আমাদের অর্থনীতিতে সরকার সবসময়ে পিতৃত্ব মার্কা একটা ভঙ্গ ধরবার চেষ্টা করে। এমন একটা ভাব যেন হাজার হাজার উদ্যোক্তা আর শ্রমিকের পেটের ভাতের দায়ে নেয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে এসিরুমে বসে ভুল অংক কষে অর্থ মন্ত্রণালয় মহত্তর কোন পলিসি বের করে ফেলবে। সেই অপসংস্কৃতির ধারায় এইবছরও বাজার চাঙ্গা করার পাঙ্গা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মালসাহেব খেয়াল করেছেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে অনেকগুলা টাকা পড়ে রয়েছে যেগুলো বিনিয়োগ হচ্ছেনা। কাজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রাখলে ৮০০ টাকা কর কেটে রাখবেন। বাহ! কি চমৎকার বুদ্ধি! যেহেতু এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেই সরকার টাকা মেরে দেয়, তাইলে অবশ্যই মানুষ এখন সেই টাকা বিনিয়োগ করতে বাধ্য! মারাত্মক পরিকল্পনা।
এই প্ল্যান এক্কেবারে অব্যর্থ-হইতো যদি কোন আমানতকারীর বাসায় তোষক না থাকতো। কিন্তু তোষক থাকার কারণে এখন যেটা হবে-সেটা হল এই ব্যাংকে থাকা টাকাগুলো উইথড্র হয়ে তোষকের মাঝে ডিপোজিট হবে।
এইযে তোষকে টাকা ভরে রাখা-এইটাই কিন্তু বরং বাংলাদেশের একটা বড়ো সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে আসছে এই তোষকের টাকাগুলো ব্যাংকে আনতে। কারণ ব্যাংকে আসলে সেই টাকা দিয়ে লোন দেয়া যায় আর লোন দেয়া গেলেই সেই টাকা বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু এইযে মালসাহেব কর বসাইলেন, তার ভারে হয়তো বেচারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কষ্ট ভেস্তে যাবে।
আমার আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্যে খুব মায়া লাগে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক হইলো আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের টিনএজ বাচ্চার আম্মুর মতন। সারাদিন অর্থমন্ত্রণায় এখানে জুতা, ওইদিকে ব্যাগ আর সেইদিকে জামা ফেলে দুনিয়া নোংরা করে বেড়াবে- আর বাংলাদেশ ব্যাংক যাবে পিছনে পিছনে পরিষ্কার করতে। আবার ঠিক যখন কোনকিছু একটা উল্টাপাল্টা হবে-তখন দোষ পড়বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর।
এই বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে মাথা কুটতেসে যাতে মানুষ লোন নিয়া বাজারে ইনভেস্ট করে। সুদের হার রাখা হইসে যথাসম্ভব নিম্ন পর্যায়ে-তারপরেও মানুষ লোন নেয়না, ইনভেস্ট করেনা। কেন করেনা? কারণ ডুইং বিজনেস র্যাংকিঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান একশ ঊননব্বইটা দেশের মাঝে একশ আটাত্তর। এই মুহুর্তে বিশ্বের দরিদ্রতম বুরকিনা ফাসো, সিয়েরা লিওন, নাইজার, ইথিওপিয়া আর যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব তিমুর আর সিরিয়ার থেকেও পিছায়ে আছে বাংলাদেশ! এমন অবস্থা যে অনন্ত জলিল সাহেবের মতন উদ্যোক্তারা যদি এখন পম গানা হতেন, তাহলেই হয়তো তারা আরো সহজে ব্যবসা করতে পারতেন।
