মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। রিয়েল এস্টেট, ভোজ্য তেল, শিপিং লাইন, এ্যাড ফার্ম ছাড়াও নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় আছে তার। বিত্তবানরা সাধারণত যেমনটা হয়ে থাকেন- রহমান সাহেবও সমাজের অত্যন্ত প্রতাপশালী ব্যক্তিদের একজন। ক্ষমতাসীন কি ক্ষমতাহীন, সব প্রকৃতির লোকজনই তার পকেটে বেঁচে-বর্তে থাকার জন্য উন্মুখ। এটা রহমান সাহেব, যিনি নির্ধারণ করেন কাদের তিনি তার পকেটে রাখবেন আর কাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।
তার বয়স পঞ্চাশের উপরে। আজকাল তার পাতলা সুন্দর চুলগুলোতে নিয়মিত কলপ না লাগালে মাথা সাদা কাঁশবনের রূপ ধারণ করে। তিনি ভুলে গেলেও, তার স্ত্রী অবশ্য মনে করে তার চুলে নিয়মিত কলপ দিয়ে দেন। তাই তার কালো চুলগুলোর মাঝখান থেকে মাঝে মাঝে কাশফুল উঁকি দিলেও, কাশবন হয়ে উঠার সুযোগ পায় কম।
চামড়ায় শ্যামলা, রহমান সাহেব সুদর্শন নন। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব, অর্থ-বিত্ত আর ক্ষমতা তার চেহারায় এমন একটা শক্তিশালী অভিব্যক্তি এনে দিয়েছে যে, তাকে কেউ অসুন্দর বলবে না। তার নাক খাঁড়া নয় কিন্তু দৃঢ়। তার চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু পিটপিটে কিংবা কুতকুতে নয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। তবে তার চোখের দৃষ্টিতে চারিত্রিক স্থৈর্যের শীতলতাটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। তাই বোধহয় তার চারপাশের পরিচিত মানুষজন তাকে অসম্ভব ভয় করে। এমনকি তার স্ত্রীও তাকে অত্যন্ত ভয় করে চলেন, যদিও এই জীবনে রহমান সাহেব কখনো তার স্ত্রীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলেননি। তবে রহমান সাহেবের ধারণা, সবাই আসলে তাকে নয়, তার চোখ গুলোকেই ভয় পায় বেশি। তিনি বিষয়টি গোপনে উপভোগই করেন। তার ১৭ বছরের একটি ছেলে আছে। ছেলের নাম জ্যোতি। তার কাছের মানুষদের মধ্যে একমাত্র ছেলেটির চোখেই নিজের জন্য কোনও ভীতি খুঁজে পান না।
বাবারা সাধারণত তাদের সন্তানদের যতটা ভালবাসেন, নিজের ছেলের জন্য রহমান সাহেবের ভালবাসা তার চেয়ে একটু নয়, বেশ বেশি। ছেলেটি জন্ম নেওয়ার পর থেকে সে চোখের আড়াল হলেই তিনি তীব্র অস্থিরতায় ভুগতেন। সন্তানের প্রতি একজন বাবার এমন মা-সুলভ ভালবাসা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু যে কারণেই হোক, এমন অস্বাভাবিক ভালবাসায় বশবর্তী হয়ে, ছেলেটির জন্মের কিছুদিন পরেই রহমান সাহেব তার অফিস পরিবর্তন করে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন, যেন চাইলেই ছেলেকে দেখতে পান। কিন্তু ইদানীং বিষয়টি নিয়ে তিনি আফসোস করেন। কারণ তার ছেলেটি ঠিক যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি। তার অপার্থিব ভালবাসার কারণেই কি?
