দেশে ফিরেই আমার বিবাহিত জীবন শুরু হোল। বউ হল ছেড়ে চলে এলো আমার কাছে, আমার বাবার বাড়ি। আমার তখন মুক্ত জীবন। চাকুরী নেই, পড়াশোনা নেই, চাকুরী খোজার চিন্তাও নেই। তখন বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন চরমে। দিনের পর দির হরতাল। ঢাকায় এসে চাকুরী খুজবো, তার উপায়ও নেই, গরজও নেই।
আমাদের বাড়ীতে বেশ অনেক খানি যায়গা ছিল। দেড় বিঘা জমির উপর ছোট একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ীর পশ্চিমে একটুখানি খালি যায়গা, সেখানে শীতকালে আমরা ব্যাডমিনটন খেলতাম, তার পর রাস্তা, পূবদিকে বেশ অনেকখানি খালি, সেখানে কয়েকটা আম গাছ, একটা পেয়ারা গাছ আর একটা বরই গাছ ছিল। তার পর ছোট একটা নদী। দক্ষিণ দিকটা পুরোটাই খালি। এল প্যাটার্নের বাড়ী। আমাদের ঘরটা ছিল দক্ষিণ পাশে। তারপর একটা ব্যালকনী। অনেক চাদনী রাতে আমরা ব্যালকনীতে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। চাদের আলোয় ছোট্ট নদীটির মৃদু ঢেউ মুক্তদানার মত চকমক করতো। বাড়ীর সীমানা জুড়ে নারকেল গাছের সারি। সেগুলোর পাতায় চাদের আলো পড়ে ঝকমক করতো। মোহগ্রস্থের মত আমরা বসে বসে দেখতাম। মাঝে মাঝে আমি তাকে গানও শুনিয়েছি। রবীন্দ্র সঙ্গীত। বধু কোন আলো লাগলো চোখে, জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে, ইত্যাদি। খেলাঘরের সাথে যখন ছিলাম ছোট বেলা, তখন গান শিখেছিলাম।
বউএর সাথে আমার খুব মিল হয়ে গেলো। আমাদের দুইজনের ভালো লাগার বিষয়গুলোর মধ্যে খুব মিল ছিল। সে কবিতা লিখতো। কবিতা পড়তো। আদর্শিক মিলও ছিল। আমরা দুইজনই ইসলাম ও বাংলাদেশকে সমভাবে ভালোবাসতাম এবং এই দুটি বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। তাকে উদ্বুদ্ধ করছি ব্লগে লেখার জন্য। বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ততা কাটলে লিখবে বলেছে।
অখন্ড অবসর। তাই, আমি মহা উদ্যোমে কৃষি কাজ শুরু করলাম। দক্ষিণ দিকের খালি যায়গাটাতে মাচা করে লাউ, কুমড়ো, কাকরোল আর পুইশাক লাগানো হলো। বউএর লাল শাক পছন্দ। তাই বেশ কিছু যায়গায় লাল শক লাগানো হলো। বাড়ীর সামনের মাটিতে প্রচুর ইটের টুকরো ছিল। অনেকখানি যায়গার মাটি সরিয়ে ভালো মাটি দেয়া হলো। তারপর সেখানে বেশকিছু ফুলগাছ লাগানো। কামিনী গাছ ছিল একটা। তার পাশে হাসনা হেনা আর শিউলি লাগালাম। বউ লাগালো অনেকগুলো বেলী আর গোলাপের চারা। দোপাটি, জিনিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা - এসবের বীজও লাগানো হয়েছিল।
নদীর পাড়ে একটুখানি নীচু জমি ছিল। বাবা জমিটি কিনে নিলেন। আমি সেখানে পুকুর কাটতে বললে বাবা রাজী হলেন। এখন বেশ সুন্দর একটা পুকুর হয়েছে। সান বাধানো ঘাট হয়েছে। আমার ছেলে মেয়েরা সেখান থেকে সাতার শিখেছে। বাড়ী গেলে আমরা সবাই সেই পুকুরে গোসল করি। সান বাধানো ঘাটে বসে মাছদের মুড়ি খেতে দিই।
কিছুদিনের মধ্যে বাড়ীর চেহারা বদলে গেলো। আমি বাইরে যাবার পর মা অনেকটাই শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। এখন তিনি সদা চঞ্চল, সদা ব্যস্ত। আমাদের সাথে এই গাছের গোড়ার মাটি ঠিক করেন, ওই গাছের পাতায় আদর করেন। বাবা বলতেন, "দেখো আমার মাকে (তার পুত্রবধূ) আনলাম আর সারা বাড়ীটা কেমন প্রাণ ফিরে পেলো।" মা টিপ্পনী কাটতেন, "তোমার মার জন্য নাকি আমার বাপের জন্য?"
চলবে ..
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:২৬