে একটু জায়গা করে দাঁড়ালো সে। তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন yoo yoo টাইপের কলেজ ছাত্র। ইচ্ছা করে করে গায়ে হেলে পড়ছে ওরা কখনো, আবার মাঝে মাঝেই নানারকম উল্টা পাল্টা কথা বলছে। সব বুঝতে পেরেও মেয়েটার কিছুই বলার উপায় নেই ততোক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না ছেলে দুটো মেয়েটাকে সরাসরি কিছু বলছে।
একটা পর্যায়ে দুই বন্ধুর মধ্যে একজন মেয়েটার কাঁধে টোকা দিলো,
- এই যে আপু শুনছেন?
মেয়েটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো এবং বলল,
- কি বলতে চাও?
- মানে, আমার বন্ধু না আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে! আপনি একটা চরম জিনিস!
মেয়েটা হকচকিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ছেলেগুলোর আস্পর্ধা। রাগান্বিত হয়ে বলল,
- তোমরা কি জানো, আমার ছোট ভাই তোমাদের সমান? দুই গালে চারটা থাপ্পড় দিবো। বেয়াদব কোথাকার!
ভাবছেন, আমি কি নিয়ে লিখা শুরু করলাম হঠাৎ! আসলে হঠাৎ নয়, অনেকদিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে লিখবো বলে ভাবছিলাম। আপনারা নিশ্চয়ই একটি নামকরা শ্যাম্পুর ঐ বিজ্ঞাপনটি দেখেছেন! বরফিখ্যাত অভিনেত্রী ইলিয়েনা ডি ক্রুজের সেই বিজ্ঞাপনটি! যেখানে ডি ক্রুজ বলেছিলেন-
আমি জানি আপনি আমাকে ফলো করছেন, আমার শর্ট, মেকআপ। আর ইম্প্রেশন জমানোর মতো সব কিছু! ইভেন ড্যান্ড্রাফ; এরপর আরও অনেক কথা বলে বিজ্ঞাপনের শেষ মেসেজটা এরকম- যখন কিছুই লুকানোর থাকেনা তখন অনেক কিছুই থাকে দুনিয়াকে দেখাবার! এখানে ২টা প্রশ্ন আসে-
১. নারীর মধ্যে কি কিছুই লুকানোর নেই!
২. দুনিয়াকে নিজের সব কিছু দেখানোর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু!
একটা বিজ্ঞাপন একটা সমাজের অনেক বাস্তব অবস্থার প্রতিচ্ছবি। এই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করছে বাংলাদেশে, মূল্য সংযোজন করসহ পণ্য কিনছে, কিনবে এদেশের জনগণ। ভিনদেশী মডেল দিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক প্রথা এবং নৈতিকতা বিরুদ্ধ কথা দিয়ে সাজানো এই বিজ্ঞাপনের এমন ঢালাও প্রচারণা সচেতন ভোক্তা মহলে উদ্বেগের কারন বটে। বিজ্ঞাপনের শেষের কিছু কথা বেশ ভয়াবহ। যখন কিছুই লুকাবার থাকেনা, তখন নাকি অনেক কিছুই থাকে দুনিয়াকে দেখাবার!
