২০২১ সালে ভয়াবহ প্যান্ডেমিকের কারণে সৃষ্ট পর্বতসম বাধা অতিক্রম করে আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমিয়েছে। আমেরিকাতে পড়াশুনা করতে পাঠানো অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ গতবছর উপরের দিকে উঠে এসেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২.৭% কম ছাত্রছাত্রী পাঠালেও অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগীতায় ১৭তম স্থান থেকে ৩ ধাপ এগিয়ে ১৪তম স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। দুইদেশের মধ্যে পড়াশুনার জন্য ছাত্রছাত্রী আদান-প্রদান একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কৌশল। ছাত্র-ছাত্রী অদল-বদলের এই কৌশলে দুইদেশেরই লাভ থাকে। বাংলাদেশীরা বিশ্বমানের শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের মেধার পরিচয় রাখার সুযোগ পায়, আমেরিকা এই মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করে। বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকার মত উন্নত দেশে ছাত্রছাত্রী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে একটা গর্ব করার মত অর্জন। ২০২১ সালে দেশের এই অগ্রগতিতে বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতিতে সবচেয়ে বেশী অভিনন্দন জানাতে হয় বাংলার সেসব দামাল সন্তানদের, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও রাতজাগা স্বপ্নকে বিফলে যেতে দেয়নি। বাংলাদেশ থেকে যারা বাইরে পড়াশুনা করতে আসে, তাদের বেশিরভাগই মাস্টার্স-পিএইচডি লেভেলের বিদ্যার্থী। ব্যাচেলর ডিগ্রী করতে আসা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও ফেলে দেয়ার মত না। যারাই এই পথের পথিক, ব্যাক্তিগত উদ্যোগ কিংবা পারিবারিক উৎসাহই তাদের ভরসা। নিজে থেকেই দৌড়াদৌড়ি করে, বিভিন্ন বিশেষায়িত পরীক্ষা দিয়ে, দূতাবাসের জটিল প্রক্রিয়া সামলে, ভিসা ইন্টারভিউয়ের মত কঠিন একটা ধাপ পার করে আমেরিকার ভিসা যোগাড় করে তারা। কত যে শক্ত মনের অধিকারি না হলে এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার করা যায় না, সেটা যারা এই পথ পাড়ি দিয়েছে তারাই ভাল বলতে পারে। বাংলার এই নাছোড়বান্দা দামাল ছেলেমেয়েদের জন্য রইল অশেষ ভালবাসা।
কোভিডের ভয়াবহ ছোবলে দেশের নিত্যদিনের কর্মপরিকল্পনা ধ্বসে পড়েছিল। সব সরকারি, আধা-সরকারি, এবং বেসরকারি অফিসগুলো হয় বন্ধ ছিল অথবা স্বল্প পরিসরে কোন রকমে টিকে ছিল। এর মাঝেই IELTS অথবা GRE র মত পরীক্ষাতে অংশগ্রহন করতে হয়েছে এই বিদ্যার্থীদেরকে। এসব পরীক্ষার ফী গুনতে হয় হাজারে। শুধু টাকা দিলেই হবে না, পরীক্ষায় ভাল নাম্বারও পেতে হবে। সেজন্য ৩-৪ মাস ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। সময়সাপেক্ষ ও খরুচে এইসব টেস্টের রেজাল্ট হাতে আসার পর শুরু হয় "প্রফেসর ম্যানেজ" করা। রাতের পর রাত জেগে শ'য়ে শ'য়ে ইমেইল পাঠাতে হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের একাউন্টে। এইসব প্রফেসর বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অসংখ্য ইমেইল পান প্রতিদিন। এত প্রতিযোগীতার মধ্যে একটা ইমেইলের উত্তর পাওয়াটাও অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ ইমেইলের কোন রিপ্লাই আসেনা। রিপ্লাইএর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একসময় একটা নেগেটিভ রিপ্লাই পেলেই মনে শান্তি লাগে যে, "নাহ, অন্তত কেউ একজন তো আমার ইমেইল পড়ে দেখেছে" ভেবে। বাংলাদেশের দিনের বেলা আমেরিকায় রাত। ইমেইলের রিপ্লাই পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য অনেকেই দেশের রাতের বেলা ইমেইল পাঠায়। মনে তাদের ক্ষীন আশা, ইমেইলটা যখন প্রফেসরের কম্পিউটারে এসে পৌছাবে, তখন যদি উনি কম্পিউটারের সামনে থাকেন, তাহলে অন্তত পড়ে তো দেখবেন। এরকমই অনিশ্চিত যাত্রায় দিনের পর দিন (আসলে রাতের পর রাত হবে) চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে ওরা। অনেকেই আবার নিজস্ব টাকায় পড়াশুনা করবে বলে সরাসরি ভর্তির আবেদন করে। যেভাবেই হোক, ইউনিভার্সিটি থেকে ভর্তির চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত কেউ পরবর্তী ধাপে যেতে পারে না। একটা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেবল ভর্তির চিঠি হাতে পাওয়ার পরই ভিসার জন্য আবেদন করতে