সুন্দরবনের স্যাঁতস্যাঁতে, আর্দ্র একটি বিকেল। আট মাস বয়সী বাঘ-শাবক `বুনো` ও তার বোন `রুনো` বনের প্রান্তে ছোট ছোট ঝোপে ভরা খোলা যে স্থানটিতে বসেছিল, সেখান থেকে বিশ হাত দূরে পড়ে থাকা, একদিন পুরনো একটি আধ-খাওয়া চিত্রা হরিণের মৃতদেহকে ঘিরে ভনভন করছিল অন্তত হাজার খানেক মাছি। তাদের গুঞ্জন, এর অপর পাশে বয়ে যাওয়া সরু নদীটির কুলকুল সুর আর গাছের ডালে ডালে আলোড়ন তোলা ম্যাকাক নামক ছোট বানরের কিচিরমিচিরে ভরে ছিল বনের অলস বিকেলটি। এখনো গা চিড়-চিড়ে রোদ বিকিরিত করতে থাকা ডুবন্ত সূর্যটিকে আড়াল ক`রে, কেওড়া গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় গিয়ে বসার জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে উঠছিল বুনো ও রুনো। তাছাড়া তাদের তৃষ্ণাও পেয়েছিল অনেক! কিন্তু তাদের দুজনকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল তাদের মায়ের আগমনের জন্য। মায়ের অনুপস্থিতিতে নদীর কিনারে গিয়ে পানি খাওয়াটা তারা এখনো নিরাপদ বোধ করে না। জোয়ারের আটকে পড়া পানিতে সৃষ্ট বনের খুদে ডোবাগুলোর তপ্ত জলে ইদানীং রুচছে না তাদের! গোলপাতার ঘন ঝোপের কিনার দিয়ে, লক্ষ লক্ষ পারশে মাছের হুটোপুটি মুখর, স্রোতস্বিনী নদীর ঠাণ্ডা জল না খেলে তাদের দীর্ঘ সময়ের তৃষ্ণা যেন নিবারিত হতে চায় না কিছুতেই।
গুমোট আবহাওয়ায়, প্রায় স্থির বনের বাতাসে ভেসে থাকা তীব্র গায়ের ঘ্রাণ তাদের জানান দিচ্ছিল- কাছেরই একটা ঝোপের ওপাশে দাঁড়িয়ে, গাছের খরখরে কাণ্ডে গা ঘষছে তাদের মা। তার উদ্দেশ্যে দুজনেই মৃদু গরগর করল থেমে থেমে, হাঁপাতে হাঁপাতে। এর মধ্যে খেলুড়ে-উচ্ছল বুনো, কিছুক্ষণ পর পরই লাফিয়ে উঠে আলতো থাবা দিচ্ছিল রুনোর মুখে। আর বুদ্ধিমতী রুনোও ঝট ক`রে তার মুখ সরিয়ে ফেলে, অহিংস কামড় দিচ্ছিল বুনোর ঘাড়ের মোটা চামড়ায়।
এর খানিক বাদে, মৃত হরিণটি যেখানে পড়েছিল, তার কাছেই শুরু হওয়া ঘন বনের প্রান্তের একটি গাছের আড়াল থেকে দুটি উদ্ধত বন্য-শুকর উদয় হল ইঁদুরের মত বাতাস শুকে, মাথাগুলো উপর নিচ দোলাতে দোলাতে, ঘোঁত ঘোঁত শব্দ ক`রে। বাঘ-শাবক `বুনো` ও `রুনো`কে দেখেও, না দেখার ভান ক`রে তারা এগিয়ে এলো ছোট ছোট পায়ে; হরিণটির কারকাসে তাদের চেপ্টা নাকের নিচে লুকান ধারালো দাঁত বসানোর কামনায়। তাদের একজন দু-একবার `বুনো` ও `রুনো`র দিকে ফিরে নাকে শুকল কিছু, তারপর খাওয়া শুরু করল প`চে গ`লতে শুরু করা হরিণের মৃতদেহটির অবশিষ্ট। তাদের দেখে ভীত বাঘ-শাবক `বুনো` ও `রুনো` হাঁপানো বন্ধ ক`রে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হুট ক'রে। এবং সতর্ক, বড় বড় হলদে চোখগুলো মেলে, মূর্তির মত স্থির হয়ে সেদিকে দেখতে থাকল তারা এবং চাপা শব্দে গোঙানো শুরু করল থেমে থেমে।
