✪
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাচ্চু সমুদ্র থেকে অদূরে পাথরের একটা চাইয়ের উপর গীটার হাতে বসে আছে। ১০ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কনসার্টে গীটার বাজিয়ে মনে হতে পারে আজ সে ক্লান্ত। না গীটার তাকে কখনো ক্লান্ত করে না। গীটার তাকে এক গভীর নেশায় ডুবিয়ে দেয়। বাচ্চু সোলস ছেড়ে নিজে একটা ব্যান্ড গড়ে তুলেছে- লিটল রিভার ব্যান্ড^ সংক্ষেপে এলআরবি। সোলস এ থাকতেই তার দুটি একক অ্যালবাম বেরিয়েছে ‘রক্ত গোলাপ’ আর ‘ময়না’।
ঢাকা ১৯৯১। মধ্যরাত । মৃদুমন্দ বাতাস, নিঃস্পন্দ রাত্রি আর তারাগুলো রাতের আকাশে এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো। একটা খাতায় বাচ্চু গানের কথা লিখছে তার নতুন গানের দলের জন্য। বাচ্চু লিখলো ‘এখন অনেক রাত, খোলা আকাশের নীচে জীবনের অনেক আয়োজন, তাই আমি বসে আছি দরজার ওপাশে’ গান লিখতে লিখতেই খেয়ালী বাচ্চুর হাতে কখন যেন তার গীটার উঠে আসে।
প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত বাচ্চুর গান লিখে, সুর করে কেটে যেতে থাকে। অসংখ্য গান জমে যায়। একবছরের মাথায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডাবল অ্যালবাম “এলআরবি ওয়ান” “এলআরবি টু” প্রকাশ করে এলআরবি। এরইমধ্যে একদিন বাচ্চুর ডাক আসলো টেলিভিশনের পর্দায় গান করার জন্য। বাচ্চু তার এলাআরবি ব্যান্ড নিয়ে বিটিভির স্টুডিওতে উপস্থিত।
বাচ্চু সহ দলের বেজ গীটার বাদক স্বপন, কী-বোর্ড বাদক এস আই টুটুল (যেকিনা পরে নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত হবে), ড্রামার জয় সকলে উচ্চহারে মেকাপ করে গেছে। মেকাপে তাদের ভূতের মত লাগছে। তাদের ধারনা হয়েছিল টেলিভিশন মানেই মেকাপ টেকাপ করে যেতে হবে। এরকম ভূতুড়ে সাজ নিয়েই নিজেদের প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান করে ফিরে আসলো আইয়ুব বাচ্চু আর এলআরবি।
প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের পর প্রতি বছর আয়ুব বাচ্চু একটি করে অ্যালবাম প্রকাশ করতে থাকে। ওদিকে কনসার্টে ও চলতে থাকে। এরমধ্যে তরুণেরা গীটার হাতে তুলে নিতে শুরু করেছে। গীটার হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরনার নাম। আর এই অনুপ্রেরনার যোগানদাতার নাম “আয়ুব বাচ্চু”
শুধু বাংলাদেশেই নয় বিদেশেও বাচ্চুর গীটারের কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এরমধ্যে একদিন ভারতের যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে থেকে আয়ুব বাচ্চুর আমন্ত্রন আসলো কনসার্টে গান পরিবেশনের জন্য। এলআরবি আর বাচ্চু তাদের আস্তানায় প্রস্তুতি নিতে থাকে ‘দেশের বাইরে প্রথম’ পরিবেশনার জন্য।
✪
কলকাতার এক উজ্জ্বল সন্ধ্যা। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সাজ সাজ রব। পনেরো দিনব্যাপী চলা কার্লফেস্ট বা “সংস্কৃতি ১৯৯৭” এর আজকে সমাপনী। এই অনুষ্ঠানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রী। বসন্তে সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা ক্যাম্পাসে লাল, নীল আলোর মিছিল খেলা করছে। উজ্জ্বল হ্যালোজেন বাতি জ্বালানো হয়েছে আর্টস ডিপার্টমেন্টের মুক্তমঞ্চে। পঙ্গপালের মত দলে দলে ছুটছে সবাই সেদিকে।
গান-বাজনায় পারদর্শী তরুণেরা অপেক্ষা করছে নিজেদের দক্ষতার পরীক্ষা দিতে। তবে তার আগে স্টেজে উঠে আসলো আয়ুব বাচ্চু আর এলআরবি। কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ চিন্তিত এই ব্যান্ডটাকে নিয়ে, কেউ জানে না তাদের মান কিরকম।
আয়ুব বাচ্চু গান শুরু করে দিয়েছে- “সেই তুমি কেনো এতো অচেনা হলে...চলো বদলে যাই”। একে একে সাত আটটি গান গেয়ে ফেলেছে সেই সাথে গান গেয়ে উঠেছে তার গীটারও। দর্শক সারি থেকে বিপুল চিৎকার আর উল্লাস, সকলে অভিভূত। কর্তৃপক্ষ চমকিত, তারা বাচ্চুকে অনুরোধ জানালো আজকের অনুষ্ঠানের একজন বিচারক হয়ে যেতে।
পরদিন “মিলনদা'র ক্যান্টিনে” চায়ের কাপে ঝড় উঠলো, আলোচনায় আয়ুব বাচ্চু আর সকলের মুখে মুখে গান- “সেই তুমি কেনো এতো অচেনা হলে”
✪
চার বছর পরের কথা......