প্রাচীনকাল থেকেই একটা প্রবাদ খুব জনপ্রিয়- লজ্জাই নারীর ভূষণ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়- লজ্জা মানুষের সেই অনুভূতির নাম যার কারণে ব্যক্তি নিজেকে উপস্থাপন করার সময় দ্বিধায় ভোগে। এই উপস্থাপনা হতে পারে ব্যক্তিত্বের, বাহ্যিকতার কিংবা চারিত্রিক যে কোন বৈশিষ্ট্যের। আমাদের সমাজের বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ দ্বারা মূলত নারীর শালীনতাই উদ্দেশ্য।
আসলে নারী যখন কিছুই না লুকানোর সংকল্প করে, তাতে নারীর লাভের বিষয়টা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। নারীর লাভ একটাই আর সেটা হল সে সকলের প্রচুর প্রশংসা কুড়াতে পারে। যদিও এই প্রশংসা নারীর নিজস্ব কোন করমের ফল নয়, সৃষ্টিকর্তার প্রাপ্য। সুন্দর অবয়ব আর গঠণ দিয়ে যিনি নারীকে করেছেন অপার সুষমার আঁধার।
লাভের পাল্লায় থেকে যায় আরেক শ্রেণীর নাম। তারা হলেন- পুঁজিবাদী ব্যবসায়িগণ। ব্যবসা সফল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারীকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, আর সেই পণ্য নারীরাই কিনছেন। হাজার টাকার মেকআপ গায়ে মেখে পুরুষ সমাজ তথা আপামর জনতাকেই প্রদরশন করছেন নারীরা, এতে নারীর কোন লাভ আসলে হয়না।
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি পেইজ দেখলাম। যার পরিচালকদের কাজ একটাই। বাসে, রিক্সায়, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায়ই যতো সুন্দর নারী আছে, গোপনে তাদের শরীরের বিশেষ কিছু অঙ্গের ছবি তোলা। স্বাভাবিক চলাফেরারত বাংলাদেশের নারী সমাজই যার মূল শিকার। একবার ভাবুন তো, আপনার অঙ্গ প্রতঙ্গ কেউ মোবাইলে বা কম্পিউটারে জুম করে দেখছে আর মজা লুটছে, কেমন লাগে তখন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিথজশা শিক্ষক এবং লেখক একবার লিখেছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের দেখলে চুইংগামের মতো চিবাতে ইচ্ছে করে!
একজন সুশীল এবং শিক্ষিত শিক্ষক যদি এমন ধারণা পোষণ করতে পারেন, তখন একজন রিক্সাওয়ালা কিংবা মেথরের ইচ্ছা কেমন হতে পারে তা ভাবতেই ভয় লাগে।
নারী যদি শালীন এবং বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি মোহহীন হয় তাতে ক্ষতি হয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের। কারণ, তখন তারা মানুষকে দেখানোর জন্য গাদা গাদা লিপস্টিক, নেল পোলিশ, ফেসপাউডার কিনবে না। না কিনলে ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করতে পারবেনা, শো বিজে বিজ্ঞাপন বানানো হবেনা, মডেল কন্যারা পড়ে যাবে মহাবিপদে।
সামাজিক ভারসাম্য ও নৈতিকতা বোধের মূল আবেদন হচ্ছে – নারী শালীনতার মধ্যে থাকুক। যাতে কেউ তাকে পথে ঘাটে কটু দৃষ্টিতে না দেখে, বাজে কথা না বলে! ছোট ভাইয়ের বয়সী ছেলেরা যাতে মাল বলে অপমানিত না করে, স্বামীও যদি নারীর সুষমা ভোগ করে তাহলেও তাকে আগে মোহরানা আদায় করতে হবে, কারণ নারী মায়ের জাতি! নারী এতো সস্তা নয় যে, যে খুশী সে চুইংগামের মতো চিবোতে চাইলেও চিবোতে পারবে।
একটি বিজ্ঞাপন অনেক কিছু বলে। ঘরের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য থেকে শুরু করে প্রবীণ সদস্য সবার সামনেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠা নারী প্রতিকৃতি এবং বিজ্ঞাপনে তাঁর ভূমিকা সমগ্র নারীজাতির অবস্থানকেই তুলে ধরে।
যেসব নারী মাত্রাহীন অশ্লীভাবে চলেন, কিছুই না লুকানোয় বিশ্বাসী, তাদের কাজকর্ম আর ধ্যান ধারণার ভুক্তভোগী হয় আপামর নারী সমাজ। মানুষের সভ্যতার সূচনা কিন্তু পোশাক পরার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। সেই সভ্যতার বিপরীতে চলার জন্য জাতি হিসেবে আমাদেরকে অধঃপতিত জাতিতে পরিণত করতে পারে খুব সহজেই। সবচেয়ে অবাক বিষয় এটাই যে, এটি একটি খুশকি নাশক শ্যাম্পু!
