মেসির কারণেই, বার্সেলোনায় নেইমার ঠিক ম্লান না হলেও, যেন চোখের আড়াল হয়ে থাকত। সুকৌশলী নেইমার যেন ছিল একজন সুপারহিরো, পৌরাণিক বীর মেসির সুযোগ্য সঙ্গী, সাইডকিক। চোখ ধাঁধানো মেসিতে হারায় যেন নেইমারের অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য।
যেমন, নেইমারকে কিনে নেয়া এই পিএসজির বিপক্ষেই গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বের ফিরতি লেগে ৬-১ গোলের জয়ের সুবাদে এগ্রিগেটে ৬-৫ ব্যবধানে কোয়ার্টার ফাইনালে টিকে থাকার পেছনে নেইমারের অবদান ছিল বার্সার যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি। প্রথম লেগে পিএসজির মাঠে গিয়ে চার চারটি গোল হজম করে ফিরেছিল বার্সেলোনা। এমন গোলের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে কেউ কখনও ফেরেনি আগে। কিন্তু ফিরতি লেগে ছয় গোল দিয়ে অভূতপূর্ব সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে বার্সেলোনা। নির্ধারিত সময়ের মাত্র তিন মিনিট যখন বাকী, তখনো অত্যাবশ্যক তিন গোলের দুটিই করেছিল নেইমার। এমনকি শেষ বাঁশির সেকেন্ড আগে করা সর্জিও রবার্তোর অত্যাবশ্যক তিন গোলের শেষ গোলটির এসিস্টও ছিল এই নেইমারেরই করা। কিন্তু খেলা শেষে আনন্দে, উত্তেজনায় উদ্বেল বার্সেলোনার অফিসিয়াল পেইজ যে ছবি উত্তোলন করেছিল সগর্বে, সেটা আর কারো নয়, ছিল মেসির! যে ছবিতে দেখা যাচ্ছিল স্টেডিয়ামের দর্শকরা ঘিরে ধরেছে গ্যালারীর প্রান্তে বিজ্ঞাপন বেষ্টনীর উপর দাঁড়িয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা মেসিকে।
'কে সেরা' মেসি-রোনালদোর অশেষ সেই দ্বৈরথের কারণেই যেন, কেবল ক্লাব বার্সা নয়, এর ভক্তকুলেও মেসিকে অতিক্রম করতে পারে না কেউই। নিজেকে দিয়েই যদি বিচার করি, বাংলাদেশ সময়ে স্রেফ গভীর রাতে অনুষ্ঠিত দুইএকটি ম্যাচ ছাড়া, সাম্প্রতিককালে বার্সেলোনার খুব কম ম্যাচই আমার অদেখা। তথাপি হাতে গোনা বিশেষ কয়েকটা ছাড়া (যা ভোলার নয়), বার্সেলোনার জন্য করা নেইমারের সর্বমোট ১০৫ গোলের কটা মনে করতে পারি আমি? অথচ মেসির প্রত্যেকটি গোল যেন চোখে জাজ্বল্যমান!
এসব বিবেচনায়, নেইমারের বার্সেলোনা ছাড়ার সিদ্ধান্ত ছিল একশভাগ সঠিক। কঠিন। ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব শিকারির জন্য আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাছাড়া এমন মা-বাপ ভোলানো টাকার অংক উপেক্ষা করার জন্য একজন মেসিও কি যথেষ্ট?
অবশ্য দর্শক, ভক্তদের মনোযোগের অধিকাংশ যেমন মেসি বন্দনায় বুঁদ, তেমনি খেলা চলাকালীন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ক্ষেত্রেও কি বিষয়টা প্রায় একই নয়? পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের সিংহভাগ জুড়ে নিশ্চয়ই তাদের থাকত 'প্রলয়ঙ্করী মেসি-সামলাও' নীতি। যার ফলে নেইমার পেত জায়গা, প্রয়োজনীয় উপেক্ষা, জরুরি অমনোযোগ। যা সে কাজে লাগাত দারুণভাবে! এখন দেখার বিষয়- মেসি উপলক্ষে সৃষ্ট সেই উপেক্ষার স্পেস নেইমারকে কে তৈরি করে দিচ্ছে পিএসজিতে। ইনজুরি প্রবণ ডি-মারিয়া? কাভানি? ভিরেট্টি? এদের কেউ কি মেসি, স্যুয়ারেজের সাথে তুলনীয়?
বার্সেলোনা-ভক্তদের জন্য নেইমারের এমন প্রস্থান যেন অবিশ্বাস্য। দুঃস্বপ্ন। স্যুয়ারেজ-মেসি-নেইমার, এমন যুগান্তকারী, ভয়ানক আক্রমণ-ত্রয়ী তাদেরই কেউ স্বেচ্ছায় ভাঙ্গতে পারে তা ছিল কল্পনাতীত? স্রেফ ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব শিকারে এমন ভাঙন স্বীকার? তাও ব্রায়ানমিউনিখ নয়, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নয়, জুভেন্টাস নয়, রিয়েল মাদ্রিদ নয়, আরব পয়সায় রাতারাতি ফুলে কলাগাছ হওয়া ভুঁইফোঁড় পিএসজির জন্য? যে দলের মালিক আরব ধনকুবের বার্সেলোনার কাছে তাদের ৬-১ গোলের পরাজয়ের জবাব দিল পয়সার ঝনঝনানি দিয়ে? তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে হারাতে না পেরে, তাকে কিনে নিয়ে? এভাবে বিকোয় কেউ?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:২৭