ভারতের পর, ঘোরাফেরা, কেনাকাটা তথা অবকাশ-যাপনের উদ্দেশ্যে বিদেশ-গামী বাংলাদেশীদের অন্যতম গন্তব্য হচ্ছে থাইল্যান্ড।
মাত্র দুই ঘণ্টার উড়াল, থাকা খাওয়া কেনা-কাটায় চমৎকার কিন্তু বেশ সস্তা বলেই হয়ত। মুদ্রা বিনিময় হারটাও এক বাথে মাত্র আড়াই টাকার! প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে থাইল্যান্ডের ভিসা তুলনামূলকভাবে বেশ দ্রুত ও সহজেই পাওয়া যায়; যদিও টুরিস্ট ভিসার জন্য আবেদন করা হলে, ভিসা অফিস খুব সতর্কতার সাথে ফোন করে যাচাই করার চেষ্টা করে যে আবেদনকারী আদৌ থাইল্যান্ড ঘুরতে যাচ্ছেন, নাকি অন্যকোন অভিপ্রায় আছে। টুরিস্ট, বিজনেস ইত্যাদি উদ্দেশ্যের আবেদনের ফি`র মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য আছে কিনা! তবে সেসব শুধুই নিয়মমাফিক কল, সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও সরল উত্তরের ব্যাপার। হেপার নয় মোটেও।
আমাদের থাইল্যান্ড যাওয়া হয়েছিল অফিসের কাজে, কোম্পানিটির এবারের বাৎসরিক বাজেট সভার আয়োজন করা হয়েছিল ব্যাংককে। সেবা ও বিশেষ করে ফ্লাইটের সময় বিবেচনায় `থাই এয়ার ওয়েজ` বেশ ভাল, কারণ এটি ঢাকা থেকে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয় দুপুর বেলা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই ঘণ্টা পনের মিনিটের মত উড়ে ব্যাংককে অবতরণ করবে বেলা থাকতে থাকতেই। তাতে করে ব্যাংককে নেমে, ইমিগ্রেশন পার হয়ে, হোটেলের উদ্দেশ্যে ট্যাক্সিতে চড়ে বসা যায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই। এতে প্রশস্ত সব ফ্লাইওভার দিয়ে মূল শহরের দিকে ছুঁটে যেতে যেতে ব্যাংকক শহরটাকে কিছুটা দেখে নিতে বিকেলের আলোটা পাওয়া যায়। এবং শহরে ঢোকার মুখে ঢাকার মত প্রচণ্ড জ্যাম উতরে হোটেলে পৌঁছে, চেকইন করে, লাগেজ-পত্র রুমে রেখেও আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য পুরো একটা সন্ধ্যা রাত মিলবে। `রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ` আরো ভাল; সময়েও, ভাড়ায়ও। কিন্তু রাতের বেলা ঢাকা থেকে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে উড়ে যায় যে ফ্লাইট-গুলো (যেমন বাংলাদেশ বিমান, ব্যাংকক এয়ার), সেগুলো গন্তব্যস্থলে বড় বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বটাকেও তখন মনে হতে পারে বিশ ঘণ্টার ম্যারাথন! এর কারণ- মাঝ রাতে অবতরণ করে প্রথম বারের মত ব্যাংকক ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য ভোরের আলো ফোটার আগে শহরের দিকে রওনা হওয়াটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। রাস্তাঘাটে অবশ্য প্রচুর ইউরোপীয়, এশিয়, অ্যামেরিকান পর্যটকদের দেখা মেলে, অর্থাৎ ভাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহজেই আশা করা যায়, কিন্তু আর যাই হোক- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং কিংবা বেইজিং নয় ব্যাংকক। ঢাকাকে ঢেলে সাজান গেলে, আরো অনেক ফ্লাই ওভার দিয়ে শহরটিকে আচ্ছাদিত করে দেয়া গেলে, রাস্তাঘাট থেকে রিকশা, পাবলিক বাসের জীবন্ত কড়কাসগুলোকে বেমালুম উধাও করে দেয়া গেলে, কিছু আকাশ-পাতাল নিত্য যাতায়াতের ট্রেন, অন্তত আরো একটি দূরবর্তী আধুনিক এয়ারপোর্ট শূন্য থেকে উদয় হলে যা দাঁড়াবে, ব্যাংকক