এমনিতে জ্যোতি অত্যন্ত মেধাবী একটি ছেলে। স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড না হলেও, প্রথম দশের ভেতরেই ছিল (তাঁর পরিচিত মানুষজনের চেয়ে ব্যতিক্রম রহমান সাহেব তাঁর ছেলেকে বাংলা মাধ্যমে পড়িয়েছেন)। ছেলেকে নিয়ে উচ্চাশা থাকার পরও মেট্রিক-ইন্টারের ছেলের রেজাল্ট ছিল তার কাছে আশাতীত। এখন এই শহরেরই একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয়ে পড়াশুনা করছে সে। কিন্তু সমস্যা হল, ছেলেটি বাড়াবাড়ি রকমের ঘরকুনো। বোধহয় ঠিক ঘরকুনোও বলা চলে না। সে বাবা-কুনো। ক্লাস, টিউশন জাতীয় বাইরের জরুরী কাজ কর্ম শেষ হওয়ার পর, এক মুহূর্ত দেরি করবে না। সরাসরি বাসায় চলে আসবে। আর যেহেতু নিজের বিশাল পাঁচতলা দালানের একটি ফ্লোরের পুরোটা জুড়ে রহমান সাহেব অফিস করে নিয়েছেন, তাই বাসায় এসে প্রথমেই তার ছেলের কাজ হবে রহমান সাহেবের পাশে এসে বসে থাকা।
অফিসে রহমান সাহেবের টেবিলের পাশেই তার জন্য একটা টেবিল রাখা আছে, কম্পিউটার দেওয়া আছে। ফলে তিনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন কিংবা অফিসে, ছেলেটি ছায়ার মত তার সাথে পাশে ঝুলে থাকতে পারে এবং থাকে। বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক এবং অদ্ভুত। রহমান সাহেব যেখানে যান, তার সরল চেহারার রূপবান (রহমান সাহেবের স্ত্রী অসম্ভব রূপবতী) ছেলেটি স্বয়ংক্রিয় পুতুলের মত তার পিছ-পিছ যায়। বাসায় একমাত্র বেডরুমে কিংবা বাথরুমে ঢুকলেই তিনি ছেলের নিরবিচ্ছিন্ন সঙ্গ থেকে মুক্তি পান।
শুরুর দিকে ছেলের এমন আচরণে রহমান সাহেব কিছুটা বিরক্ত ছিলেন। ছেলেকে মানসিক ডাক্তার পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন । কিন্তু যখন দেখতে পেলেন ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ, তাই নিজেকে বিষয়টিতে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলেন। ছেলের সামনেই তাই সকল প্রকার ব্যবসায়িক কাজকর্ম পরিচালনা করেন তিনি। অবশ্য তার নিজের ফ্যাক্টরি, কর্পোরেট অফিস-গুলোতে যেতে হলে তিনি একাই যান। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় (যদি সেই সময় তাঁর ছেলেটি বাসায় থাকে) জ্যোতির চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে সে খুশি হত যদি রহমান সাহেব তাকে সাথে নিয়ে বের হতেন।
অনেক দিনের অভ্যাস হলেও, ইদানীং ছেলের এই আচরণে রহমান সাহেব কিছুটা ক্লান্তবোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছেলে; এখনও যদি এমন বাপ-পাগলা হয় তাহলে কিভাবে চলে? অবশ্য ছেলেকে বাপ-পাগলা ভেবে গর্ব করতেও রহমান সাহেবের যেন কোথায় বাঁধে। কারণ, তার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকা ছাড়া অন্যকোনও ভাবে ছেলেটি রহমান সাহেবের প্রতি আবেগ প্রকাশ করে না। সে কথাও বলে খুব কম। কোনও আবদার নেই, কথাবার্তা নেই; অভিযোগ, অনুযোগ নেই! একা থাকলে রহমান সাহেব মাঝে মাঝে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে কথা জমানোর চেষ্টা করলেও কথা জমে না। সোজা-সাপটা উত্তর দিয়ে ছেলে চুপ করে বসে থাকে, বই পড়ে, না হয় কম্পিউটারে কিসব ঘুটুর ঘুটুর করে। কিন্তু রহমান সাহেব খেয়াল করেছেন তিনি যখনই অন্য কারো সাথে কথা বলেন, তা সেটা হতে পারে ফোনে, তার ব্যক্তিগত সচিব, কর্মচারী কিংবা বাইরের কারো সাথে, তখন তার ছেলেটি তার সমস্ত কথা গভীর মনোযোগের সাথে শুনে। এত মনোযোগ দিয়ে শুনে যে অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেও আচ্ছন্নতায় তার মুখ নিজের অজান্তেই হা হয়ে উঠে।