এর পরেও মালসাহেবরা ভাব ধরবে যে এই সরকার সবচেয়ে বেশি উদ্যোক্তাবান্ধব! অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময়ে এই র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ছিলো ১১৫ তে এবং তার পর থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ শুধুই পিছিয়েছে। বাংলাদেশে এখনও একটা কনস্ট্রাকশন পারমিট পাইতে সময় লাগে ২৭৮ দিন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সময় লাগে ৪০৪ দিন আর সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন করাতে সময় লাগে ২৪৪ দিন যেটা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার এভারেজের চেয়ে সব ক্ষেত্রে শুধু বেশিই না-প্রায় দ্বিগুণ।
তাহলে কেন এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছেনা? কারণ সরকারের একগাট্টি টাকা খরচ করতে হচ্ছে দ্য স্ক্যান্ডাল কুইন-রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বাচায়ে রাখতে। এখনো পর্যন্ত গত সাত বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো থেকে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে। এতোগুলো কেলেঙ্কারি এ পর্যন্ত ঘটেছে যে এক নিশ্বাসে এর সবগুলো বলে ওঠা কঠিন ব্যাপার। তারপরেও একটা তালিকা দেয়ার চেষ্টা করা যায়-প্রিয় পাঠক-চেষ্টা করুন তো একদমে সবগুলো শব্দ করে বলে শেষ করতে।
রেডি? এক, দুই, তিনঃ সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের চার হাজার কোটি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, বেসিক ব্যাংকের ৪৯৩ কোটি ১৩ লাখ অযাচাইকৃত ঋণ প্রদান কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংক থেকে ১২ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ওয়েস্টমন্ট পাওয়ারের মালিকের অন্তর্ধান, ২০০৬ সালে হাওয়া ভবন সম্পৃক্ত মানুষজনের ৫৯৬ কোটি টাকা তছরুপ, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি।
এতোগুলো বেহিসাবি ঋণ দেয়ার পরেও এই সবগুলো ব্যাংক বাজারে টিকে আছে কারণ প্রতি বছরে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে এদের মূলধন পূনর্গঠন করে দিচ্ছে। এই বছরেও কৃষক আর দিনমজুরের ভ্যাটের ১৫ হাজার কোটি টাকা এইসব ব্যর্থ ব্যাংকগুলাকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে যারা এইসব ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ভেগে যাচ্ছে-তারা সম্ভবত সরকারের হোমবয়। কাজেই হোমবয়দের সোয়্যাগ করার জন্যে যাতে টাকার ঘাটতি না পড়ে জনগণের পকেট মেরে সেটা নিশ্চিত করাই তো মাল সাহেবদের দায়িত্ব। আর যখন এইসব ব্যাংকের লোকজন জানেই যে বুগিচুগি ঋণের টাকা ফেরত না পাইলেও পয়সা ফিরায়ে দিতে সরকার সর্বদা প্রস্তুত থাকবে, তখন আর তাদের বুগিচুগি ঋণ দিতে সমস্যা কি? পশ্চিমারা এইটাকে বলে মোরাল ক্রাইসিস, আর আমরা বলি রাবিশ এবং বোগাস!
অথচ এইসব বুগিচুগির দশভাগের একভাগ করলে কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো মারা খেয়ে গাছে উঠে যাইত। তাদের একটু বাজারে থাকার সুযোগ দিলেই তারা লস খেয়ে পথে বসতো, কিন্তু তার বহুত আগেই সরকার এসে তাদের কোম্পানি খেয়ে দিতো- সরকারি ভাষায় যেটাকে আমরা বলি 'রাষ্ট্রায়ত্ব করে ফেলা'। গ্রামীণ ব্যাংককে তো খেয়ে দেয়া হইসে সেই ব্যাংকের এমডি সাহেব রাজনীতিতে প্রবেশ করবার ঘোষণা দেয়ার জন্যে। সেইখানে এইরকম একটা কেলেংকারী হইলে নিশ্চিত মাল সাহেব ইউনূস সাহেবকেই রান্না করেই খেয়ে ফেলতেন!