শুকর দুটির ভোজন দীর্ঘস্থায়ী হল না। হঠাৎ কী বুঝে মুহূর্তের মধ্যে তারা যে দিক দিয়ে এসেছিল, সেই দিকেই নির্দ্বিধায় ছুটে উধাও হয়ে গেল কুই কুই শব্দ করতে করতে। এর এক কি দুই সেকেন্ডের মধ্যেই, বুনো ও রুনোর মা-কে দেখা গেল, শুকর দুটি যেদিক দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তার থেকে অন্তত চল্লিশ হাত দূরে, দুটি বড় `সুন্দরী` গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ছুটে পালানো ভীত শুকর-গুলোর তাড়নায় এখনো দুলতে থাকা ঝোপের দিকে তাকিয়ে থেকে এক-পা, দুই-পা ক`রে এগিয়ে এলো সে; তার বিশাল, রাজকীয় মাথাটা এদিক ওদিক ধিরস্থির ভঙ্গীতে ঘুরিয়ে, জাঁকালো ডোরাকাটা চামড়ায় পড়ন্ত বিকেলের রোদের ঝিকমিক তুলে। তার শরীরের শক্তিশালী, অনতিক্রম্য, শাসানো গন্ধে ভরে উঠল নদীর পাড়ের বাতাস। আকস্মিক বেড়ে গেল গাছে গাছে ঝুলে বেড়ানো ম্যাকাকদের লাফালাফি এবং চ্যাঁচামেচি। ম্যাকাকদের অস্থির লম্ফ-ঝম্পে ঝ`রে পড়া কেওড়ার পাতার লোভে, কাছেই তাদের অনুসরণ ক`রে হাঁটতে থাকা চিত্রা হরিণের দলগুলো লাফিয়ে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে।
সতর্ক কিন্তু অকুতোভয় প্রকাণ্ড বাঘিনী `মায়া`, তার আগমনের ফলে সৃষ্ট সমস্ত আলোড়ন অগ্রাহ্য ক`রে বুনো ও রুনোর দিকে এগিয়ে গেল শান্ত পায়ে। শাবকদের গায়ে গা ঘ'ষে তাদের হালকা আদর করে সে। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই শিকারে পারদর্শী হয়ে উঠবে বুনো ও রুনো। তখন নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারবে তারা। তাই যেন, বুনো ও রুনোর প্রতি `মায়া`র আচরণ ইদানীং ক্রমশ শীতল হয়ে উঠছিল। অবশ্য শাবকদের খাবারের যোগান দেওয়ার দায়িত্বে এতটুকু অবহেলা দেখা যায়নি তার মধ্যে, এখনো। সে সমান দায়িত্ব ও প্রগাঢ় একাগ্রতার সাথে দু-তিন দিনে অন্তত একবার মরিয়া হয়ে শিকার ধ`রে আনে। কখনো ক্ষিপ্র চিত্রা হরিণগুলোকে ধাওয়া দিয়ে পানিতে ফেলে, কখনো বন্য শুকরগুলোর লোমশ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, কখনো নদীতে মাছ ধ`রে।
বছর দুই আগে বড় ধরণের এক ঝড়ের পর কাছেই অবস্থিত মানুষের একটি গ্রামের দিকেও যেতে হয়েছিল মায়াকে, তার ও বাচ্চাদের জন্য খাবার যোগাড় ক`রে আনতে। সেই সময় চিংড়ি ধরতে ব্যস্ত দলছুট কিছু জেলের দিকেও ছুটে গিয়েছিল সে দু-একবার। তবে তা নিতান্তই অভাবে প`ড়ে, বাঁচার তাগিতে। পারতপক্ষে দুর্গম জঙ্গলের নিরাপদ, স্বচ্ছন্দের আলো-আঁধারি ছেড়ে বের হয় না তারা। এর যত গভীরে, উদরের দিকে ঢুকে পড়া যায়, ততই তারা