(*বাচ্চাকালে ডায়েরীতে যেভাবে লিখেছিলাম সেটাই তুলে দিলাম)
সুন্দরবন যাওয়ার জন্য ভোর ৬ টায় বাসে উঠেছি।
একে একে খুলনার বিভিন্ন জায়গা পেরিয়ে বাস রূপসা নদীর তীরে পৌছল। ফেরীতে নদী পার হতে হবে। আমাদের বাস ফেরীর সবচেয়ে নিকটে, তাই আমরাই প্রথমে ফেরীতে আরোহন করলাম।
ফেরী চলতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম ফেরী অনেকদূর চলে এসেছে।
ফেরী থেকে নামার পর বাস আবারো সোজা রাস্তায় চলছে। তখন রাস্তার পাশে বিশাল বিশাল চিংড়ির ঘের দেখা যাচ্ছিলো। পাশের সীটে বসা একজন আমাকে বুঝিয়ে দিলেন এখানকার লোকেরা বছরের কিছু সময় চিংড়ির ঘের করে আবার কিছু সময় ফসল ফলায়। এই চিংড়ির ঘের গুলোতে সমুদ্রের পানি ঢোকার ব্যাবস্থা রয়েছে, এই ঘেরগুলোর একটার সাথে আরেকটির সংযোগ রয়েছে।
২/৩ ঘন্টা পরের কথা। আমাদের বাস এখন কোষ্ট গার্ডে। একটা অফিস তার মাথায় কোষ্টগার্ডের লোগো লাগানো। তার পাশে প্রশস্থ রাস্তা। আমারা এই রাস্তা দিয়েই হাঁটছি- আর চারিদিক দেখছি। কোষ্টগার্ডের অফিসের সামনে ফুলের গাছ। অফিসের করিডোরে কিছু কোষ্টগার্ডের লোক চলাফেরা করছে। তাদের গায়ে হাল্কা ব্লু কালারের ইউনিফর্ম, সোল্ডারে ব্যাজ। আমাদের সামনেই ছিলো একটা নদী। এটাই কোষ্টগার্ডের ঘাঁটি। নদীতে কোষ্ট গার্ডের কিছু জাহাজ ও স্পিডবোট রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোচ্ছি। সামনের একটা ছোট ব্রীজ পার হয়ে একটা ছোটখাট জাহাজে ঢুকে পড়লাম। জাহাজ বললে ভুল হবে এটা একটা বড় বোট। বোটটার ভিতরে ছোট খাটো অনেক রুম। অবাক করা বিষয়। প্রথমে একটা রুমে ঢুকলাম। সেখানে ছিলো একটা বেড, দেওয়ালের সাথে লাগানো আলমারি। আলমারির ভিতর ছিলো অনেক গুলো ডিকশনারী। এগুলো হয়তো বিদেশে রপ্তানি করা হবে, অথবা আমদানী করা হয়েছে।
এ রুমটা ঘোরার পর গিয়েছিলাম চালকের রুমে। সেখানে কম্পাস, টেলিফোন, হুইল ছাড়াও রয়েছে নাম না জানা অসংখ্য মেশিন। চালকের রুম ঘোরার পর মনে হল নীচ তলা থেকে ঘুরে আসি, কিন্তু একি নীচে যাওয়ার কোন সিড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। সিড়ি খুঁজে পাওয়ার উপায় না দেখে বোটের সামনে ঢালুতে স্লিপ করে নীচে নামলাম, যদিও এটা ভয়ঙ্কর ছিলো। বোটের নীচে কেবিন দেখে অবাক হলাম কারন সেখানে ছিল টেলিভিশন, কেরামবোর্ড, দাবা, ফ্রিজ, সোফা প্রভৃতি। ওখানে ফ্রিজ খুলে দেখলাম মাছ, মাংস, আইসক্রিম এইসব রাখা। সোফায় বসে কিছুক্ষন টিভি দেখলাম।
নীচের কেবিনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ফ্লোরের সাথে লাগানো একটা দরজার দিকে চোখ পড়লো, অর্থাৎ নীচে আর একটা কেবিন। কিন্তু একেবিনে কোন জানলা নেই, কেবিনটা অন্ধকার। অন্ধকার থাকার কারনে প্রথমে খেয়াল হয় নি এখানে একজন নাবিক ঘুমোচ্ছে! যাই হোক নিচের এ কেবিন দেখতে দেখতে বোটের পিছনে চলে আসলাম। পেছনে এসে দেখি উপরে ওঠার সিড়ি। তখন বুঝতে পারলাম এটিই বোটের উপর থেকে নীচ এবং নীচ থেকে উপরে যাওয়ার একমাত্র সিড়ি!
বোট থেকে উপরে এসে দেখি আমাদের জন্য কোষ্ট গার্ডের একটি স্পিড বোট রেডি রাখা হয়েছে। ওটাতে করে সুন্দরবনের দিকে রওনা দিলাম। বড় বড় জাহাজ নোঙ্গর করে রাখা এদিক সেদিক। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর সুন্দরবন এসে পৌছলাম। সুন্দরবনের প্রবেশ পথে একটা নকশা ঝুলিয়ে রাখা। এই গেট রুমটা পার হয়ে কাঠের উঁচু প্লাটফর্মের উপর হাঁটতে লাগলাম। চারিদিকে নানা রকম গাছ, সেগুলোর গায়ে নাম লেখা রয়েছে। সুন্দরী, সেগুন, গরান, গোলপাতা এইসব গাছ। হঠাৎ দেখতে পেলাম দুটো সুন্দর হরিণ। খুব সুন্দর! ওদের পাতা খেতে দিলাম, ওরা পাতা খাচ্ছিলো। হঠাৎ কি মনে করে কাঠের পাটাতন থেকে লাফ দিলাম, আর সাথে সাথে পিতার কাছ থেকে খেলাম এক রাম ধমক! এখানে নাকি যেকোন সময় বাঘ চলে আসতে পারে, তাই পাটাতন থেকে নামা যাবে না!!
কাঠের পাটাতন ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সুন্দর বিশ্রাম ঘরের কাছে চলে আসলাম। এখানে বসলে ছোট ছোট অনেক খাল, নালা দেখা যায়। চমৎকার যায়গা, আমরা এখানে নাস্তা করলাম। এরপর একটু জিরিয়ে নিয়ে একটা মিনি চিড়িয়াখানা ঘুরে আসলাম। সেখানে বাঘ, কুমীর, বানর, হরিন খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। এরপর একটা উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। এটা প্রায় ৪ তলা সমান উঁচু! এখান থেকে প্রায় পুরো সুন্দরবন দেখা যায়! দারুন দৃশ্য।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সূর্য ডুবে গিয়েছে, আমারা সুন্দরবন থেকে ফেরার জন্য রওনা করলাম।
*লেখাটা যখনকার তখন রূপসা ব্রীজ তৈরী হয়নি, ফেরীতে করে রূপসা নদী পার হতে হতো।
*কোষ্ট গার্ডের ঘাঁটি সম্ভবত মংলায়। মংলা থেকে সুন্দরবন যাওয়ার ব্যাপারটাই মনে হয় লিখতে চেয়েছিলাম!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৫২