♚
বর্ষায় চিত্রা নদী টলটলে হয়ে আছে। ঘাটে ছোট ছোট নৌকা বাঁধা। অদূরে সারিসারি বাড়ি। নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রাম। ভর দুপরে একপশলা বৃষ্টি হয়ে আবার রোদ উঠতে শুরু করেছে, তবে মাটি এখনো ভেজা। এরমধ্যে কোত্থেকে যেনো তক্তা পেটানোর ঠুকঠাক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নদীর ধারেই গ্রামের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের পাকা দালান উঠছে। এই বাড়ির রাজমিস্ত্রি মেছের আলী খুব তোড়জোড় করছেন। ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে একে ওকে তাগাদা দিচ্ছেন- “হ্যা তক্তাটা ভালো কইরে ধর, উঁচু কইরে... আরেকটু, আরেকটু, হুহু বা দিকে- বা দিকে ফ্যাল”। এইতো... এইতো, হচ্ছে ঠিকমত!
তার ছেলে লালমিয়াঁ আপাতত কাজে ফাঁকি দিয়ে জমিদার বাড়ির একটা পুরানো দেওয়ালে ছবি আঁকছে। এই দেওয়াল লালমিয়াঁর আঁকা বহু ছবির সাক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছবিগুলো হলুদ দিয়ে আঁকা নয়তো কাঠকয়লা দিয়ে । হঠাৎ পিতা মেছের আলীর হাক শুনতে পায় সে ‘কইরে লালমিয়াঁ কুহানে তুই, ঘাপটি মাইরে পইড়ে রইছিস, তাড়াতাড়ি এদিকে আইসে জিনিস পত্র গুছায়ে নে, বাড়ি যাতি হবে, তাড়াতাড়ি, বেলা গড়ইয়ে যাচ্ছে কলাম’। ছবি আঁকা বাদ দিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় জিনিসপত্র গোছাতে চলে যায় লালমিয়াঁ।
মিস্ত্রীদের জিনিসপত্র গোছাতে দেখে জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় মেছের আলীকে ডাক দিয়ে বললেন ‘কাজ-কাম কদ্দুর মেছের মিয়াঁ? কাইলকের মধ্যি হয়ে যাবেনে মনে হচ্ছে, তা এইডে হয়ে গেলি পুব দিকি একটা দিয়াল কইরে দিতি হয় যে’। ‘ও আর ইরাম কি, দেড়-দুইশো ইট হলি হয়ে যাবেনে মনে হয়’ বলল মেছের আলী। আচ্ছা বেশ- তা আমাগে লালমিয়াঁর কি এইরামই যাবে, ও তো ছবি-টবি আঁকে ভালো, ওরে কলিকাতায় পাঠায় দিলি হয়? জবাবে মেছের আলী বলে- মা মরা ছুয়াল আমার ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ছিল, এরপর টাকা তি আর কুলোই নি, কি করবো কন?
‘তা তুমি চালি ওরে আমি কলকাতায় আমার বাড়িতি পাঠাতি পারি বললেন জমিদার বাবু, সেই যাগায় আর্ট কলেজে ভর্তি হল। টাকা পয়সা যা লাগে না হয় দিলাম আমি, দেহো যদি আর্ট-টার্ট শিখে কিছু করতি পারে, তার তো আবার আর্টে ভারি নেশা’। কিছুটা ইতস্তত হয়ে ছেলে লালমিয়াঁকে আর্ট কলেজে ভর্তি করতে রাজি হয় মেছের আলী। আর পাগলের সাঁকো নাড়ানো বোধ হয় একেই বলে! এই ছেলেই জগৎ বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পী এস এম ‘সুলতান’ হয়ে উঠতে চলেছে ।
♚
১৯৩৮ সাল, কোলকাতা। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুরে বাড়িতে লালমিয়াঁর বেশ দিন কেটে যাচ্ছে, আর্ট কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি চলছে তার। জমিদারবাবু দুটি বহুমূল্যবান আর্টের বই লালমিয়াঁর জন্য বিলেত থেকে আনিয়েছেন, আর বলেছেন ‘লালমিয়াঁ, যদি ভালো কইরে ছবি আঁকা শিখতে চাইস তবে তোকে এই প্রাথমিক বিদ্যেগুলো শিখতে হবে।’ স্কেচের বই দুটো নিয়ে লালমিয়াঁ ছবি আঁকা-আঁকি চালিয়ে যেতে লাগলো।
জমিদারের ছোট ভাই একদিন লালমিয়াকে ডেকে নিয়ে বললো, ‘দেখো লালমিয়া, তুমি যদি বড় শিল্পী হতে চাও, তাহলে তোমাকে ভালো শিক্ষকের কাছে ছবি আঁকা শিখতে হবে৷ তার মানে, তোমাকে আর্ট স্কুলে বা কলেজে ভর্তি হতে হবে৷ তার আগে তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে এবং ইন্টারভিউ দিয়ে পাশও করতে হবে৷’
আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার দিন যখন বেশ ঘনিয়ে এসেছে তখন জানা গেলো লালমিয়াঁর আর্ট কলেজে ভর্তির প্রাথমিক যোগ্যতাই নেই! ভর্তি পরীক্ষা দিতে নূনতম এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পাশ হওয়া লাগে। এখন কি উপায়? জমিদার বাবু একটা উপায় অবশ্য বের করলেন। তিনি বললেন শাহেদ সোহরাওয়ার্র্দীকে ধরতে হবে। সে এই কলেজের ভর্তি কমিটিতে আছে। তিনি বলে দিলে আর কোণ সমস্যা থাকবে না। কাজেই ঠিকানা নিয়ে লালমিয়াঁ সোজা শাহেদ সোহরাওয়ার্র্দীর বাসা খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো।
লালমিয়াঁ যে মুহুর্তে বাড়িটি খুঁজে পেলো ঠিক সেই মূহুর্তেই শাহেদ সোহরাওয়ার্র্দী গাড়ীতে করে বাইরে বেরুচ্ছিলেন। বাড়ির সামনে লালমিয়াঁকে দেখতে তাঁকে ইশারায় ডাক দিলেন শাহেদ সোহরাওয়ার্র্দী। লালমিয়াঁ তার সমস্যার কথা খুলে বলল, সেই সাথে মিথ্যা কথা জুড়ে দিল যে তার কেউ নাই। লালমিয়াঁর চোখে শাহেদ সোহরাওয়ার্র্দী সেদিন কি দেখেছিলেন তা তিনিই ভালো জানেন, তিনি লালমিয়াঁকে তার বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন।
১৯৪১ সাল, লালমিয়াঁ কোলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হল। ভর্তি পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছে।
এই সিরিজের অন্যগল্পঃ
রূপালী গিটার -পর্বঃ ১
রূপালী গিটার -পর্বঃ ২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৫৫