নিরাপদ। সেখানে আকাশে, মেঘের উপর দিয়ে কদাচিৎ উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের শব্দ ছাড়া আর কোনো অহেতুক উচ্চ শব্দ তাদের কাম্য নীরবতায় ছেদ ফেলে না। হাঁটু অবধি থিকথিকে কাদা, মশামাছি ইত্যাদির কারণে শিকারি, বন-দস্যু কিংবা উৎসুক দুর্ধর্ষ পর্যটকদের জন্যও ধারালো শ্বাস-মূল খচিত ম্যানগ্রোভ বনের গভীরে পৌঁছা অত্যন্ত কঠিন।
মৃত হরিণের দেহ পড়ে থাকা, নদীর পাড়ের সেই স্থানটির কাছেই বড় বড় কোটর বিশিষ্ট তিনটি গাছের কোণায় প্রায়ান্ধকার এবং শুকনো একটি উঁচু ঢিবির মত স্থানে মায়া ও তার শাবকরা বসবাস করছে বিগত কয়েক মাস যাবত। বুনো ও রুনো যখন ছোট ছিল, তখন এমনই আরেকটি ঢিবির ঢালের আড়ালে, গাছের আবডালে তাদের লুকিয়ে রেখে শিকারে বের হত মায়া। শিকার অবশ্যই, তাদের গায়ের ঘ্রাণে ভারী বাতাস উপেক্ষা ক'রে, তাদের আবাসস্থলেরই চারপাশে ঘুরে বেড়াত না। আবার মায়ার পক্ষেও ছোট শাবক` গুলো-কে উন্মুক্ত, বিপদ-সংকুল বনের মধ্যে ফেলে খুব বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আবার না গেলেও মারা পড়ত তারা! সেটি ছিল মায়া`র জন্য মরণ-পণ, যেন এক অনন্ত সংগ্রাম! শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল সে তখন; পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে। বর্ষার সময় যখন বনটির প্রায় সব স্থানই পানিতে তলিয়ে যেত, তখন ঢিবির উপর স্যাঁতসেঁতে গাছ ও ঝোপের ভেতর, অঝোর বর্ষণে ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত-ক্লিষ্ট-ক্ষুধার্ত-বিপন্ন `মায়া` জড়সড় হয়ে নিজের শরীরের তাপ সঞ্চারিত করত তার শাবকদের ভেজা শরীরে। তাকে শিকার করতে হত থিক থিকে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে। কখনো কাঁদার ভেতর, পানির গভীরে লুকিয়ে থাকা শ্বাসমূলে আহত হত সে। নিজেই নিজের চিকিৎসা করত সে, জিহ্বা দিয়ে আহত স্থান চেটে চেটে। বুনো ও রুনোও সাহায্য করার চেষ্টা করত। এভাবেই বুনো ও রুনো বড় হয়ে উঠেছে আজ, মা মায়ার অক্লান্ত পরিশ্রম, হার না মানা যুদ্ধ ও অকৃত্রিম ত্যাগের ফলে।
গতকাল সন্ধ্যার দিকে নদীর পাড়ের খোলা এই স্থানেই পানি খেতে আসা হরিণটিকে শিকার করেছিল মায়া। প্রায় চার দিন পর ব্যগ্র-করুণ-মরিয়া ছিল তাদের গতকালের শিকার এবং সান্ধ্য-ভোজ। তারপর আজ বিকেল পর্যন্ত তারা ঘুমিয়ে, গড়িয়ে বিশ্রাম ক`রে এখন পানি খেতে এসেছে নদীর কিনারায়। আরও কিছু গড়াগড়ি, আদর শেষে মায়া এগিয়ে গেল গোলপাতার ঘন ঝোপটির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট একটি সরু পথের ভেতর দিয়ে নদীর ঢালু পাড়ে। এবং তাকে প্রবল আগ্রহের সাথে অনুসরণ করল উৎফুল্ল বুনো ও বিমনা রুনো।
