কৃষ্ণচূড়ার একটা অদ্ভুদ নেশা ধরানোর ক্ষমতা আছে।
আমার নানার বাড়ির পাশ দিয়েই যমুনার এক নাম না জানা শাখা চলে গেছে, পাড়েই ছিল মাঝারী সাইজের একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। ছোটবেলায় আমি একা একা সেই কৃষ্ণচূড়ার নিচে যেয়ে বসে থাকতাম। পাশের পাটক্ষেতের ওপর ছুটোছুটি করা বাতাসের ফিসফিস কথা বলা, নদীর ব্যাস্ত হয়ে বয়ে চলার কলকল শব্দ, ভাত শালিকের লম্ফঝম্ফগুলো আজও খুব মনে পড়ে। প্রকৃতিকে মনে হত খুব কাছের ভালোবাসার কেউ। মাটির গন্ধ মেখে উড়ে আসা উদ্ভ্রান্ত বাতাসকে বুক ভরা নিশ্বাসে শরীরের প্রত্যেক কোষে মিশিয়ে দেয়াকে আর কি দিয়েই বা তুলনা করা যায় ?
কৃষ্ণচূড়াটি এখন নেই, নদীটিও শুকিয়ে গেছে, পাটক্ষেতটা থেকে এখন ভেসে আসে টিএসপি, ইউরিয়ার আর কীটনাশকের তীব্র গন্ধ। ঢাকায় অনেকদিন ভাতশালিক দেখি না। গ্রামে আজও দেখা যায়, কিন্তু আগের চেয়ে ওরা অনেক ভীতু হয়ে গেছে। আকাশটাকে এখন বড় ধূসর মনে হয়, নীলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখন আমি ফটোশপ ব্যবহার করি। প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করতে বড় ইচ্ছে হয়, কিন্তু প্রকৃতি এখন যে আমায় ঘৃণা করে ! থুতু ছিটিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় আমায়। আমার ঘরের জানালা দিয়ে ভেসে আসা মাইক, হর্ন আর কার্বন মনোক্সাইডকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছি নর্দমার কীটের মত।
অনেকদিন রাতের বেলায় নদীর পাড়ে শুয়ে খোলা আকাশে ধুমকেতু খুঁজি না, হয়তো সেই যোগ্যতা এখন আর নেই।
হয়তো ছোটবেলার সেই সৃতিগুলো পুঁজি করে একদিন প্রকৃতিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব আমি, কিন্তু আমার সন্তান কাকে নিয়ে লিখবে? আইফোন বা মার্সিডিজের কারখানা তৈরির ইটের ভাঁটা আর ন্যাড়া বনের পাশের স'মিল অথবা ট্যানারির গন্ধে নাকে রুমাল পেঁচিয়ে শীতলক্ষ্যার পাশে দাঁড়িয়ে ওর হাতের কলম থেকে উপন্যাসের শব্দ বেরুবে তো ? প্যানাসনিকের এসি পারবে তো ওকে একটিবার বুকভরা নিঃশ্বাস এনে দিতে ?
আমার বারান্দার শীর্ণ টবে একটা অর্কিড ফুটেছে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছি......
আহ, কতদিন শিউলি ফুলের ঘ্রাণ পাই না !!!
একটা টবে শিউলি ফুলের গাছ আঁটবে তো ? নাকি আমার সন্তানকে একটা শিউলির সুবাসযুক্ত এয়ার ফ্রেশনার কিনে দেব ?
কৃষ্ণচূড়ার চারা লাগিয়ে আর কি হবে? একটা ফটোগ্রাফ কিনে ড্রয়িং রুমে লাগালেই বরং ঘরের শোভাবর্ধন হবে বোধকরি....
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২১