প্রতিরাতে নাগরিক ব্যাস্ততা সেরে যখন চারদেয়ালের এই বাক্সটায় নিজেকে হাতড়ে খূঁজে ফিরি, অজানা কোনো বিষন্নতায় খেই হারিয়ে ফেলি । হিসেব-নিকেশে বড্ড অপটু এই আমি প্রতিরাতে বেহিসেবি জৈবনিক আয়-ব্যায়ের করচা সেরে ঘুমোতে যাই । ঘুম যেন কোন এক অচিনপুরের বাসিন্দা- কেবল লূকোচুরি খেলে যায় ।
ঘুমের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে গিয়ে রাত্রির নিরবতায় ডুবে যাই ।
রোজরাতে ।
মৃত্যুর পরের জীবন কিংবা পুনর্জন্ম, কোনোটাতেই আমার বিশ্বাস নেই। থাকলে খারাপ হত না। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে আরো একবার জন্মানোর।
নাহ, এই আমি হয়ে নয়। পলাশ হয়ে। আমার বন্ধু সাদিকুর রহমান খান পলাশ!
ছোটবেলায় আমি অনেক কিছু হতে চেয়েছি। ঝালমুড়িয়ালা, ঘুড়ির দোকানদার, ক্রিকেটার, ফেলুদা,শার্লক হোমস, আরো কত কী। এখন আর সব মনে নেই। বড় হয়ে আমার মনে হল আসলে এসব কিছু না, আমি পলাশের মত হতে চাই। কিন্তু ততোদিন পলাশ হওয়ার সময়টা পেরিয়ে গেছে। আরেকবার জন্মানো ছাড়া উপায় নেই। সেই থেকে অপেক্ষার শুরু…
খুব আহামরি কোন ছেলে না পলাশ। হ্যা, দেখতে আমাদের সবার চেয়ে একটু ভালো, অনেকে বলে চশমা ছাড়া মাঝে মাঝে নাকি ওকে শাহরুখ খানের মত লাগে। কিন্তু বোম্বের ওই ছ্যামড়াকে আমার কোনদিনই ভালো লাগেনি। তাই আমাকেও ওর মত লাগবে-এই ভেবে পলাশ হতে চাওয়া? ছি!
পলাশের কথা কাজে কোন মিল নেই। ও যেকোন মানুষের চোখে দিকে তাকিয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাসে একের পর এক মিথ্যা বলে যেতে পারে। হয়তো আমাদের বিকেল পাঁচটায় কোথাও যাওয়ার কথা। পলাশ ঘুম থেকেই উঠবে পাঁচটায়। ফোন করলে দিব্যি বলে দেবে, ‘এইতো আমি কাছাকাছি চলে এসেছি, এক মিনিট একটা বিড়ি ধরা আমি চলে আসতেছি।’ সেই এক মিনিট কখনো কখনো কয়েক ঘন্টা হয়ে যায়। হেলে দুলে পলাশ আসে। এবং আসার পর ভয়ংকর সব অজুহাত দেখায়। কখনো বা ওর কোন কাল্পনিক মামা আকসিডেট করায় হাসপাতাল ঘুরে আসতে দেরি হয়, কখনো ওর কোন কাল্পনিক নানী মারা যায়। একবার কে যেন এমনই একটা মিথ্যা ধরে ফেলেছিল-
‘ওই গত সপ্তাহে না তুই বলছিলি তোর নানী মারা গেছে, তাইলে এইডা কোই থেইক্কা আইলো?’
‘আরে ওইটা ছিল আপন নানী, এইটা নানীর কাজিন!’
পলাশ এমনই। ওকে কিছুতেই আটকানো যায় না। সব প্রশ্নের উত্তর থাকে ওর কাছে।
ছেলেটার চরিত্রও খুব একটা সুবিধার না। এক সঙ্গে ৮/১০ খানা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা ওর কাছে ওয়ান-টুর ব্যাপার। আমি একবার এক মেয়ের মেসেজ ভুলে আরেক মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়ে বুঝেছি দুই নৌকায় পা রাখা কত ঝামেলার। কিন্তু পলাশের কাছে এগুলো ডালভাত। দেশে থাকতে আমি ওকে একসঙ্গে তিনটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে দেখেছি। এখন নাকি লন্ডনে বসে এট-এ-টাইম ৮/১০কে দিব্যি শিডিউল দিয়ে যাচ্ছে। কোন ওভারল্যাপ হচ্ছে না। লোকমুখে শুনা, ওর হৃদয়ের একটু অংশ ইন্ডিয়ান এক মন্ত্রীর মেয়ের কাছে, একটু নিয়েছে ফিলিপাইনের এক বিমানবালা, একটু এক বাঙ্গালি ছাত্রী.. একটু …..
আমরা শুনে বলি ..হোয়াট দ্য ফা*.. এগুলো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব?
সম্ভব।
পলাশ সব অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারে (ফিলিং অনন্ত দ্যা ভচ .. 8| ) ছাত্র জীবন থেকে ও টিউশনি করে সংসারের হাল ধরতে পারে। বিদেশে পড়তে গিয়ে পার্ট-টাইম জব করে নিজের এবং ছোট ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ চালাতে পারে। একেবারে অপরিচিত কাউকে বাঁচাতে রাত-বিরাতে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে, বন্ধুর বাবার অপারেশনের সময় রক্ত দিতে যেখানে সেখানে ছুটে যেতে পারে।
আর পারে বন্ধুদের কথা মনে হলে বিদেশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফোন দিতেও।
আমি আসলে সেই পলাশ হতে চাই। ওর মত স্টাইল করে চশমা পরা না হোক, না হোক অতগুলো মেয়ের সঙ্গে প্রেম কিংবা সব অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলার অভ্যেস। আমার পলাশের ওইটুকু দরকার যেটা দেখে আমার মা প্রায়ই বলেন, ‘একসঙ্গে এতগুলো বছর থেকেও তুই পলাশের মত হতে পারলি না কেন রে বাবা?’
মা কে খুশি করার জন্য নয়। সত্যি বলছি আমার নিজেরও এখন কেন জানি পলাশ হতে ইচ্ছে করে। এই জন্মে যদি না হয় তাহলে অন্তত পরের জন্মে …