রহমান সাহেব যতটা কষ্ট করে তার ব্যবসায়গুলো দাঁড় করিয়েছেন, বিত্তবান হয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করে তাকে ব্যবসায়গুলোকে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। তার এক দুই টাকার ব্যবসায় নয়। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। তার নিকটাত্মীয় বলতে যারা ছিল তাদের সাথে তিনি একসময় একটা দূরত্ব তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতেও সন্দিগ্ধতার এই দূরত্ব দূর করার কোনও প্রকার চেষ্টা তিনি কখনো করেননি। তাই রীতিমত একাই এই বিশাল ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তিনি। মাঝে মাঝে অনেক কঠিন, নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তও তাকে নিতে হয়। তিনি অত্যন্ত শান্ত মাথায় তার ব্যক্তিগত একাধিক সচিবদের সাথে আলোচনা করে সেই সিদ্ধান্ত গুলো নেন। বলা বাহুল্য সেইসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তার ছেলে তার পাশেই থাকে।
আজকের শরতের উজ্জ্বল, উষ্ণ দিনটি রহমান সাহেবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। তাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত দিতে হবে আজ। কয়েকদিন যাবৎ এক লোক নানাভাবে তাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে যে সে লোকের কাছে নাকি কিসব তথ্য আছে, যেসব নাকি প্রমাণ করবে- রহমান সাহেব কত টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন, কাকে কাকে ঘুষ দিয়েছেন, কি কি দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন কিংবা অন্যায়ভাবে কাকে কিভাবে মামলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন ইত্যাদি। প্রমাণ সরূপ কিছু তথ্যও সে রহমান সাহেবকে পাঠিয়েছে।
এ ধরণের হুমকি-ধমকি রহমান সাহেব আগেও পেয়েছেন। এসবকে তিনি কখনই ভয় পাননি। এবারও পেলেন না। কিন্তু এবারের বিষয়টি আগের যে কোনও বিষয় থেকে ভিন্ন। তাই তিনি ভীত না হলেও, চিন্তিত। এই লোকের তথ্য বেশ শক্তিশালী। তবে তার চিন্তিত হওয়ার কারণটা অন্যখানে। শুরুতে, মোটেও বিচলিত না হয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তথ্য উপাত্তগুলো কিনে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। টাকার অংক শুধু মোটা ছিল না। চমকে দেওয়ার মত মোটা ছিল।
কিন্তু রহমান সাহেবকে দারুণ বিস্মিত করে সেই লোক টাকা নিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পরিবর্তে সে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিচ্ছে! সে রহমান সাহেবকে জানিয়েছে যে যদি রহমান সাহেব তার অন্যায়ভাবে অর্জিত বিষয়-বৈভব, টাকা উপলব্ধি করার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে দেশকে তা ফিরিয়ে দেন, ক্ষতিগ্রস্তদের খুঁজে খুঁজে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন তবেই তিনি এইসব তথ্য সহসা প্রকাশ করবে না। সে এও জানিয়েছে যে সময় সময়ে রহমান সাহেবকে এই কার্যক্রমের অগ্রগতি, হিসেবনিকেশ নিয়মিত তার কাছে পাঠাতে হবে। এবং সেইসব হিসেবনিকেশ বিচার বিবেচনা করে সে রহমান সাহেবকে তার মনোভাব সম্পর্কে নিয়মিত হালনাগাদ করবে। কিন্তু তবু কোনোভাবেই এইসব তথ্য উপাত্তের বিক্রয় হবে না। তার কাছেই থাকবে। প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও সে পুনরায় ভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হতে পারে।
রহমান সাহেব শান্ত মানুষ। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং দাম্ভিক। এ ধরণের ছেলেমানুষি হুমকি-ধমকিতে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। লোকটির ধৃষ্টতায় অভিভূত হয়েছেন। তিনি হয়ত পাত্তাই দিতেন না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তথ্য উপাত্তের যে নমুনা লোকটি পাঠিয়েছে, সেগুলোকে কিছুতেই ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। নমুনা রূপে যা পাঠানো হয়েছে শুধু সেগুলো ফাঁস হয়ে গেলেই রহমান সাহেবের এতদিনের কষ্টার্জিত প্রতিষ্ঠা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান ধুলোয় মিশে যেতে পারে। তিনি এটা হতে দিতে পারেননা। গতকাল রাতে তার পাঠানো শেষ প্রস্তাবটিও হুমকি-দাতা ব্যক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে ওনার হাতে আর কোনও পথ বাকি রইল না।