অবশ্য ইউনুস সাহেবের উপর মাল সাহেবের রাগ আজকের নয়। বাংলাদেশের সকল সমস্যার জন্যে তিনি প্রায়ই ইউনূস সাহেবকে দায়ী করেন। ২০১২ সালে তিনি দাবি করেছিলেন যে ইউনূস সাহেবের জন্যে নাকি বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ হচ্ছেনা। অবশ্য এখন তিনি সেইখান থেকে সরে এসে বলছেন যে সব কালো টাকার দোষ।
কিন্তু টাকা আবার কালো কেমন হয়? এই টাকার পূর্বপুরুষ কি আফ্রিকা থেকে আগত? ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম না। টাকাকে তখনই কালো বলা হয় যখন মানুষ সেই টাকার উপর ট্যাক্স দেয়না। এখন সরকার যদি সেই টাকার গন্ধ পায়-তাইলে তো সরকার সেটা মেরে দিবে। কাজেই যারা কালো টাকার মালিক-তারা সেই টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ইনভেস্ট করে।
কেনো ইনভেস্ট করে জানেন? কারণ সিঙ্গাপুরে কর্পোরেট ট্যাক্স রেট ১৭ পারসেন্ট যেইটা বাংলাদেশের ট্যাক্স রেটের অর্ধেকেরও কম। এবং শুধু সিঙ্গাপুর নয়, এশিয়ান টাইগার ইকোনমির সবগুলোতেই সর্বনিম্ন পরিমান ট্যাক্স কেটে বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতির তৈরি করা হয়েছে যার কারণে দেশের এবং বিদেশের সব বিনিয়োগকারীরা সেই অর্থনীতির দিকেই ছুটছে।
আর এইদিকে আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের সাহস আর গার্মেন্টস কর্মীদের পরিশ্রমে ভর করে যে নতুন এশিয়ান টাইগার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে-একের পরে এক ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে সেই স্বপ্নকে ভেস্তে দেবার অবস্থা সৃষ্টি করছেন মালসাহেব। যেসব খাত থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছি, সেইসব খাতের থেকে উৎস কর কেটে নেয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে সেই খাতসংখ্যা গতবছরের ৫২টা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬১ টি। যেই গার্মেন্টস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, সেই গার্মেন্টস খাতের উপর বাড়তি কর চাপানো হয়েছে। যেই ফাস্টফুড ইন্ডাস্ট্রিতে হাজার হাজার তরুণ এখন সাহসে বুক বেধে অর্থ বিনিয়োগ করছে তার উপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসানো হচ্ছে। এমন একটা অবস্থা দাড়িয়েছে যেটা দেখে মনে হয় সরকার ইচ্ছা করে দেখে শুনে বুঝে যেইসব ব্যবসা কিছুটা উন্নত হয় সেইসব ব্যবসার উন্নতি পাংচার করে দিয়ে লাভের পয়সা মেরে আনার চেষ্টা করে।
অথবা এইটাও হইতে পারে যে ফুডব্যাংক গ্রুপের চকচকে রিভিউ পড়ে চাপ সামলাও তে খেতে গিয়ে মাল সাহেব চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে দেশী গার্মেন্টস থেকে কেনা পায়জামা নোংরা করেছেন এবং অতঃপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এই দুই খাতের উপর ট্যাক্স বসানোর চেষ্টা করেছে। কোন ঘটনাটি আসলে ঘটেছে সেটা নাহয় পাঠকই ভেবে দেখুক।
কিন্তু এই যে সরকার এত্তো এত্তো কর আদায় করছে-কেনো করছে? এই পয়সা কোথায় যাচ্ছে? এই পয়সা দিয়ে কি জনগনের শিক্ষা, চিকিৎসা অথবা অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হচ্ছে? তা কিন্তু হচ্ছে না। শিক্ষাখাতে এইবছরো বরাদ্দ বাজেটের ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশতে আনা হয়েছে যা কিনা ইউনেস্কো এবং বাংলাদেশের শিক্ষাবিদদের সুপারিশ করা ২০ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু এই ১২ শতাংশের মাঝেও অর্থাৎ বরাদ্দকৃত ৫০ হাজার কোটি টাকার মাঝে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকাই ব্যয় হবে অনুন্নয়ন খাতে-অর্থাৎ বেতন ভাতায়। তারপরে আর শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্যে তেমন কিছুই থাকছে না।
এবং অনুন্নয়ন ব্যয় শুধু শিক্ষাখাতেরই নয়-বরং সমগ্র বাজেটেরই একটা বিশাল অংশ দখল করে বসে আছে। আদায়কৃত করের ১১ শতাংশ অর্থাৎ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের প্রায় সমান অংশ যাচ্ছে সরকারী আমলাদের বেতন-ভাতা আর পেনশনে। কেনো? যাতে করে আমলা মহল থেকে সরকারী কর্মকান্ডের কোন প্রতিবাদ না আসে। কারণ আমলারা যদি মন্ত্রীসান্ত্রীদের হয়ে কামলা খাটা বন্ধ করে দেয়-তাহলে সরকার যতই হম্বিতম্বি করুক-আর এই দেশের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না।
তাইলে বুঝেন আপনি সরকারের স্ট্র্যাটেজি! একদিকে শিক্ষায় বরাদ্দ কমায়ে আধাখেঁচড়া আমলা পয়দা করবে এরপর তাদের বেতনে বেশি বেশি বরাদ্দ রেখে তাদের মাঝে বিপ্লবের উত্তেজ দমন করবে। এই একই বুদ্ধি মেনে কিন্তু আরেক মহারাজ ক্ষমতায় টিকে থেকেছিলেন। তিনি হলেন হীরক রাজা। তিনি বলতেন-এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে!