মাথা যদি না ঢাকা হয়, মানে চুল যদি না লুকানো হয়, খুশকির সম্ভাবনা আরও অনেকগুন বেড়ে যায়। যখন বাতাসে ধুলাবালি ওড়ার সময় চলে প্রকৃতিতে, চরম বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ফ্যাশন পাতায় ও পরামরশ দেওয়া হয় মাথায় ছোট হেডস্কার্ফ প্যাঁচানোর জন্য। কিন্তু দুনিয়াকে সব কিছু দেখাবার এই ঢালাও প্রচারে চুলের জন্য ক্ষতিকর এমন বাণী, একটি খুশকি নাশক শ্যাম্পুর জন্য শোভা পায় না।
এমন একটা সময় ছিল যখন নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য বেগম রোকেয়া কিংবা নবাব ফয়জুন্নেসার মতো মহীয়সী নারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সংকীর্ণমনা মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে যে ভুল ধারণার শেকড় প্রোথিত হয়েছিল তাঁর মূলোৎপাটন করতে যেয়ে পরদাটানা গাড়িতে করেও মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু কিছুই না লুকানোর শিক্ষা দেওয়া ছিল না। এই শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল নারীর বিবেক বোধকে জাগ্রত করে মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা।
যে নারী ব্যবসায়ীদের এই প্রচারের মূলধন, কোনদিন শুনিনি বিজ্ঞাপনে মডেল হবার কারণে সেই কোম্পানির মালিকানার কিছু অংশ কিংবা মুনাফার কিছু অংশ সেই নারীকে দেওয়া হবে বলে কোন পুঁজিবাদী চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। অথচ, একবার ধারণ করা এই বিজ্ঞাপনগুলো দিয়ে এই কোম্পানি চাইলে শত বছর ও ব্যবসা করতে পারছে। আর ওদিকে নারীকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের বদৌলতে নারী পাচ্ছে নাম মাত্র কিছু কাগুজে নোট। আর তার পরিবর্তে টয়লেট ক্লিনার, কাজের বুয়া কিংবা ছেলেদের অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনে ও নারীকে কতোটা হীনভাবেই না উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ এই বিজ্ঞাপণগুলোকে পুঁজি করেই সারা পৃথিবীতে বছরে ২০০০ কোটি ডলারের প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে।
কিন্তু বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে নারী সাময়িকভাবে কিছুটা আর্থিক সুবিধা পেলেও সারা জীবনের জন্যই পণ্যে পরিণত হচ্ছে আর প্রমাণিত হচ্ছে বস্তুসর্বস্ব ব্যক্তিতে। সমাজে তার অবস্থান প্রমাণিত হচ্ছে ফেয়ারনেস ক্রিম, লিপস্টিক কিংবা অন্য যে কোন বস্তু প্রিয় ব্যক্তিতে। এখানে তার কোন গঠনমূলক ভূমিকা তো নেই ই উপর্যুপরি মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়েই বের হয়ে আসছে তার মাঝে কিছুই লুকানোর মতো নেই, এমন কিছু কথা ও। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে সর্বচ্চ শিখরে ওঠার পরেও বিজ্ঞাপনে নারীর ভূমিকা বস্তুসর্বস্ব আর বাহ্যিকতা কেন্দ্রিক হওয়ায় শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারীরাও নিজ নিজ পেশায় এখনো অবদমিত হচ্ছে হর হামেশাই। বস্তি থেকে শুরু করে দশতালায় বসবাসরত নারী, কী ডাক্তার কী ইঞ্জিনিয়ার কী সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক পুলিশ, নারীর অবমাননা সব পেশায় সব জায়গায়। লাঞ্চনার হাত থেকে বাদ যায় না কোন পেশার নারীই। কেননা, পুঁজিবাদী প্রচারণায় নারীর গড়পড়তা ভূমিকা গণমাধ্যমে এখনো যৌন উদ্দীপক বস্তু হিসেবেই স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত।