পারে। ২০২০-২০২১ সালের করোনাকালীন সময় এতগুলো ধাপ পার করার বাংলাদেশী এসব স্বপ্ন দেখা তরুন-তরুনীদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কবে এম্বেসীর ভিসার ডেট পাবে আশায়। বছরের বেশিরভাগ সময়ে এম্বেসী বন্ধ অথবা স্বল্প পরিসরে চালু ছিল। অনেক শিক্ষার্থী আছে এসিস্ট্যান্টশীপসহ ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও সময়মত ভিসার জন্য দাড়াতে পারেনি। তাদের কপাল খারাপ। এত ঝামেলা পোহানোর পরেই ৮৫০০ এর মত বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী ২০২১ সালে আমেরিকা গমন করেছে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করার জন্য। স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকার জন্য তাদের জানাই সাধুবাদ।
অবাক হওয়ার মত হলেও এটা সত্য যে, বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের বাইরে পড়াশুনা করার জন্য তেমন কোন সহযোগীতা প্রদান করে না। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাইরে পড়াশুনা করার জন্য আলাদা প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু বাংলাদেশী নাগরিকরা বাইরে পড়তে যেতে চাইলে সবকিছু নিজে নিজেই ব্যবস্থা করতে হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, সরকার এইক্ষেত্রে কি করতে পারে?
চাইলে করতে পারে অনেককিছুই। লিস্ট অনেক লম্বা হবে কি কি করতে পারে তার। তবে আমার মতে, এই লম্বা তালিকার সবার উপরে আছে, এইসব বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করা। এই ঋণের ব্যবস্থা করলে বাংলাদেশের লাভ হবে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ এর ভিত্তি করেই দেশের আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য হিসাব করা হয়। দেশী ভাইবোনেরা বিদেশে ভাল পজিশনে চাকরি করতে পারলে রিজার্ভের পরিমান বেড়ে যাবে কয়েকগুন। উদাহরন হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে কিভাবে ওরা বহির্বিশ্বে তাদের পায়ের ছাপ রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এইক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। এটা সত্য যে ২১ সালে আমরা ৩ ধাপ এগিয়ে গিয়েছি। সরকারী সহায়তা থাকলে এই তিন তিনে আটকে না থেকে ছয় কিংবা নয় হতে পারত।
বেসরকারী অনেক সংস্থা এইক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করে থাকে। বিশেষ করে ফেসবুকভিত্তিক দুটো গ্রুপ বিগত ৩-৪ বছরে প্রচুর পরিমান ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তথ্য ও উৎসাহ দিয়ে সহযোগীতা করেছে। গ্রুপ দুটো হলঃ
১. NexTop-USA (Higher study in USA)
২. HigherStudyAbroad - Global Hub of Bangladeshis
এর বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের নেটওয়ার্কও এই সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য একটা মাধ্যম। আমেরিকান এম্বেসীর উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন শহরের তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা করা হয় বিদেশ গমনেচ্চুদের বিনাখরচে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে। নিচের তালিকায় উল্লেখিত এসব তথ্যকেন্দ্র এম্বেসীর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।
১. American Center at U.S. Embassy Dhaka
২. Edward M. Kennedy (EMK) Center for Public Service and the Arts located in Dhanmondi, Dhaka
৩. American Corner Chittagong (at Chittagong Independent University, 12 Jamal Khan Road Chittagong – 4000)
৪. American Corner Khulna (at Northern University of Business and Technology Khulna KhulnaCampus, Shib Bari More, Khulna)
৫. American Corner Sylhet (at Sylhet International University Shamimabad, Bagbari, Sylhet)
৬. American Corner Rajshahi(at Varendra University House No# 532, Jahangir Shoroni, Talaimari Rajshahi-6204).
সবশেষে বলতে হয়, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় সেটা বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা আরেকবার প্রমান করেছে বিশ্ববাসীর দুয়ারে। বাংলাদেশের জন্য রইল অশেষ শুভকামনা। সঙ্গীতের যুবরাজ আসিফের সাথে গলা মিলিয়ে বলব, ভালবাসা অবিরাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ভোর ৬:৪৩