আমি মনে করতে পারি স্কুলের সেইসব দিনের কথা যখন টিফিনের সময় দুটি কুমকুমে গরম সিঙ্গারা এবং একটি গাঢ় কমলা রঙের বস্তা আইসক্রিম দিয়ে আমি টিফিন করতাম। টিফিন-ঘণ্টায়, ভিড় ক’রে আসা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আশায় স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলো সিঙ্গারা ভাঁজত ডুবো তেলে, তাদের বিশালাকারের কুচকুচে কালো কড়াইয়ের ভেতর। উত্তপ্ত তেলের আকাশে হলদে-সাদা আতশবাজির মত ভাসত সিঙ্গারাগুলো। বার্গার কিঙের প্রকাণ্ড বার্গারগুলোর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না সেসব সিঙ্গারার অবস্থান- অন্তত আমার কাছে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হত যখন টিফিনের সময় সংবাদপত্রের ছেড়া কাগজে মোড়ানো গরম সিঙ্গারাগুলো হাতে পেতাম। হালকা উষ্ণ ময়দার প্রথম স্তরটি ভেদ ক’রে যখন ভেতরের হলদে, তপ্ত আলুগুলোর সংস্পর্শে আসত আমার জিহ্বা, আরেক হাতে ধ’রে রাখা অরেঞ্জ আইসক্রিমে সযত্নে বসাতাম একটি যথার্থ কামড়। সেটি ছিল যেন বরফ-কুঁচিতে ভরা কোকাকোলা ভর্তি গ্লাসে চমৎকার একটি চুকুমের মত। কখনো তার চেয়েও বেশি।
এরও আগে- যখন এলাকার শেষ প্রান্তে অবস্থিত সিঙ্গারার হোটেল গুলো পর্যন্ত পৌঁছানোর মত বড় ছিলাম না, তখন সিঙ্গারার জন্য আমাকে নির্ভর করতে হত এলাকার ফুটোর দোকানের উপর। আমাদের কলোনি ও সংলগ্ন পাড়াগুলোর মধ্যকার সীমানা গড়া ছিল একটি উঁচু দেয়ালে। সিঙ্গারার দোকান ছিল পাড়ার অংশে, দেয়াল ঘেঁষা সরু রাস্তারও অপর পাশে। সীমানা নির্ধারণী এই দেয়ালের মাঝখানে একটি ফুটো করা ছিল এবং কলোনিতে বসবাসকারী মানুষজন সেই ফুটো দিয়েই পাড়ার দোকানগুলো থেকে জিনিসপত্র কেনাকাটা করত। তখন এত ছোট ছিলাম যে, দেয়ালে চ’ড়ে বসা-তো বহুদূরের কথা, দেয়ালের ফুটো পর্যন্তও পৌঁছাতে পারতাম না। তখন কি করতাম, দেয়ালের ফুটোর নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম বড় লোকজনদের কারো আগমনের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বড় কেউ এলে, তার সাহায্য নিতাম দেয়ালের অপর-পাশে থাকা সিঙ্গারা বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য।
কখনো এই দুষ্প্রাপ্য, অমৃত তুল্য সিঙ্গারা খাওয়ার সময় কোত্থেকে উড়ে এসে ছোঁ মেরে তা ছিনতাই ক’রে নিয়ে যেত, নিষ্ঠুর-উদ্ধত-তস্কর কাক। যখন এমনটা ঘটত, তখনো মুখের ভেতর চিবাতে থাকা অংশ আর শূন্য খবরের কাগজে তৈরি ঠোঙ্গা হাতে আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে; লুটেরা কাকের দিকে। নিজেকে অসহায়, সর্বস্বান্ত মনে হত। ছলছলে চোখে, মুখের ভেতরে থাকা অংশটি সাবধানে, বাড়তি সময় নিয়ে চিবাতে চিবাতে আমি ভাবতাম কিভাবে মায়ের কাছ থেকে আরও দুই টাকা জোগাড় করা যায়।
আমাদের জীবনে সিঙ্গারার ভূমিকা অপরিসীম, অনস্বীকার্য। আমাদের বড় হয়ে ওঠায় সিঙ্গারা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। অথচ আমরা এখনো সুযোগ পেলেই সিঙ্গারা খাই যদিও, তথাপি অসাধারণ এই খাবারটিকে নিরন্তর তুচ্ছ করি। বার্গার, স্যান্ডুইচ, চিকেন-ফ্রাই, লেজানিয়া, পিজা, পাস্তা ইত্যাদিকে সিঙ্গারার উপরে স্থান দেই! এটা অবিশ্বাস্য এবং অগ্রহণযোগ্য। সিঙ্গারাকে বাংলাদেশের জাতীয় নাস্তা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। মজা ক’রে বলছি না। গুরুত্বের সাথে বলছি। আমার মুখ গম্ভীর।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০২