somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবাসিক এলাকাগুলোর রূঢ়-গোপন বাস্তবতা

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুমন, রুবেল ও আরিফ বড় হয়ে উঠেছিল ত্রিশটি দালানের একটি বেশ বড়সড় সরকারী কলোনিতে। একটি দ্বিতল মসজিদ, আট-দশটি দোকানের একটি ব্যস্ত মার্কেট, একটি একতলা, আধা পাকা সরকারী স্কুল এবং অসংখ্য বৈকালিক খেলুড়ে কিশোর-কিশোরীর গভীর গুঞ্জনে ভরা তিন তিনটি খেলার মাঠে প্রাণবন্ত ছিল তাদের কলোনিটি। আয়াতাকার এলাকাটির উঁচু, রোদে শুকিয়ে খড়খড়ে শ্যাওলায় কালো প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল কিছু ঘিঞ্জি পাড়া; সরু রাস্তা, সংকীর্ণ গলির মহল্লা।
সুমন, রুবেল, আরিফ ও তাদের বন্ধুদের প্রায় সকলেই পড়াশুনা করত কলোনির স্কুলটিতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা সাইকেল চালাত এর পিচ ঢালা রাস্তাগুলোতে, যেগুলো ধমনীর মত বয়ে গিয়েছিল কালচে-হলুদ প্রায় অভিন্নরূপ চার-তলা দালানগুলোর সদর দরজা ছুঁয়ে। মাঠগুলোর এক কোণে তৈরি দোলনা ও রাস্তা ঘেঁষে ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের ঝুলে পড়া মরা ডালগুলো ধ`রে তারা দোল খেত স্কুল শুরুর অশিষ্ট ঘণ্টাটি বেজে ওঠার আগে এবং টিফিন-বিরতির সময়। আর স্কুল ছুটির মিষ্টি ঘণ্টার শব্দে বিকেলের বাতাস তরঙ্গায়িত হলে, কলোনির মাঠগুলোতে তারা ঝাঁক বাঁধা পাখির মত ছড়িয়ে পড়ত; খেলত অবিরাম।

খুব ভাল ফুটবল খেলত সুমন। রুবেল ছিল কলোনির সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যানদের একজন। কিন্তু আরিফ ছিল কেবল একজন উৎসাহী ফুটবল দর্শক; আর ক্রিকেটে তাকে বল করতে তো দেয়া হতই না, তথাপি যখন দলের অধিনায়ক সবার শেষে তাকে ব্যাটিং করতে পাঠাত, নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করত সে। অবশ্য গ্রীষ্ম শেষে, উষ্ণ বাতাসের বেতাল ছোটা-ছুটি স্তিমিত ক`রে হিম হিম হেমন্ত এলেই তারা যখন মাঠের ঘাস তুলে, কোদাল দিয়ে শিশির ভেজা মাটিতে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু করত, তখন গ্রীষ্মের আনাড়ি আরিফের কদর বেড়ে যেত লক্ষ গুণ! সে ছিল তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। এবং তার এই দোর্দণ্ড প্রতাপ অব্যাহত থাকত বসন্ত-বাতাসের চঞ্চল প্রবাহ শাটলকক-গুলোকে ইচ্ছে মত ভেসে ছোটাছুটি করতে বাঁধাগ্রস্ত করার আগ পর্যন্ত। ব্যাডমিন্টন খেলা বন্ধ হলে পরিত্যক্ত কোর্টগুলোতে বাড়তি দাগ তৈরি ক`রে তারা খেলত দাড়িয়াবান্ধা, কখনো হাডুডু। বসন্তের বিকেলগুলোতে ঘাসে ঘাসে উড়ে বেড়ানো শত শত দুরন্ত-রঙিন ফড়িঙ, রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে কলোনির দালানগুলো ঘেঁষে তৈরি গ্যাসের পাইপগুলোকে অবলম্বন ক`রে গজিয়ে ওঠা ঘাস-লতাপাতার ভারী ঝোপের ভেতর ঝিকমিক করতে থাকা জোনাকির পেছন পেছন তারা ছুটে বেড়াত অবিরাম।

