Click This Link অব্যক্ত (১ম খণ্ড)
ইচ্ছে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছ অনন্যা?” কিন্তু করলাম না। সেই দেখি উলটো জিজ্ঞেস করে বসলো। আমি খুব অবাক হলাম। কারণ এই অতি সাধারণ কৌতূহলী প্রশ্নটাকে সে কখনোই পছন্দ করত না। এখন সে নিজেই সে প্রশ্ন করে। কত বদলে গেছে সে! কোথায় যেন পড়েছিলাম, “মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়”।
কেবল আমি বদলাতে পারিনি। একাই পড়ে আছি ছাদের ঘরে, হায় নিয়তি।
আমি ভাল কিংবা মন্দ কিছুই বললাম না। আগেও বলিনি কখনো, কোনদিন। শুধু মুচকি হাসতাম। ওকে রাগানোর কিংবা কাদানোর চেষ্টা করতাম। ওকে কাদাতে আমার খুব মজা লাগত। কারণ কাদলে ওকে খুব সুন্দর লাগে। ওর চোখের অশ্রু যখন গাল বেয়ে গড়েবে, আমি তখন আমার আবছায়া প্রতিবিম্ব সেখানে দেখার চেষ্টা করব, কিন্তু সে আমাকে সেই লোনতা বিম্ব দেখতে দেবে না। আগেই মুছে ফেলবে চোখের জল। থামিয়ে দেবে কান্না। এই দৃশ্য দেখার জন্যই সবসময় কাদানোর চেষ্টা করতাম। সফলও হয়েছিলাম কয়েকবার। কিন্তু সেই কাংখিত দৃশ্য দেখা সম্ভব হয়নি। আমি আমার নিজের গালে চোখের নিচে একটি সূক্ষ জলধারা অনুভব করেছিলাম তখন।
আজকে আর হাসলাম না। কারণ বুকে কষ্ট নিয়ে মুখে হাসি দেখিয়ে ভালো আছি বোঝানোর মিথ্যা অভিনয় আমি ওর সাথে কখনোই করতে পারব না।
অনন্যা খুবই জেদি মেয়ে। আমি ওকে প্রচন্ড বেশি ভালবাসতাম, এখনো বাসি, ভবিষ্যতেও বাসব। আজীবন, আমৃত্যু। অবশ্য তা হবে অপ্রকাশিত, অপ্রকাশ্য; সে কিংবা অন্য কেউ কোনদিন জানতে পারবে না সেই ভালবাসার কথা, লুকোনো অনুভুতিগুলো।
আমি একবার অনেক কষ্ট করে সারারাত জেগে ওকে সাত পৃষ্ঠার বিশাল একটা চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্য; যাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম সে তা দেয় নি। ভুলে গিয়েছিল কিংবা হারিয়ে ফেলেছিল। যখন অনন্যা জেনেছিল যে আমি তাকে চিঠি লিখেছিলাম আর তা সে পায়নি তখন সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। পরে আমাকে ফোন করে বলতে বলেছিল চিঠিতে যা যা লেখা আছে তা বলতে। কিন্তু আমি সেগুলো বলিনি। হেসেছিলাম কারণ অনেক কথা আছে যা মুখে বলা যায় কিন্তু লেখা যায় না। আবার এমন অনেক কথা আছে যা লেখা যায় কালি দিয়ে কিন্তু মুখ ফুটে বলা যায় না। এরপর থেকে সে পায়ই জোর করত আমাকে যেন তাকে আমার প্রথম লেখা চিঠির কথাগুলো শোনাই। আমি কোনদিনই শোনাই নি। আজ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে সেই কথাগুলো বলার। কিন্তু তা কি আর সম্ভব। কী দরকার, পুরোনো কথা টেনে বের করে শুধু শুধু কষ্ট বাড়ানোর!