যেমন সাংবাদিকতার কথাই ধরা যাক। সেদিন পত্রিকায় পড়লাম নারী সাংবাদিকতায় যৌন নির্যাতনের একটি রিপোর্ট । আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বে নারী সাংবাদিকদের দুই তৃতীয়াংশ কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল নিউজ সেফটি ইন্সটিটিউট কর্তৃক চালানো এক সমীক্ষায় এই তথ্য জানা যায়। মোট ৮৭৫জন নারী সাংবাদিকের উপর চালানো জরিপে উঠে আসে এই তথ্য। এরমধ্যে ১০০ জন নারী বলেছেন- তাদেরকে শারীরিক মানসিকভাবে নির্যাতনের সাথে সাথে পুলিশের হুমকি ও মামলা করার ভয় দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে ২৭৯ জন নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিত হুমকি ধামকি মূলক চিঠি এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।১৬০ জন নারী সাংবাদিকের ব্যক্তিগত ইমেইল আইডি হ্যাক করা হয়েছে।
মিডিয়া মানেই এখন কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে এমন একটা যায়গায় পরিণত হয়েছে। আর তাছাড়া সংবাদপত্রগুলো ও নারীকে যৌন উদ্দপনাদায়ক বস্তু হিসেবে তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মগ্ন। এইসব খবর যে পত্রিকায় যতো বেশী সুড়সুড়ি দিতে পারে সেই পত্রিকার চাহিদা তরুণদের মাঝে তত বেশী। এবং সংবাদপত্রের মতো গণমাধ্যম ও নারীদের দিয়েই ব্যবসার প্রভূত উন্নতি সাধন করছে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কোথায় কোন মডেল খোলামেলা ছবি তুলল সেই খবরটা ছবিসহ রঙিন কালিতে প্রথম পেইজে ছাপানো এখন আমাদের একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকগুলো খুললে মনেহয় যেন অশ্লীল ছবি ছাপানোর প্রতিযোগিতা চলছে। অশ্লীল লেখা বা ছবি না ছাপালে পত্রিকাগুলোর কাটতি কমে যাওয়ার ভয় থাকে। বাসে করে কোথাও যাচ্ছি, পাশের ভদ্রলোক হয়তো সেই বিনোদন পাতাই আমার সামনে মেলে ধরে পড়ছেন, আর লজ্জায় তাকাতে পারছিনা, এমন ঘটনাও জীবনে বহুবার ঘটেছে । এই লজ্জা কী সমগ্র নারীজাতির নয় ? এভাবে নারীকে হাতিয়ার বানিয়ে সংবাদপত্রগুলো নারীদের নিয়ে ব্যবসা করছে।
পুলিশ, হ্যাঁ এবার আসা যাক নারী পুলিশদের পোশাক প্রসঙ্গে। আমাদের দেশের নারীদের সাধারণ পোশাক শাড়ি যদিও। কিন্তু পুলিশে নিয়োগ পাবার সাথে সাথে সেই সাধারণ পোশাক ছাড়তে হয় নারী পুলিশদের। পোশাকের বিষয়টা কোনভাবে মানিয়ে নেওয়া গেলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কু প্রস্তাব কিংবা লালসার শিকার হতে হয় অনেক নারী পুলিশকেই। সম্প্রতি ঢাকা জেলা পুলিশের রিজার্ভ অফিসার আবুল কাশেমের ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছিলো, নারী পুলিশ সহকর্মীদের কু প্রস্তাব দেওয়াই ছিল যার কাজ। সহকর্মীকে যৌন হয়রানি কিংবা ভয় প্রদর্শন সহ অসৌজন্যমূলক আচরণ পুলিশ বিভাগে এখন সচরাচর ঘটছে। এমন একটি ক্ষমতাবহুল পদে থেকেও নারী নিজের মর্যাদায় সমাসীন হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানি গুলোতে সুন্দরী লাস্যময়ী নারীদের জয় জয়কার। অনেক ব্যাংকেই শুধুমাত্র মেয়ে অভ্যর্থনাকারী নিয়োগ দেয়া হয়। নিজেকে যতো সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় , ততোই বসের সুনজরে আসা যায় বলে অফিসে চলে নিজেকে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা।কল সেন্টার থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে নারীর কাজের মূল্যায়ন ঠিক হয় কে কতো রঙের নেইল পেইন্ট ব্যবহার করলো সেই ভিত্তিতে। এখানে মেধা কিংবা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট অনেকটাই মূল্যহীন। ক্লায়েন্টদের খুশী করতে নারীর ব্যবহার তো সিনেমা নাটকেও দেখা যায়। বাস্তবতা আর নাই না বললাম!