তখন গাঢ় লাল রঙা, রানী ফড়িঙগুলোকে ফাঁদে ফেলে ধরতে পারা ছেলেটি ছিল সুমন, রুবেল ও আরিফদের মহলের গণ্যমান্যদের একজন। চিলের রক্ত দিয়ে ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দিতে জানা ছেলেটি ছিল একজন পুরাদস্তুর সেলেব্রিটি। তখন লাটিম ঘোরানোয়, ঘুড়ি উড়ানোয়, মার্বেল গড়ানোয় ওস্তাদদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ত এলাকা থেকে এলাকায়। তারা ছাঁদে উঠে ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশে কাটাকাটি খেলত হুলস্থূল। এবং কাটা পড়ে সানন্দে ভেসে ভেসে ভূপাতিত হতে থাকা ঘুড়ির পেছন ছুটত ততোধিক মরিয়া চিত্তে। লাটিম ঘোরাত ঘাস বিহীন শক্ত বাদামী মাটিতে। তারা যখন হাঁটত, তখন নানান রকম ও রঙের মার্বেলে ভর্তি তাদের বিশালাকারের পকেটগুলো ঝনঝন শব্দ করত। দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনায় ম্যাচ বাক্স ও সিগারেটের প্যাকেটের মূল্য নির্ধারণ ক`রে তারা খেলত চাড়া-খেলা। কখনো কিশোর মহলে অত্যন্ত মূল্যবান ম্যাচ-বাক্স কিংবা সিগারেটের মোড়ক, রঙিন চাঁদ বা ডাজ্ঞি খচিত মার্বেলগুলো তারা বিনিময় করত নিজেদের মধ্যে। বর্ষার দিনে মাঠের থিক-থিকে কাঁদায় ফুটবল খেলা শেষে, কাদায় মাখামাখি শরীরে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে তারা গোসল করত কলোনি-সংলগ্ন পাড়াগুলোর স্থির-সবুজ-ঠাণ্ডা পানির পুকুরগুলোতে।

এক সময় ফড়িঙ-জোনাকি-লাটিম-ঘুড়ি ইত্যাদির প্রতি তারা মনোযোগ হারিয়েছিল ঠিক, কিন্তু খোলা মাঠের মত হৃদয়, ফড়িঙের মত দুরন্ততা, পৌষের বাতাসের মত শীতল স্থৈর্য, জোনাকির মত রহস্যময়তা, আকাশে তীব্রভাবে গোত খাওয়া, লড়াকু ঘুড়ির মত ক্ষিপ্রতা নিয়ে কিশোর থেকে অচিরেই যুবক হয়ে উঠেছিল সুমন, রুবেল, আরিফরা। তারপর একদিন তাদের এলাকায়, বিষাক্ত ভার্মিনের মত নিভৃতে উদয় হয়েছিল এক লোক। এক বেসুরো হেমিলনের বাঁশিওয়ালার মত সে ও তার মৌতাত পরাভূত করেছিল সুমন, রুবেল ও আরিফদের দরাজ শৈশবের সমস্ত অর্জন ও শক্তিশালী হৃদয়গুলোকে। এই ছিল বাংলাদেশের একসময়কার সুখী, প্রাণচঞ্চল আবাসিক এলাকাগুলোর রূঢ় এবং গোপন বাস্তবতা।