আমি ওকে আমার প্রত্যেকটা স্বপ্নের কথা বলতাম। সেও বলত। কিন্তু আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর সুন্দরতম স্বপ্নের কথা বলিনি। ইচ্ছে করেই জানাইনি পরে কোনদিন জানাবো ভেবে। আচ্ছা আজ যদি তাকে বলিযে স্বপ্নটা ছিল এরকম- ‘আমি আর তুমি এক সুন্দর শরতের বিকালে হাটছিলাম কোন এক বিশাল পাহাড়ের পাদদেশ ধরে। চূড়ায় সাদা ঘোলা মেঘের বাহার লেগে আছে। সবুজের বেলাভুমিতে নানা অপরিচিত পাখিন কুঞ্জন এক মায়াবী সুরের তাল তুলেছে। তুমি শক্ত করে ধরে আছ আমার হাত। যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাব সে গহীন বিজনবনে। কলকল করে বয়ে আসছে ঝরণা প্রবাহ। দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তা ছুটে চলেছে অসীমের সন্ধানে। পাথুরে সেই স্বচ্ছ জলস্রোতে খেলা করছে কিছু ছোট ছোট রঙ্গিন মাছ।
তুমি শখ করে জেদ করলে, মাছ ধরবে। আমার হাত ছেড়ে নেমে পড়লে পাহাড়ের কান্না ধারায়। স্পর্শ করার চেষ্টা করলে দুষ্টূ মাছের ঝাক। এমন সময় তোমার চুলের খোপা থেকে একটি ফুল পানিতে পরে গেল। ভেসে যেতে লাগল। তুমি তুলতে গেলে সে ফুল। আমি বারণ করলাম। আমার মুখের দিকে তাকালে তুমি। আমি তখন পাহাড়ের গায়ে অতি অযত্নে বেড়ে ওঠা নাম না জানা একটা নীল ঘাসফুল তুলে ভেসে যাওয়া ফুলের সাথে ভাসিয়ে দিলাম। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ছিলে। বলেছিলাম কাছে টেনে আস্তে আস্তে কানের কাছে- “সবসময় পাশে থাকতে চাই। তাই আজ তোমার সাথে আমি নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম”।
তখন সেই পাহাড়ী প্রকৃতি, বুনো ফুলগুলো, মেঘে ঢাকা নীলাকাশ, পাথুরে ঝরণাধারা, পাহাড় চূড়ায় পাতাঝড়া গাছগুলো এমনকি লতানো গুল্মগুলো আমার সাথে রব তুলে ছিল সমস্বরে- “ভালবাসি, প্রচণ্ড”।
না, এ স্বপ্ন তোমাকে জানতে দেয়া যাবে না। জানাবো কী করে?
ও হঠাত আমার খুব কাছে এসে আমার হাত ধরল। বলল, “শিহাব, তোমাকে এখনও আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি”। সে আগের মত করে প্রতিদিন তিনবার “ভালবাসি”। অবশ্য আমি তাকে কখনো সেভাবে বলিনি। কিন্তু সে জানে, আমি তাকে কত ভালবাসি। আজ প্রচণ্ড বলতে ইচ্ছে করছে তাকে, “ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি”। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না, অসম্ভব। আমি জানি, তাকে কোনদিন বলতে পারব না আমার হৃদয়ের কথাগুলো।
আমি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। এসে দেখি সাঝের মেঘদল প্রজাপতির পাখার মত রঙ্গিন হয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। চড়ুই দুটো ফিরে এসেছে। নাড়িকেল গাছের পাতায় হালকা শিশির পড়তে শুরু করেছে। একটু পরে তারা উঠবে। একটি চাদকে ঘিরে দুটি তারা, সহস্র তারা, কোটি তারা। কোথাও সপ্তর্ষী, কোথাও লুব্ধক, কোথাও কালপুরুষ।
আবার রাত হবে, রাত পোহাবে। আবার সকাল হবে, আমার দিন শুরু হবে নতুন করে কিন্তু আমি রয়ে যাব সেই আগের মতই।
আমি প্রচন্ড আক্ষেপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে চীতকার করে বলি, “হে স্রষ্টা, তুই কেন আমাকে এরকম করে দিলে? কেন আমাকে আমার কথাগুলো বলতে দিলে না? কেন তুমি আমাকে কথা বলার অপার তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছ?”