কিন্তু হীরক রাজার গলা থেকে মুক্তার মালা খুলে দেয়ার মতন আমলাদের বারে বারে বেতন বাড়ায়ে দেয়াটাও ভীষণ একটা ভাঁওতা কারণ বাড়তি বেতনের পয়সা দিয়েও বাড়তি জিনিস কেনা যাচ্ছেনা। তার কারণ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি। সরকারকে এইটা নিয়ে গুতাইলেন দেখবেন গড়গড় করে তোতাপাখির মতন বলে যাচ্ছে যে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কিন্তু যেই জীবনে মৌলিক ইকনমিক্স পড়েছে সে জানে যে মার্কেট পাওয়ার না থাকলে সিন্ডিকেট কখনো কাজ করেনা কারণ সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্যেরই চোট্টামি করে কম দামে বেচে দিয়ে বেশি লাভ হাতায়ে নেয়ার স্বার্থ থাকে। কিন্তু সিন্ডিকেট কাজ তখনই করে যখন কোন একটা ক্ষমতার পেশীবহুল প্রতিষ্ঠান সেই সিন্ডিকেটকে মার্কেট পাওয়ার দেয়। তাইলে বলেন দেখি সবচেয়ে বড়ো অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট কোনটা? ঠিক বলসেন-সরকার!
আর সেই সিন্ডিকেট যতই ইন্ডিকেট করুক, বাংলাদেশের ইকনমিস্টরা কিন্তু ধরে ফেলছেন। তার একটা কারণ হইলো যত্রতত্র বেহুদা ট্যাক্সের বোঝা চাপায়ে দেয়া-আর আরেকটা হলো বৈদেশিক ঋণ অনুদানের উপর নির্ভরশীলতা।যখন দেশে বিনিয়োগ বাড়েনা আর একই সাথে বিদেশ থেকে অর্থনীতির সহ্যক্ষমতার অতিরিক্ত পয়সা এনে জোর করে ঠুইসসা ঢুকানো হয়-তখনই এই মূল্যস্ফীতিটা ঘটে। সেই দুই ঝামেলার কিছুই কিন্তু এই বাজেটে কমেনাই-দুইটাই বাড়সে। এই বাজেটে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হইসে যেটা কিনা গত চার বছর মিলায়েও আনা যায়নাই।
আসলে সরকার মজা পাইসে। কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া আর চায়নার মাঝে কাইজ্জা লাগায়ে দিয়ে দুইদিক থেকেই পয়সা নিয়ে মনে করতেসে যে এই কাজ আরও করে ইচ্ছামতন বাজেট ফুলায়া ফাঁপায়ে তোলা যাবে। কিন্তু এইযে অনুদান আর ঋণ দেখা যায়, এগুলা কিন্তু ফ্রী আসে না। এগুলার সাথে অনেক প্রত্যক্ষ শর্ত আর পরোক্ষ গর্ত থাকে। যেমন কিনা ইন্ডিয়ার থেকে দেদারে টাকা আনার কারণে সরকার যে চাপে আছে সেই চাপে পড়ে সরকার কয়দিন আগে বিনা টেন্ডারে ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপকে ৮১ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দিয়ে দিসে। আর আইএমএফ বিশ্বব্যাংক থেকে নিলে তো আর দেখতে হবে না-স্ট্রাকচারালি এডজাস্ট করে একেবারে বাংলাদেশের উন্নতিরে এক্কেবারে দাবড়ায়ে দেবে।
আর যে অনুদান বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ পাচ্ছে, সেটা পাচ্ছে দেশটারে অনুন্নত গরীব দেশ দেখায়ে দেয়ার কারণে। কিন্তু যখন বাংলাদেশের এই হাড়াভাতে গরীব মানুষ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে অর্থনীতিকে সোজা করে দাড়া করায়ে দিবে, তখন কিন্তু আর এই অনুদান পাওয়া যাবেনা। কাজেই এই যে সরকার প্যান্টের ইলাস্টিকের মতন টেনে টেনে একটা আমলাতন্ত্রকে বড়ো করতেসে-অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে কি এই ঢিলা হয়ে যাওয়া আমলাতন্ত্রকে আর টাইট দেয়া যাবে? সেইসময়ের পরিকল্পনা তো সরকারের কাউকে করতে দেখিনা।