লোকটি কলোনির একটি চায়ের দোকানের পেছনে নীল স্টিকার সাঁটা, গাঢ় বাদামী রঙা বোতলে ভরা এক প্রকার কাশির ঔষধ বিক্রি করা শুরু করল। এই ক্রূর ব্যবসায়ীর আগমনের ক্ষণকাল পরেই কলোনির অদূরের এক বস্তিতেও সহজলভ্য হল কিছু উদ্ভিজ্জ নেশা-দ্রব্য। কৌতূহলী সুমন, রুবেল ও আরিফ যখন শূন্য দুপুরগুলোতে কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াত, তখন তাদের সাথে পরিচয় ঘটেছিল কচি নামক একটি ছেলের। সুমন, তাকে গোপনে অবজ্ঞা করত কিন্তু উপেক্ষা করতে পারত না। রুবেল ছেলেটিকে চিনত কিন্তু সে কোথায় থাকে, তা সে জানত না। আরিফের সাথে কথায় বনত না কচির, তথাপি সে তার সাথে কখনো বাহাসে লিপ্ত হত না। এই কচিই তাদের নিয়ে যায় সেই অসিত হেমিলনের বাঁশিওয়ালার দোকানের পেছনে। এবং প্রথমে কৌতূহল বশে সাগ্রহে গ্রহণ করা ক্ষীণ নেশা থেকে তারা অচিরেই ঝুঁকে পড়ল প্রগাঢ় মত্ততায়। তাদের ক্ষণকালের আসক্তি চোখের পলকে দানা বেঁধে পরিণত হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী অনুরতিতে। তারা পছন্দ করতে শুরু করেছিল নেশা বিষয়ক মুভিগুলো। উদার মাঠ ফেলে তারা খুঁজতে শুরু করেছিল ইঁদুরের ঘুপচি, আলো-বাতাস বিহীন নোংরা কুঠরি। সকালকে নয়, দিনের আলোকে নয়, তারা ভালবাসাতে শুরু করেছিল সন্ধ্যাকে, নিকষ অন্ধকারকে। সদা হাস্যজ্জ্বল সুমন হয়ে উঠেছিল বিরক্তিকর, গোমড়া মুখো; উচ্ছল রুবেল পরিণত হয়েছিল বিষণ্ণ এক যুবকে; আর শান্ত ব্যক্তিত্ববান আরিফ হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রথিত ব্যক্তিত্ব।

এভাবে চার পাঁচ বছর পর সেই চায়ের দোকানের কোণার হেমিলনের বাঁশিওয়ালা মাদকের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেছিল ক্যাবল টিভি, ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে ইত্যাদির ব্যবসা। এবং সে পরিণত হয়েছিল এলাকার নেতায়, গণ্যমান্য-তে। সে ক্রিকেট-ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রধান অতিথি হত, কলোনির স্কুল পরিচালনায় সিদ্ধান্ত দিত। ইত্যবসরে পড়াশুনা ধরে রাখতে পারেনি ফুটবল মাঠের দুরন্ত সুমন। ক্রিকেট পিচের ক্ষিপ্র ব্যাটসম্যান রুবেল হয়ে পড়েছিল শ্লথের মত ধীর, দ্বিধাগ্রস্ত; ততদিনে ব্যাডমিন্টনের মর্যাদাপূর্ণ ম্যাচ-গুলোয় দাপটের সাথে দাপানো গর্বিত আরিফ নির্লজ্জের মত যার তার কাছ টাকা চাইতে শুরু করেছিল নেশার সরবরাহ যোগাতে।

হ্যাঁ; অন্য অনেকের মত একসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা-বাবারা সুমন, রুবেল ও আরিফকেও ভর্তি করেছিল নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে; একসময় অতি সন্তর্পণে তারা ফিরেও এসেছিল প্রায় সুস্থ জীবনে।

আকাশে এখনো ধারাল সুতার ঔদ্ধত্য নিয়ে ঘুড়ি ওড়ে, মাটিতে গর্ত সৃষ্টি ক`রে দুর্নিবার ঘোরে লাটিম, খেলুড়ের হাত থেকে পড়ে টুপটাপ শব্দে গর্তের দিকে ছুটে যায় সবুজ মার্বেল-দল, মাঠের সীমানা পেরিয়ে টেপ-টেনিস উড়ে গিয়ে পড়ে রোদের ঘ্রাণ ভরা ছাদে; ঘাস থেকে ঘাসে, ঝোপ থেকে ঝোপে উড়ে চলে রঙিন ফড়িঙ ও উজ্জ্বল জোনাকি। কিছু নতুন প্রশ্নের জন্ম হয় তাদের অনন্ত ক্রিয়ায়, পড়ে থাকে, অনুত্তরিতঃ আসলেই কি সুমন, রুবেল, আরিফরা ফিরে এসেছিল? পরবর্তীকালের সংশোধিত ছেঁড়াখোঁড়া এই জীবন তাদের প্রাপ্য ছিল কি?

http://www.notun-din.com/index.php?cPath=139&showme=948&dt=30&mt=Nov&yr=2015
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×