কিন্তু আমি জানি, এ কথাগুলোও কোনদিন আমি স্রষ্টাকে বলতে পারব না। কারণ
ভোকাল-কর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষ কখনো কথা বলতে পারে না।
ইচ্ছে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছ অনন্যা?” কিন্তু করলাম না। সেই দেখি উলটো জিজ্ঞেস করে বসলো। আমি খুব অবাক হলাম। কারণ এই অতি সাধারণ কৌতূহলী প্রশ্নটাকে সে কখনোই পছন্দ করত না। এখন সে নিজেই সে প্রশ্ন করে। কত বদলে গেছে সে! কোথায় যেন পড়েছিলাম, “মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়”।
কেবল আমি বদলাতে পারিনি। একাই পড়ে আছি ছাদের ঘরে, হায় নিয়তি।
আমি ভাল কিংবা মন্দ কিছুই বললাম না। আগেও বলিনি কখনো, কোনদিন। শুধু মুচকি হাসতাম। ওকে রাগানোর কিংবা কাদানোর চেষ্টা করতাম। ওকে কাদাতে আমার খুব মজা লাগত। কারণ কাদলে ওকে খুব সুন্দর লাগে। ওর চোখের অশ্রু যখন গাল বেয়ে গড়েবে, আমি তখন আমার আবছায়া প্রতিবিম্ব সেখানে দেখার চেষ্টা করব, কিন্তু সে আমাকে সেই লোনতা বিম্ব দেখতে দেবে না। আগেই মুছে ফেলবে চোখের জল। থামিয়ে দেবে কান্না। এই দৃশ্য দেখার জন্যই সবসময় কাদানোর চেষ্টা করতাম। সফলও হয়েছিলাম কয়েকবার। কিন্তু সেই কাংখিত দৃশ্য দেখা সম্ভব হয়নি। আমি আমার নিজের গালে চোখের নিচে একটি সূক্ষ জলধারা অনুভব করেছিলাম তখন।
আজকে আর হাসলাম না। কারণ বুকে কষ্ট নিয়ে মুখে হাসি দেখিয়ে ভালো আছি বোঝানোর মিথ্যা অভিনয় আমি ওর সাথে কখনোই করতে পারব না।
অনন্যা খুবই জেদি মেয়ে। আমি ওকে প্রচন্ড বেশি ভালবাসতাম, এখনো বাসি, ভবিষ্যতেও বাসব। আজীবন, আমৃত্যু। অবশ্য তা হবে অপ্রকাশিত, অপ্রকাশ্য; সে কিংবা অন্য কেউ কোনদিন জানতে পারবে না সেই ভালবাসার কথা, লুকোনো অনুভুতিগুলো।
আমি একবার অনেক কষ্ট করে সারারাত জেগে ওকে সাত পৃষ্ঠার বিশাল একটা চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্য; যাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম সে তা দেয় নি। ভুলে গিয়েছিল কিংবা হারিয়ে ফেলেছিল। যখন অনন্যা জেনেছিল যে আমি তাকে চিঠি লিখেছিলাম আর তা সে পায়নি তখন সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। পরে আমাকে ফোন করে বলতে বলেছিল চিঠিতে যা যা লেখা আছে তা বলতে। কিন্তু আমি সেগুলো বলিনি। হেসেছিলাম কারণ অনেক কথা আছে যা মুখে বলা যায় কিন্তু লেখা যায় না। আবার এমন অনেক কথা আছে যা লেখা যায় কালি দিয়ে কিন্তু মুখ ফুটে বলা যায় না। এরপর থেকে সে পায়ই জোর করত আমাকে যেন তাকে আমার প্রথম লেখা চিঠির কথাগুলো শোনাই। আমি কোনদিনই শোনাই নি। আজ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে সেই কথাগুলো বলার। কিন্তু তা কি আর সম্ভব। কী দরকার, পুরোনো কথা টেনে বের করে শুধু শুধু কষ্ট বাড়ানোর!