কিন্তু পানির কাছে গিয়েই তারা বুঝতে পেরেছিল অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে এখানে; নদীতে; নদীর পানিতে। কী যেন ভীষণ অন্যরকম আজ! হালকা মেটে রং বদলে গিয়ে একটা কালচে রং ধারণ করেছিল পানি। তাছাড়া কেমন উৎকট গন্ধ! তারা যখন তাদের জিভ দিয়ে পানি খাওয়া শুরু করেছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল- এর স্বাদ বদলে গেছে আমূল! প্রথমে তারা খেতেই পারল না। কিন্তু গত সন্ধ্যার ভারী ভোজ ও আজকের সারাদিনের ভ্যাঁপসা গরম তাদের কিছুটা হলেও পান করতে বাধ্য করেছিল। পানি পানের খানিক বাদেই অসুস্থ হয়ে পড়ল খেলুড়ে বুনো। রুনোর মুখে ভাঙতে শুরু করল ফ্যানা। অপেক্ষাকৃত সবল রুনো ধুঁকতে ধুঁকতে কিছুক্ষণ আগে যেখানে বসে ছিল সেখানে গিয়ে লুটিয়ে পড়লেও, বুনো পানির কাছেই শুয়ে পড়ল। বুনোকে ধাক্কা দিয়ে, ঘাড় কামড়ে দিয়ে নদীর ঢালু পাড় থেকে বনের ভেতর যেতে তাগাদা দিতে থাকল মায়া। সে নিজেও অসুস্থ বোধ করছিল ভীষণ। ছটফট করছিল কাটা মুরগীর মত। সেই অবস্থাতেও, তবু সে বুনোকে হাচরে পাছড়ে তুলে এনে রাখল উঁচু, শুকনো একটি স্থানে।
শক্তিশালী বাঘিনী মায়া বেঁচে গিয়েছিল সেই যাত্রায়। তার অভ্যস্ত, অভিজ্ঞ, সংগ্রামী পাকস্থলী বিষাক্ত পানির বিষক্রিয়ার সাথে দুই ঘণ্টা যুদ্ধ ক`রে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে হারিয়েছিল তার আদরের, হাজার প্রতিকূলতার বিপক্ষে নিরন্তর যুদ্ধ ক`রে বড় ক`রে তোলা অপূর্ব সুন্দর শাবক দুটোকে। নদীর ঢালু পাড় থেকে টেনে তুলে আনার কিছুক্ষণ পরেই মারা গিয়েছিল বুনো। তার প্রায় এক ঘণ্টা পর বুদ্ধিমতী রুনোও।
তখন সন্ধ্যা। হাজার হাজার মাছি ভনভন ক`রে ঘিরে ধরছিল কিছুক্ষণ আগেও তুমুল খেলে বেড়ানো আমুদে বুনো ও রুনোর মৃতদেহ দুটোকে। দ্রুত রাত নেমে আসতেই কেওড়ার পাতার ফাঙ্গাস চেটে খেতে খেতে ম্যাকাক বানরেরা ঢুকে পড়ছিল বনের গভীরে। সন্ধ্যার জঙ্গলের কালো অবয়বের উপর দেখা দিল ঘরে ফিরতে থাকা পাখির প্রশস্ত, বিচ্ছিন্ন ঝাঁক। হুটোপুটি ক`রে যেন দিনের ইতি টানছে ঐকাহিকদের দল। শুধু নিশাচর পাখি ও শ্বাপদেরা ঘুম থেকে জেগে উঠবে এখন শিকারের তাড়নায়। ঠিক এই সময় ঝিঁঝিঁ পোকা, ব্যাং, বানরের শেষ বেলার চিৎকার, ঘরে ফিরতে থাকা মেছো পাখিদের কিচিরমিচির ভেদ ক`রে একটা দৈত্যাকৃতির জাহাজের ইঞ্জিনের ভারী শব্দ ভেসে এলো তপ্ত বাতাসে। কিছু একটা হয়েছে মানুষদের; কাছেই কোথাও। অথবা হচ্ছে। গভীর অরণ্যের নিরীহ বুনো জীবনেও তারা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত নিজেদের ক্ষুধা ও উন্নয়নের বিষ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪৭