ছেলেটি বড় হয়েছে নিদারুন অবহেলায় । ছেলেটি কোনদিন ঘাশফুল ছুঁয়ে দেখেনি, কাশফুলের ঢেউ খেলানো দুলুনি দেখেনি, প্রবাহমান নদীর খরাস্রোতে অতি আগ্রহে হাত ছোঁয়ানো হয়নি । বিকেলের নরম রোদে নীড়ে ফেরা পাখিও দেখা হয়নি ।
সমবয়সী কারো সাথে হয়নি বৈকালিক পরিভ্রমণ । রাত বয়ে গিয়ে ঘুম না পেলেও কেউ শাষণের সুরে বলেনি--ঘুমুতে যাও ।
ছেলেটি বড় হয়েছে প্রকৃতির সৎ ছেলের মত ...।
বাবা-মা বাসায় ফিরতেন আধোঘুমে চোখ জড়িয়ে আসা রাতে । সারাটা দিন তালাবদ্ধ বন্দিশিবীরে যার সময় কাটতো জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে , কিংবা পাশের বাসার ওর মত দুই হতভাগা জমজ ভাইয়ের পাগলামি দেখে । তবু ওদের খেলার সাথী ছিল । কিন্তু ছেলেটার সাথী ছিল নির্জনতা আর আঁধার । যার ছিল না ঘরের বাইরে যাবার অধিকার, কারণ মুখোশ পরা ছেলেধরারা নাকি বাইরে বস্তা নিয়ে দাড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায় ...।
ছেলেটা কে মাঝে মাঝেই ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যেত দরজার গোড়ায় । ঘুমিয়ে যেত বাবা-মার অপেক্ষা করতে করতে । কখন তার বাবা-মা আসবে , দরজার তালাটা খুলে তাকে কোলে নিবে । তাকে একটু আদর করবে, একটু স্নেহ করবে ।
সেই ছেলেটা …… আজন্ম যে একটু ভালবাসা খুঁজে ফিরেছে । একটু মিছে আবদার,আহ্লাদ করবার সুযোগ খুঁজেছে । অথচ এর জন্যে তাকে কত কাঁদতে হয়েছে বা এখন ও কাঁদতে হয় তা কি আপনি জানেন ?
যেখানে কেউ একটু ভালোবাসার লোভ দেখিয়েছে, তার কাছে ছুটে গিয়েছে। কখনও মরিচিকার দেখা পেয়েছে, কখনও বা মিথ্যে কুহেলিকা । কখনও বা ভালবাসার ডাক-ই তার অব্দি পৌঁছায়নি। সময়ের সাথে সাথে ভেতরটা এন্টার্কটিকার মত জমে গেল । এর পর আর সে পিছে তাকায়নি ।
বাবা -মা । এই দুইটি মানুষ ছাড়া তার কেউ ছিল না। যে টুকু নাম মাত্র ভালবাসার ছোঁয়া পেয়েছে তা এই দুজনার মিলিত ফসল। হয়তো তাই এক ছোট্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে একা ছেলেটা কিছুটা উদ্ভ্রান্ত, কিছুটা ছন্নছাড়া, কিছুটা বোকা ।
না না, ভুল বললাম অনেক খানি- ই বোকা ।
ছেলেটা আজ বড় হয়েছে , বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে ।
ছেলেটা এখনও একাকিত্ব নিয়ে পরে থাকে । সুখগুলো অচেনা থাক কিন্তু নতুন করে দুঃখের একচিলতে মেঘও যাতে করে তাকে স্পর্শ না করে। ওকে দেখলে কেউ বুঝবেও না ওর মাঝে কত দুঃখ লুকিয়ে । কেউ বুঝবে না ওর ঐ বোকা বোকা হাসিটার পিছনে কত কান্না জমা আছে । হঠাৎ কিছুদিন ওকে খুশি দেখেছিলাম । কেন জানি খুব ভাল লাগছিল । কারণটা জিজ্ঞাসা করে ওর সুখটা কে ছোট করতে চাইলাম না । থাকুক না কিছু জিনিস অজানাই । সেদিন ছেলেটাকে ছাদে শুয়ে জোৎস্না গিলতে দেখলাম । চাঁদের ক্ষয়ে আসা আলোয় চোখজোড়া চিকচিক করছিল । জিজ্ঞাসা করতেই বলে সামনের মাসে ওর “বেস্টেস্ট ফ্রেন্ডে”র বিয়ে ।
তাকাতেই বুঝলাম, কাঁদছিল ।
মনটা খারাপ হয়ে গেল । কাছে যেয়ে বললাম, “মেয়েটা তোকে অনেক ভালবাসত রে।”
কান্না ভেজা চোখে আমার দিকে যে দৃষ্টি দিল, পুরা বুকটা জুরে হাহাকার করে উঠল । সেই দৃষ্টি একজন সর্বস্ব-হারা মানুষের। সান্ত্বনা দিয়ে কষ্টটা বাড়াতে চাইলাম না ।
তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে , সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” এই আমি টা জীবনে সব কিছুই পেতে পেতে হারিয়েছি । কখন ও কিছু ধরে রাখতে পারিনি । সব এই ভালবাসার কাঙ্গাল টাকে ছেড়ে চলে যায় । সবার ভালবাসার অনেক দাম ।”
চোখের পানি আর আটকাতে পারলাম না । অবুঝ, বদরাগী , একটু খামখেয়ালি বন্ধুটাকে জরিয়ে ধরলাম শক্ত করে ।।
আআ