রহমান সাহেবের মাইনেতে দু একজন লোক আছে, যাদের দৈনন্দিন কোনও কাজ নেই। তারা খায়, ঘুমায় এবং কাজের জন্য রহমান সাহেবের সচিবদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করে। আজ সকালে তাদের একজনকে ডেকে পাঠানো হয়েছে রহমান সাহেবের অফিসে। স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক সন্দেহ-প্রবণ হওয়ার কারণে গুরুতর কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিতে হলে, একটু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, সেটা রহমান সাহেব নিজের মুখেই দিয়ে থাকেন। এটাই তার স্বভাব।
গতরাতে ভাল ঘুম হয়েছে তার। ঘুম থেকে উঠে সকাল সকাল গোসল সেরে, অফিসে নাস্তা পাঠিয়ে দিতে বলে প্রতিদিনের চেয়ে একটু আগেই আজ অফিসে গেলেন তিনি। কিন্তু রুমে ঢুকতেই তিনি দেখেন জ্যোতি ইতিমধ্যেই নিজের টেবিলের পেছনে বসে আছে। তার কম্পিউটার বন্ধ। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে টেবিলের পাশের জানালায় সকালের নির্মল রোদে ঝলঝল করতে থাকা বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঘাস, লতাপাতা, গাছ, জানালার শার্শি থেকে বিচ্ছুরিত সবুজাভ আলো এসে পড়েছে তার মুখে। অন্যান্য দিনের তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম- জ্যোতিকে অফিসে দেখতে পেয়ে রহমান সাহেব অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন! তিনি কি এই ছেলের জন্য শান্তি মত একটু কাজ করতে পারবেন না? রহমান সাহেবের উপস্থিতি টের পেয়ে জ্যোতি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকাল; তিনি বুঝতে পারলেন যে জ্যোতি সাথে সাথে বুঝে ফেলল যে তিনি ভীষণ রেগে আছেন এবং জ্যোতির উপরই রেগে আছেন। কিন্তু জ্যোতি সেটাকে বেমালুম উপেক্ষা করল, যেন সে এমনটাই প্রত্যাশা করছিল।
রহমান সাহেব কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের টেবিলে গিয়ে বসলেন।
“আজ ভার্সিটি যাবে না জ্যোতি?” বরফ শীতল কণ্ঠে রহমান সাহেব জিগ্যেস করেন।
“না”। সোজা-সাপটা উত্তর দেয় জ্যোতি।
তারপর আর তাদের মাঝে কথাবার্তা হয় না। কম্পিউটার ছেড়ে জ্যোতি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর রহমান সাহেব টেবিলে দিয়ে যাওয়া নাস্তা সেরে নেন।
সেই বিশেষ কর্মচারীটির তার সাথে দেখা করতে আসার কথা সকাল সাড়ে নয়টায়। কিন্তু সোয়া নয়টার দিকেই রিসিপ্সন থেকে তাকে জানানো হল যে সে এসে গেছে। ফোন রাখতে না রাখতেই তার দরজায় টোকা দিয়ে তার ব্যক্তিগত সচিব কামাল হোসেন ভেতরে ঢুকল।
“স্যার, নিয়ে আসব ভেতরে।“ জিগ্যেস করল কামাল।
আর এই ফাঁকে একটু যেন ইতস্তত করে জ্যোতির দিকে নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। চুইঙ্গাম চাবানোর মত করে তার চোয়াল দুটো নড়ে উঠল একবার।
রহমান সাহেব তার মনোভাব বুঝতে পারলেন, যদিও সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “নিয়ে আসো”।
এর কিছুক্ষণ পরেই দরজার মুখে দেখা দিল বিশাল একটি দেহ। ছয় ফুটের বেশি হবে উচ্চতায়। স্বাস্থ্যবান, তবে পালোয়ান গোছের নয়। ভুরি দেখলে বোঝা যায় শারীরিক চর্চা করে না লোকটি। চামড়ার রঙ রোদে পোড়া, লালচে কিন্তু শ্যাম বর্ণ নয়। চোখদুটো ঘুমাতুর আর নিষ্প্রভ। খাঁড়া নাকের নিচে ঠোঁটগুলো আফ্রিকান কালোদের মত ভারী আর ঝুলে পড়ায় নিচের পাটির দাঁতগুলো চোখে পড়ে।