নারীদের জন্য শিক্ষকতাকে একটি আদর্শ পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু গড়পড়তা নারীর ভূমিকার খেসারত শিক্ষক সমাজকেও দিতে হচ্ছে। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের এক স্কুল শিক্ষিকার থানায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন শিক্ষিকা হয়েও কর্মক্ষেত্রে নারী বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার।
লেখাটি নিম্নে তুলে ধরা হল-
তারিখ: ০৪ মে ২০১১ খ্রী;
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম
বরাবর
থানা নিবার্হী কর্মকর্তা
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম
বিষয়: কর্মক্ষেত্রে হয়রানি প্রসঙ্গে।
জনাব,
নিবেদন এই যে, আমি জাহিদা পারভীন, ইকবাল পার্ক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষক (শরীরচর্চা)। গত ১৬ জুন ২০১১ইং তারিখ থেকে আমি এই বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হই, নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই আজ অবধি কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছি। যা আমাকে মানসিকভাবে প্রচন্ড পরিমান হতাশ ও জীবনের প্রতি বীতশ্রাদ্ধ করে তুলছে। উল্লেখ্য যে, নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমাকে নারী হওয়ার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ভাবে চাপের মধ্যে রাখে। এছাড়াও আমি শারীরিকভাবে ভারী মানুষ (মোটা), এ কারনে বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষকসহ অন্যান্যরা আমার অজান্তে অথবা প্রকাশ্যে অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দের সামনে এবং ছাত্রীদের নিকট নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্য করে থাকেন।
জনাব, গত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সফলতার দায়-দায়িত্ব নীতিগত ভাবে একজন শরীরচর্চা শিক্ষকের কাঁধে পড়ে, এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে যেখানে আমি নিয়োগ প্রাপ্ত, সেই দায়িত্ব আমি পালন করতে পারিনি। আমাকে এসব কাজ থেকে বিরত রেখে তাঁরা নিজস্ব খেয়াল খুশীমতো পরিচালনা করেন। এছাড়াও এ প্রতিযোগীতার যাবতীয় বাজেট এবং খরচাদি আমাকে প্রদর্শন না করিয়ে স্বাক্ষর করতে বললে আমি তা করতে অস্বীকার করায় সেখানে তাঁরা নিজেরাই স্বাক্ষর করেন এবং আমাকে বিভিন্ন কটুবাক্য শোনান।
বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে-করছে। এসব প্রশিক্ষণ গ্রহন করা প্রতিটি শিক্ষকের অবশ্যই কর্তব্য কিন্তু আমার নামে শিক্ষা অফিস থেকে চিঠি এলেও এসব প্রশিক্ষণে আমাকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় না।
নিয়োগের পর আমার বেতনের সরকারি অংশ পাওয়ার যাবতীয় কাগজপত্র দিতে ইচ্ছে করে দেরী করে, যার ফলে আমার এমপিও পেতে বেশ কয়েক মাস দেরী হয়েছে।