তার চেয়ে উন্নত কিছু নয়। জীর্ণ কিন্তু গ্রহণযোগ্য পুরাতনের সাথে চকচকে অনস্বীকার্য নতুনের সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান। আধুনিক শহরগুলোর মত ফুটপাথ ধরে নিয়মিত দূরত্বে ডাস্টবিন রাখা নেই, তথাপি রাস্তাঘাটে ময়লা আবর্জনা চোখে পড়ে না। শত শত হকার রাস্তার ধার ঘেঁষে পণ্য-সামগ্রী নিয়ে বসে থাকলেও ফুটপাথ ধরে হাঁটাচলা করা যায় স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে। স্কাই ট্রেন আছে, তথাপি ট্রেন আসার আগেও ছেড়ে যেতে দরজা বন্ধ হওয়ার সময় কর্তব্যরত পুলিশ হুঁশিয়ারির বাঁশি বাজায়। ট্যাক্সি চালকেরা মিটারের বদলে ভাড়া দরদামেই আগ্রহী বেশি, তথাপি তাদের আসনের পেছনে লেখা আছে `চালক অভদ্র হলে এই নম্বরে কল করুন`; অভিযোগ পেশ করার সুবিধার্থে জানালার নিচে ট্যাক্সির রেজিস্ট্রেশন নম্বর সেঁটে দেয়া আছে। আধুনিক বাসের পাশাপাশি খোলা জানালার মুড়ির টিন জাতীয় পাবলিক বাসও চোখে পড়ে রাস্তায়, যাত্রীদেরও দেখা যায় সেগুলোর পেছন পেছন ছুটতে, তথাপি সেগুলো ভাঙ্গাচোরা নয় এবং নির্দিষ্ট স্থানের আশেপাশেই যাত্রী ওঠানামার জন্য থামে।
ব্যাংককের রাস্তায় ট্যাক্সি ক্যাবের পাশাপাশি আমাদের দেশের টেম্পোর মত কিছু খোলা স্কুটার চলে, যেগুলো মূলত পর্যটকরাই ভাড়া নিয়ে থাকেন, চারদিকটা ইচ্ছেমত ঘুরে দেখার জন্য। তবে এই ট্যাক্সি চালকরা শুধুই ট্যাক্সি চালক নয়। তাদের হাতে থাকে বিভিন্ন রকম ছবি। বিদেশী পথচারীদের দেখলে তারা `কোথায় যেতে চান` জিজ্ঞেস করে, পর মুহূর্তেই তাদের দিকে মেয়েদের ছবি এগিয়ে দিয়ে বলবে, `দুই ইউ নিড এনিথিং`। তবে শুধু তারাই নয়, সন্ধ্যা নেমে এলে ব্যাংককের রাস্তায় কৌতূহলী চোখে আশপাশটা দেখতে দেখতে হাটতে গেলে যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে, পুরুষ পর্যটকরা উটকো থাইদের এরকম আপত্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারেন।
ব্যাংককের রাস্তার ধার ধরে যে কোনো দোকানের চেয়ে বেশি হাত-পা-শরীর ম্যাসাজের দোকান। কাচের দেয়াল ভেদ ক`রে দেখা যায় সারি সারি চেয়ারে নানান দেশের পর্যটকরা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে আধ-শোয়া হয়ে চোখ মুদে পা ম্যাসেজ করিয়ে নিচ্ছেন। পর্যটনকে উৎসাহিত করা শহর হলেও, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ব্যাংককের অধিকাংশ এলাকায় ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়। তবে `নানা সুকাম্ভিত` নামক একটা এলাকা আছে যেখানে গভীর রাত পর্যন্তও মানি এক্সচেঞ্জের বুথগুলো খোলা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই কারণ সুকাম্ভিত পুরো এলাকাটি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখর থাকে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে নানান দেশের খাবারের দোকান, বার, অন্যান্য মনোরঞ্জন, ইন্দ্রিয়-ভিত্তিক সেবার দোকান, ডিস্কো, কমপ্লেক্স ও প্লাজাগুলো সাদা-কালো-হলুদ মানুষে গমগম করে। এই নানা সুকাম্ভিত এলাকাটি পুরো থাইল্যান্ড এবং তাদের ট্যুরিজমে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে গা ভাসানো সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে যথার্থ রূপে। রীতিমত পালিয়ে হোটেলে ফিরে যাওয়ার আগে, বেশ কিছু বাংলাদেশী রেঁস্তোরাও দেখলাম এলাকাটিতে। বাংলাতেই নাম লিখে রেখেছে। প্রায় শূন্য এবং অপেক্ষাকৃত মলিন সেগুলো।