দরজা দিয়ে ঢুকে মাথাটা ঈষৎ নিচু করে ভেতরে এসে ইতস্তত করল লোকটি। এই সময় তার পেছনে এসে দাঁড়ালো কামাল সাহেব। লোকটির সাথে মাঝারী আকৃতির কামাল সাহেবকে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোটখাটো এবং ত্রস্ত দেখাচ্ছিল।
রহমান সাহেব বিশাল-দেহি লোকটিকে ইশারায় বসতে বললেন, টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে। তাদের মিটিং খুব একটা দীর্ঘায়ত হল না। তিনি লোকটির কাছে কিছু সাধারণ খোঁজখবর করলেন। তাছাড়াও একবার জিগ্যেস করছিলেন যে সে কাকে দিয়ে কাজটি করাবে। আরও বলছিলেন কিভাবে কাজটা হবে সেটা যেন সে কামালকে বিস্তারিত জানায় ইত্যাদি। কিন্তু তাদের আলোচনার বিষয় সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তাদের ঘুণাক্ষরেও বোঝার কথা নয় যে তাদের মধ্যে কি নিয়ে কথা হচ্ছিল।
কথা শেষ হলে কিছুক্ষণ রুমটির ভেতর একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঝুলে থাকে। নীরবতার অস্বস্তি কাটাতেই বোধহয়, কামাল সাহেব “তো তো” করে উঠতে রহমান সাহেব তার চেয়ারের হাতল থেকে হাত না উঠিয়েই আঙ্গুলের ইশারায় তাঁদের অনুমতি দিলেন আর মাথা উপর নিচ দোলালেন।
মিটিং শেষ। কামাল সাহেব আর লোকটি চেয়ার ছেড়ে উঠছে; কিন্তু ঠিক এই সময় জ্যোতি যেন কিভাবে নড়ে উঠল হঠাৎ আর লোকটি সেটা লক্ষ্য করে পুনরায় চেয়ারে বসে পড়ল। মিটিং চলাকালীন পুরোটা সময় জ্যোতি কম্পিউটারে মুখ গুজে পড়ে ছিল। এমনকি কি-বোর্ডেও খুটখুট শব্দ করেনি। অন্তত সেরকমই এখন মনে হচ্ছিল অন্য সবার। এই পর্যায়ে সে নড়ে উঠতে লোকটি কিছুটা চমকে গিয়েছিল কারণ সে হয়ত আগে সেভাবে খেয়ালই করেনি জ্যোতিকে। জ্যোতি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি লোকটির দিকে তাকাল। ফর্সা, শিশু সুলভ সুন্দর চেহারার জ্যোতিকে দেখে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না। তথাপি ভীষণ দেহী লোকটা অকারণেই যেন ভরকে গেল জ্যোতির নিশ্চিত এবং আত্মবিশ্বাসী সঞ্চারণে। সেটা খেয়াল করল জ্যোতি। কিন্তু একটুও অবাক হল না যেটা রহমান সাহেব এবং কামালকে বিচলিত করল। জ্যোতি তিনজনকে যেন অসাড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এবং একটা শ্লথের মত বিরক্তিকর ধীরতায় টেবিলটাকে এড়িয়ে লোকটির কাছে এসে দাঁড়ালো।
“তোমার নাম কি?” জ্যোতি আচমকা প্রশ্ন করল লোকটিকে।
লোকটি মধ্য বয়স্ক। জ্যোতির বয়সী কারো তাকে তুমি করে বলার কথা নয়। কিন্তু জ্যোতি ভুল করে, শিশুসুলভ সরলতা থেকে নয়; জেনে বুঝে নিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকে তুমি করে সম্বোধন করল। জ্যোতির কণ্ঠের স্বাভাবিকতার কারণেই হয়ত, লোকটি বুঝতেই পারল না যে তাকে তুমি করে সম্বোধন করা হয়েছে। কিংবা এমনটাই সে আশঙ্কা করছিল।
বরং জ্যোতির প্রশ্নে লোকটি ভয়ংকর ভয় পেয়ে গিয়ে রহমান সাহেবের দিকে তাকাল। রহমান সাহেব কি বলবেন বা করবেন, কেনই বা করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। ছেলের এমন রূপ তিনি আগে কখনো দেখেননি। তার এমন স্পষ্ট ও রূঢ় কণ্ঠস্বর তিনি আগে কোনোদিন শুনেননি। তিনি বরং লোকটির মুখ থেকে চোখ সরিয়ে জ্যোতির মুখের যে পাশটা দেখা যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি হয়ত ঘরের পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
জ্যোতির প্রশ্নে এবং রহমান সাহেবের নীরবতায়, লোকটি উত্তর দিল,
“স্যার, আমার নাম ফিরোজ।“
ফিরোজ কিন্তু জানে না এই পুচকে ছেলেটা কে (এমন কি ধারণা করার মত সময়ও সে পায়নি)। তবু সে তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করল।
জ্যোতি খুব শীতল কণ্ঠে ফিরোজকে বলল, “ফিরোজ, তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে তুমি সেটা করবে না। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?”