আমি ওকে আমার প্রত্যেকটা স্বপ্নের কথা বলতাম। সেও বলত। কিন্তু আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর সুন্দরতম স্বপ্নের কথা বলিনি। ইচ্ছে করেই জানাইনি পরে কোনদিন জানাবো ভেবে। আচ্ছা আজ যদি তাকে বলিযে স্বপ্নটা ছিল এরকম- ‘আমি আর তুমি এক সুন্দর শরতের বিকালে হাটছিলাম কোন এক বিশাল পাহাড়ের পাদদেশ ধরে। চূড়ায় সাদা ঘোলা মেঘের বাহার লেগে আছে। সবুজের বেলাভুমিতে নানা অপরিচিত পাখিন কুঞ্জন এক মায়াবী সুরের তাল তুলেছে। তুমি শক্ত করে ধরে আছ আমার হাত। যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাব সে গহীন বিজনবনে। কলকল করে বয়ে আসছে ঝরণা প্রবাহ। দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তা ছুটে চলেছে অসীমের সন্ধানে। পাথুরে সেই স্বচ্ছ জলস্রোতে খেলা করছে কিছু ছোট ছোট রঙ্গিন মাছ।
তুমি শখ করে জেদ করলে, মাছ ধরবে। আমার হাত ছেড়ে নেমে পড়লে পাহাড়ের কান্না ধারায়। স্পর্শ করার চেষ্টা করলে দুষ্টূ মাছের ঝাক। এমন সময় তোমার চুলের খোপা থেকে একটি ফুল পানিতে পরে গেল। ভেসে যেতে লাগল। তুমি তুলতে গেলে সে ফুল। আমি বারণ করলাম। আমার মুখের দিকে তাকালে তুমি। আমি তখন পাহাড়ের গায়ে অতি অযত্নে বেড়ে ওঠা নাম না জানা একটা নীল ঘাসফুল তুলে ভেসে যাওয়া ফুলের সাথে ভাসিয়ে দিলাম। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ছিলে। বলেছিলাম কাছে টেনে আস্তে আস্তে কানের কাছে- “সবসময় পাশে থাকতে চাই। তাই আজ তোমার সাথে আমি নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম”।
তখন সেই পাহাড়ী প্রকৃতি, বুনো ফুলগুলো, মেঘে ঢাকা নীলাকাশ, পাথুরে ঝরণাধারা, পাহাড় চূড়ায় পাতাঝড়া গাছগুলো এমনকি লতানো গুল্মগুলো আমার সাথে রব তুলে ছিল সমস্বরে- “ভালবাসি, প্রচণ্ড”।
না, এ স্বপ্ন তোমাকে জানতে দেয়া যাবে না। জানাবো কী করে?
ও হঠাত আমার খুব কাছে এসে আমার হাত ধরল। বলল, “শিহাব, তোমাকে এখনও আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি”। সে আগের মত করে প্রতিদিন তিনবার “ভালবাসি”। অবশ্য আমি তাকে কখনো সেভাবে বলিনি। কিন্তু সে জানে, আমি তাকে কত ভালবাসি। আজ প্রচণ্ড বলতে ইচ্ছে করছে তাকে, “ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি”। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না, অসম্ভব। আমি জানি, তাকে কোনদিন বলতে পারব না আমার হৃদয়ের কথাগুলো।
আমি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। এসে দেখি সাঝের মেঘদল প্রজাপতির পাখার মত রঙ্গিন হয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। চড়ুই দুটো ফিরে এসেছে। নাড়িকেল গাছের পাতায় হালকা শিশির পড়তে শুরু করেছে। একটু পরে তারা উঠবে। একটি চাদকে ঘিরে দুটি তারা, সহস্র তারা, কোটি তারা। কোথাও সপ্তর্ষী, কোথাও লুব্ধক, কোথাও কালপুরুষ।
আবার রাত হবে, রাত পোহাবে। আবার সকাল হবে, আমার দিন শুরু হবে নতুন করে কিন্তু আমি রয়ে যাব সেই আগের মতই।
আমি প্রচন্ড আক্ষেপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে চীতকার করে বলি, “হে স্রষ্টা, তুই কেন আমাকে এরকম করে দিলে? কেন আমাকে আমার কথাগুলো বলতে দিলে না? কেন তুমি আমাকে কথা বলার অপার তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছ?”
কিন্তু আমি জানি, এ কথাগুলোও কোনদিন আমি স্রষ্টাকে বলতে পারব না। কারণ
ভোকাল-কর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষ কখনো কথা বলতে পারে না।