তবে ব্যাংকক বলতে শুধু এই নয়। এখানে সর্বত্র সর্বক্ষণ ইউরোপ, অ্যামেরিকা সহ বিভিন্ন মহাদেশের পর্যটকদের তাদের ছোট ছোট পরিবারগুলোকে নিয়ে মুক্ত চিত্তে ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। বুকের কাছে তারা তাদের পুতুলের মত শিশুদের বেঁধে রাখে কেরিয়ার ব্যাগে এবং আশ্চর্য নির্ভার চেহারায় তারা হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায়, এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে, ব্যস্ত রাস্তাগুলো পার হয় নিঃশঙ্ক মনে। পথচারীদের এভাবে পার হতে দেখে ব্যাংককের রাস্তায় ছুটে চলা যানগুলোকে অন্তত দশ হাত দূরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখলে অনুমান করা যায়- ব্যাংককের গাড়ি চালকেরা বাংলাদেশীদের মত বেপরোয়া নয় মোটেও।
আমাদের মিটিঙের আয়োজকরা এক রাতে নদীপথে আমাদের রাতের ব্যাংকক দেখিয়ে আনার আয়োজন করেছিল স্বচ্ছ কাচে ঘেরা দারুণ বিলাসবহুল একটি তরীতে চড়িয়ে। নদীর নাম `ছাও ফ্রায়া` বা ` দ্যা রিভার অব কিংস`, বাংলায় `রাজাদের নদী`। এবং তাতে রিভার ক্রুজিং। আমাদের তুলে নিতে তরীটি এসে ভিড়েছিল হোটেলেরই একটি জেটিতে। একেবারে লবি থেকে ডেকে! তরীটির ভেতরেই আয়োজন করা হয়েছিল রাতের খাবারের; সুস্বাদু খাবার-পানীয় খেতে খেতে রঙিন আলো বিচ্ছুরিত টগবগে পানির নদী আর তার আলো ঝলমলে তীরের দৃশ্য উপভোগ। বেশ ব্যস্ত নদীটি এবং তাতে ছুঁটে চলা যানগুলোর বেশিরভাগই ছিল রঙিন আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রমোদ-তরী। ডেক থেকে চমৎকার আসনে বসে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বিভিন্ন আলোকিত প্যাগোডা, মন্দির, রাজবাড়ী; চোখে পড়েছে বিভিন্ন পাঁচ তারা হোটেলের একঘেয়ে সব দৈত্যাকৃতির, সুউচ্চ দালান, শহরের ছোট বড় বাসাবাড়ি এবং এমন আরো অনেক উজ্জ্বল স্থাপনা।
এই রিভার ক্রুজিং তরী বা হোটেলের চমৎকার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ কিংবা ডিনারের আয়োজনে হালাল খাবারের ব্যবস্থার ধরণ শুনে আমরা খুব মজা পেয়েছিলাম! সন্দিগ্ধ মুসলমানরা নাকি খাবারের হালালত্ব যাচাই ক`রে নিতে চাইলে তারা প্রদর্শন করতে পারবে স্বীকৃত কোনো ইমাম দ্বারা প্রদত্ত হালাল-সনদপত্র!
থাইরা হাসিখুশি, লঘু চিত্তের। ট্যাক্সি চালকরা খুব ভাল ইংরেজি না জানলেও কাজ চলে। দোকানীরা ইংরেজিতে হোক আর ইশারা-ইঙ্গিতে, বেশ ভালই যোগাযোগ করতে পারে। কম খরচে বিদেশে ঘুরতে যেতে চাওয়া বাংলাদেশীদের জন্য থাইল্যান্ডের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। ব্যাংকক থেকে মাত্র একশ কিলোমিটারের মধ্যে নীল সমুদ্র ও উজ্জ্বল বেলাভূমির পাত্যায়া শান্তি-স্বস্তি-সাগরকে কামনা করা পর্যটকদের জন্য দারুণ একটি অবকাশ যাপনের স্থান। প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে যদিও পাত্যায়া দেখে আসাটা এবার সম্ভব হয়নি, তবে স্ত্রী-পুত্র সহই (এবং পুত্র ছোট থাকতে থাকতেই) যে পাত্যায়া যাওয়াটা বিবাহ ও নৈতিকতা, পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর নিরাপদ হবে, তা ভেবে আফসোসও করিনি।
http://www.notun-din.com/index.php?cPath=144&showme=600&dt=07&mt=Nov&yr=2014