[ঈদের ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কাল থেকে নতুন একটা প্রজেক্টে খুব ব্যস্ত হয়ে যাবো। শিখার বিষয়টি নিয়ে অনেক ব্লগার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তাই তার বিষয়টি লিখে ফেলছি। আমার এ পোস্ট ফ্রন্ট পেজে যাবে না। কোন ভাগ্যবান ব্লগার, যার লেখা প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়, তিনি যদি এই পোস্টটি প্রকাশ করেন, তাহলে খুশী হবো।]
ঈদের পর ক্লাস শুরু হলে শিখা বললো, তার পড়াশোনাতে সমস্যা হচ্ছে। এক সাথে লাইব্রেরীতে পড়তে পারলে ভালো হতো। ঢাকা মেডিকেলের লাইব্রেরীতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করা যেতো। প্রায় সকলেই জোড়ায় জোড়ায় পড়তো। শিখার কথায় যে হৃদপিন্ড নেচে ওঠেনি, তা নয়; কিন্তু শিবির করার কারণেই তার ডাকে সাড়া দিতে পারিনি।
মেডিকেলে ৬-৭ মাস ছিলাম। পুরো সময়টাতেই আমারা রেল লাইনের মত সমান্তরাল চলেছি। কাছেও আসতে পারিনি আবার দূরেও সরে যাই নি।
মেডিকেলের পড়া ভালো লাগলো না। ফার্স্ট ইয়ারে এনাটমি শুধু মুখস্ত করতে হতো। এদিকে ওহীদ ছাড়া পেয়ে আমার পিছনে লাগলো। সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে শিবির নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল। রাতে হলে থাকতে পারতাম না। এর মধ্যে একটা স্কলারশীপ পেয়ে গেলাম বাইরে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। সে সময় সাবজেক্টটা ছিল নতুন। এটা নিয়ে সবার মধ্যেই একটা ক্রেজ ছিল। অবশেষে মেডিকেল ছেড়ে চলে গেলাম।
বাইরে গিয়ে অনেকবার মনে হয়েছে শিখাকে চিঠি লিখি। কিন্তু, সেই লেখা হয় নি। কি হিসাবে লিখবো? মাঝে মাঝে মনে হয়, আর যদি দশ বছর পরে জন্ম হতো। এখনকার ছেলে-মেয়েরা কত ভাগ্যবান। ই-মেইল আছে, মোবাইল আছে। সম্ভবতঃ থার্ড ইয়ারে থাকতে তার বিয়ে হয়ে যায়। তার স্বামীও ডাক্তার। আমাদের বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র।
কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হয় নি।
দেশে ফিরে তার সাথে স্বাভাবিক কারণেই আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।
বেশ কয়েক বছর আগে, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের কথা। আমি তখন ধানমন্ডি ১১ নম্বর (পুরানো ৩০ নম্বর) রোডে, সানি ডেলের পাশের বিল্ডিং এর একটা ফ্লাটে থাকতাম। কাজ করতাম প্লানিং মিনিস্ট্রিতে। কি কারনে সেদিন গাড়ী ছিল না। অফিসে যাবার জন্য সোবহানবাগ মসজিদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে রিক্সা নিবো। প্রিন্স প্লাজার পাশে যে মার্কেটটা আছে, তার সামনে শিখার সাথে দেখা।
আমরা দু'জনই থমকে দাড়ালাম। সে ঠিক পনের বছর আগের মতই রয়েছে। ঠোটের কোনে সেই রহস্যময় হাসি। চাদরের নীচ দিয়ে বেরিয়ে পড়া লম্বা চুলের মোটা বেনী। শুধু হিজাব নেই।
কুশল বিনিময়, কে কোথায় আছি, মোবাইল নম্বর লেন-দেন ইত্যাদির পর আমরা যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম। সে থাকতো সোবহানবাগে যে সরকারী অফিসার্স কলোনিটি রয়েছে সেখানে। তার পোস্টিং ছিল ঢাকা মেডিকেলে। সন্ধ্যায় বসতো ফারাবী জেনারেল হাসপাতালে, আমার বাসার থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে। কত কাছে থাকি, অথচ কত দূরত্ব..
সেদিনই দুপুরের দিকে সে ফোন করলো। কয়টা বাচ্চা, কোথায় পড়ে, বউ কি করে, দেশে এসে কি কি করেছি ইত্যাদি। দেখা গেলো তার ছোট বাচ্চাটাও মাস্টারমাইন্ডে পড়ে। কয়েক বছর হেলথ মিনিস্ট্রিতে কাজ করেছি শুনে বললো, তার স্বামীর পোস্টিং ঢাকার বাইরে, তাকে ঢাকাতে ফেরত আনার ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারি কি না।
তখনকার ডিজি হেলথ এর সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। তাকে বিষয়টি নিয়ে অনুরোধ করেছিলাম এবং তিনি রেখেছিলেন।
তখন আমার দুটো বাচ্চাই ছোট ছিল। তাদের বয়সের পার্থক্য ছিল খুব কম। দু'জনেরই অসুখ বিসুখ লেগে থাকতো। একটার জ্বর হলে অন্যটার কাশি। কিছু একটা হলেই শিখাকে ফোন করতাম। সে খুব সাহায্য করতো। ফোনে তো প্রেসক্রিপশন দিতোই, মাঝে মাঝে বাসায়ও চলে আসতো।
কিছুদিন পর বিষয়টাকে বউ আর স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম। আমিও একটা পাপবোধে ভুগছিলাম। মনের অজান্তেই শিখার সাথে বউকে তুলনা করে ফেলতাম।
বছর দেড়েকের মধ্যে নিজের ফ্লাটে চলে আসি। ততোদিনে বাচ্চারাও কিছুটা বড় হয়েছে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। শিখাকে আমার নতুন ঠিকানায় আসতে তাই আর বলা হয় নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:০৭