চলো বদলে যাই, ফেরারী মন, এখন অনেক রাত, রুপালী গীটার, কষ্ট গানগুলো দর্জির দোকান, মার্কেট, বাসা-বাড়ী, পাড়া মহল্লায় উচ্চস্বরে জানান দিয়ে যাচ্ছে সময়টা নতুনের, সময়টা ব্যান্ড সঙ্গীতের।
ঢাকা বিমানবন্দরে একরাশ কালোর মধ্যে আয়ুব বাচ্চু বসে আছে- কালো হ্যাট, কালো টি-শার্ট, হাত ভর্তি কালো ব্যান্ড। এটা আয়ুব বাচ্চুর ট্রেডমার্ক গেটআপ। এলআরবি দ্বিতীয় বারের মত নিউইয়র্কের “ম্যাডিসন স্কয়ারে” কনসার্ট করতে যাচ্ছে। বিমান উড্ডয়নের অবসরে তাই আড্ডা আর খুনসুটি চলছে। আয়ুব বাচ্চু স্মৃতিচারন করছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার সফর করার কথা- সেবার খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি স্টেটে কনসার্ট ছিলো। এইতো বছর দুয়েক আগের কথা। এরপর কাতার, আবুধাবি, জাপান, জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর ইতালীতে করা কনসার্ট গুলোর কথা ও তার মনে পড়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সাথে আয়ুব বাচ্চুকে পরবর্তিতে লন্ডনের উইম্বলে এরেনা, এলিন গার্ডেনসহ এশিয়া ইউরোপের আরো অনেক দেশে করা কনসার্টের স্মৃতি যোগ করতে হবে।
২০০০ সাল। যুক্ত্ররাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ার তার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের গৌরবের স্মৃতিতে আরো একটি স্মৃতি যোগ করতে চলেছে। নিজ প্রচেষ্টায় গীটার চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠা কিংবদন্তী এক গীটারিষ্ট দ্বিতীয় বারের মত এই স্টেজে উঠবে। আয়ূব বাচ্চু অপেক্ষা করছে ব্যাক স্টেজে। “এবি” “এবি” চিৎকারে লাখো জনতা সামনে অপেক্ষা করে আছে। আলো জ্বলে উঠলো, আয়ুব বাচ্চু তার ব্যান্ড এলআরবি নিয়ে আরো একবার স্টেজে উঠে এসেছে। লাখো জনতার হর্ষধ্বনি আর উল্লাসে কনসার্ট শুরু হল। গানের পাশাপাশি চললো এবির গীটারে রক এন্ড রোলের অসাধারণ সব প্রকাশ শৈলী। দুই হাত দিয়ে ট্যাপ(two-handed tapping), তরঙ্গ বিক্ষোভ(Volume swells), ঐকতান(harmonics), সুইপ পিকিং, লেগাটো, এক্সট্রিম ওহেমি ইফেক্ট।
নিউইয়র্কের হিম বাতাসে অন্য অনেকে আয়োজনের মত আরো একটি আয়োজন শেষ হয়ে যায়। মুহুর্মুহ করতালি আর এবি-এবি কোরাসে ম্যাডিসন স্কয়ার বিদায় জানাচ্ছে আরো এক উজ্জ্বল তারকাকে। একসময় যেখানে জর্জ হ্যারিসন, লেড জেপেলিন, এল্ভিস প্রিসলি, জো সাত্রিয়ানি, মাইকেল জ্যাকসনের মত অন্য অনেক তারকাকে বিদায় জানতে হয়েছিলো। দু’হাত উচু করে কৃতজ্ঞতা জানালো এই ‘গীটার গড’। তখন তার কালো সানগ্লাসের আড়ালে সুখের কোন অশ্রু ছিলো কিনা, তা কেউ দেখে নি - সে শুধু আস্তে করে বলল “বিদায়”।
# "ঐতিহাসিক বা ইতিহাস নয়, শুধু গল্প "
[ লিটল রিভার ব্যান্ড^ সংক্ষেপে এলআরবি- অস্ট্রেলিয়ায় এক কনসার্টে দেখা যায় লিটল রিভার ব্যান্ড নামে একটি দল আগে থেকেই আছে। আয়ুব বাচ্চু তখন তার নিজের ব্যান্ড এলআরবি’র নামের সম্প্রসারিত ভাবটি পরিবর্তন করে রাখে “লাভ রান্স ব্লাইন্ড” ]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৪ দুপুর ২:২৫