ফিরোজ, রহমান সাহেবের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভুলে গেল। অথবা তার কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য আসছে না দেখেই হয়ত তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে ফিরোজ। সে বরং ঢোক গিলে জ্যোতিকে বলল, “জ্বি স্যার। আমি বুঝতে পেরেছি”।
এদিকে রহমান সাহেব আর কামালের দু জোড়া চোখ যেন উত্তেজনায় কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ষণ্ডা চেহারার ফিরোজের ইতিবাচক উত্তর সত্ত্বেও হঠাৎ জ্যোতির মুখে এক বিজাতীয়-অপ্রত্যাশিত- বিস্ময়কর ক্রোধের জন্ম নিলো। তার ভ্রূ যুগল ভয়ংকর ভাবে কুঁকড়ে গেল। কপাল আর নাকের চামড়া কুঁচকে কেউ কোনোদিন দেখেনি এমন একটা চেহারা লাভ করল সে। এবং চিবিয়ে চিবিয়ে অস্বাভাবিক রুক্ষ কণ্ঠে জ্যোতি বলল, “তুমি চলে যাও, ফিরোজ। এই শহর থেকে চলে যাও। কামাল আংকেল তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবে। তোমার চাকরি চ্যুতির ক্ষতিপূরণও তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে।”
ফিরোজ এতক্ষণ মাথা উঁচু করে কথা বলছিল কারণ জ্যোতি খুব কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তার। সে এখন তড়িঘড়ি ক’রে উঠে দাঁড়াতে উচ্চতায় ছাড়িয়ে গেল জ্যোতিকে। কিন্তু তাতেই বোধহয় সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে জ্যোতির কাছ থেকে দূরত্ব তৈরি করল। এবং তার সাথে সাথে যেন ক্ষণিকের জন্য হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল ফিরোজ। ধীরে, নিজেকে সামলে চোয়ালের দৃঢ়তা আর চামড়ার রঙ ফিরিয়ে এনে রহমান সাহেব আর জ্যোতিকে সালাম দিল সে। কামাল সাহেবের দিকে সালামের জন্য উঁচু করা হাত দুটো নামানোর ভঙ্গি করে মাথা কিঞ্চিৎ দুলিয়ে চলে গেল দ্রুত পদে কিন্তু অনিশ্চিতভাবে।
রহমান সাহেব আর কামাল সাহেব বিস্ময় নিয়ে যার যার জায়গায় মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে রইলেন। রহমান সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলার মত শক্তি সঞ্চয় করার আগেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জ্যোতি তাকে বলল যে সে বেরোচ্ছে। ভার্সিটি যাবে। ক্লাস শেষ হলে ফোন দিলে যেন গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। রহমান সাহেব চাবি দেওয়া পুতুলের মত সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। জ্যোতি চলে যেতেই যেন হালকা হয়ে উঠল ঘরের বদ্ধ বাতাস। রহমান সাহেব যেন আবার স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ফিরে পেলেন। যদিও এই আশাতীত স্নায়ুবিক আঘাত কখনও কাটার ছিল না। এই ছেলেটিকে পাশে নিয়ে তিনি দিনের পর দিন আনমনে কাজ করে গেছেন ভাবতেই কেন যেন তার গলা শুকিয়ে আসে। তিনি কি এই দুই হাত ছেলেটিকে ভয় পাচ্ছেন? কী কারণে? তবে এইসব নিয়ে আর কোনও চিন্তা তিনি করতে চাইলেন না। সেই স্পর্ধা তিনি হারিয়েছিলেন। তার সামনে এখন অনেক কাজ পড়ে আছে।
সেদিন থেকে জ্যোতির বাবা মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবের নির্দেশে, তার ব্যক্তিগত সচিব কামাল সাহেব বিগত যেকোনো দিনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
http://www.notun-din.com/?p=27065