গত ১২জানুয়ারী২০১১ইং তারিখে লাইব্রেরীয়ান ও কম্পিউটার শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে আমি একটি আবেদন করি কিন্তু প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ (বিশেষতঃ সহ-প্রধান শিক্ষক) আমাকে চাপের মুখে এ কাজ করতে বাধ্য করছে। উল্লেখ্য যে, লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমাকে সহ-প্রধান শিক্ষক (আগে তাঁর দায়িত্বে লাইব্রেরী ছিল) কোনরুপ বইয়ের তালিকা সরবরাহ করেনি এবং তালিকা নাই বলেও জানিয়েছেন। এখনও কোন তালিকা তৈরী করা হয়নি। এরূপ অবস্থায় আমার নিকট হতে লাইব্রেরীর চাবি বুঝিয়ে না নিয়েই গত জানুয়ারী থেকে আমাকে লাইব্রেরীয়ানের সন্মানী বাবদ ১৫০/- টাকা বিদ্যালয়ের সম্মানী কর্তন করে। এবং গত ০৩ মে ২০১১ইং তারিখে প্রধান শিক্ষক আমাকে কোন রূপ লিখিত না দিয়ে এক প্রকার জোড় করেই হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয়। ফলে এ বিষয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করছি।
আমি বর্তমানে কর্মস্থলে প্রচন্ড পরিমাণ মানসিক চাপ ও হয়রানির ভেতর রয়েছি এবং আশঙ্কা করছি প্রধান শিক্ষক, সহ-প্রধান শিক্ষক ও ধর্মীয় শিক্ষক-এর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে পারি; যা আমার কর্মজীবনের হুমকি হয়ে উঠবে।
অতএব জনাব নিবেদন এই যে, একজন শিক্ষক হিসেবে এই অবস্থার সমাধান ও প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে আমাকে সন্মানজনকভাবে শিক্ষকতার সুযোগ করে দিয়ে বাধিত করবেন।
নিবেদক
জাহিদা পারভীন
সহকারি শিক্ষক (শরীরচর্চা)
ইকবালপার্ক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম
---------
স্বাধীন পেশা হিসেবে মেয়েরা ডাক্তারি পেশাকে বেছে নেয় একটি মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের আশায়। কিন্তু এই মহান পেশায় ব্রত নারীরাও সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে বিভিন্ন লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে ডক্টর শামরুখ মাহজাবিনের কথাই বলা যায়। যাকে হত্যা করা হয়েছে পারিবারিকভাবেই। কোন যৌতূক কিংবা অর্থ লালসার জন্য নয়। তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
নারী হিসেবে আইনজীবীদের বেশ প্রতিষ্ঠিত মনে হলেও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিরোধী দলীয় সাধারণ নেতাকর্মীদের দ্বারা বেধরক মারধোরের শিকার হতে দেখা গেছে নারী আইনজীবীদের। পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে এই নির্যাতনের দৃশ্য, যা সত্যিকারে শিক্ষিত অশিক্ষিত আপামর নারী সমাজের অবস্থান নিয়ে ভাবিয়ে তোলে সবাইকে।
এই যখন নারী অধিকার ও সমতার চিত্র তখন বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্যরুপে উপস্থাপন নারীকে অবমূল্যায়নের গভীর খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। আর বিশেষত যখন কোন নারী মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে নিজের মাঝে কিছুই লুকানোর নেই, দুনিয়াকে মেধা নয় নিজের সৌন্দর্য দেখিয়েই জিতে নিতে হবে, সেক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ কিংবা আগ্রহ দুটাই কমে আসে। মানসিক দাসত্বের বলি হয়ে নারী ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিছুই না লুকানোর প্রতিযোগিতায়। মেধা নয় চামড়া সর্বস্বতা আর বাহ্যিক সৌন্দর্যই যেখানে একমাত্র হাতিয়ার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু মর্যাদার চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠাই যেখানে একমাত্র ফলাফল। এইসব বিজ্ঞাপনে ফুটে উঠে নারীর সামগ্রিক অবস্থান।
লেখক : শেখ সাফওয়ানা জেরিন
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:২২