শুধু সরকারদল না-সরকাররের বাইরের দলের কেউও কিন্তু এখনকার বুম পিরিয়ডের পরের সম্ভাব্য বাস্ট পিরিয়ডের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেনা। সম্প্রতি বিএনপি যে ভিশন ২০৩০ বের করেছে সেখানেও ট্যাক্স কমানোর কথা বা আমলাতন্ত্রকে ছোট করে আনবার কথা বলা হচ্ছেনা। বরং ন্যায়পাল মার্কা অদ্ভুত অদ্ভুত নতুন আমলা পয়দা করার গল্প করা হচ্ছে।কাজেই যদি আমাদের সামনে সত্যিই একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে তখন আমাদের কারো দিকেই তাকানোর মতন থাকবে না।
সরকার উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন করছে-তাতে কোন সমস্যা নেই। সব সরকারই উচ্চাভিলাসিতা দেখানোর অদ্ভুত বিলাসিতা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু আমাদের এই বাজেট সরকারী উচ্চাভিলাসিতারই বাজেট হয়ে দাড়িয়েছে- সেটাতে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে কম। সরকারী অর্থনীতি আর সরকারী বিনিয়োগের ভিড়ে চাপগ্রস্থ ট্যাক্সগ্রস্থ বেসরকারী বিনিয়োগের হারিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে আর কোনমতে দেশীয় বিনিয়োগ থেকে তৈরি হওয়া পণ্য যাতে খেটে খাওয়া মানুষ কিনে ব্যবহার করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে ভ্যাট আর উৎস কর বসানো হয়েছে।
কিন্তু কেনো এই ভ্যাট আর আবগারী শুল্ক নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করতে পারছি না? কারণ মালসাহেব ইচ্ছা করে আমাদেরকে বিভাজিত করছেন। একটা অদৃশ্য দ্বন্দ আমাদের মাঝে তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন যে যার ব্যাংকে এক লাখ টাকা আছে সে বড়লোক-তার থেকে ট্যাক্স মেরেই দেয়া যায়-কিন্তু সেই ট্যাক্সের টাকা দিয়ে গরীবের সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। ১৫% পর্যন্ত ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাচ্ছেন পণ্যের দাম আর ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করতে চাইলেই তিনি ভয়ংকর কুৎসিতভাবে তাদের দমন করবার কথা বলছেন।
আমাদের এই রাজনৈতিক শ্রেনী প্রায়শই ভাব ধরে যা তারা রবিনহুড গোত্রের কেউ। তারা ভাব ধরে যে ধনীরা খুব খারাপ মানুষ আর সুমহান সরকার এসে ধনীর টাকা গরীবদের দিয়ে দেবে। কিন্তু সত্যিকারে সরকার ধনী আর গরীব উভয়ের থেকে টাকা নিয়ে নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে সবধরণের অপ্রয়োজনীয় অনুন্নয়ন ব্যয় করে বেড়ায়। সত্যিকারের রাজনৈতিক শ্রেনী তাদের পেশিশক্তির দেমাগ দেখিয়ে দেশের সাধারণ জনগণকে বারবার লুটে নেয়।
কাজেই আমাদের একত্র হতে হবে এই রাজনৈতিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। তারা যাতে কোনভাবে আমাদের মাঝে বিভাজন তৈরি করতে না পারে। যে অর্থনীতি আমাদের সাহসী উদ্যোক্তা আর পরিশ্রমী শ্রমিকেরা গড়ে তুলেছে-সেই অর্থনীতি যাতে কোনভাবেই সুবিধাবাদি রাজনীতিবিদেরা এসে ধ্বংস করতে না পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা বুঝতে পারবো যে আমাদের সেই একাত্তরের মতন আমাদের আজকের সংগ্রামও মুক্তির সংগ্রাম। লাগামছাড়া ক্ষমতাধর উদ্যোক্তা আর শ্রমিকের থেকে একাধারে শোষণ করে যাওয়া পেশিশক্তিশালী রাজনীতিবিদদের থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেবার সংগ্রাম।
আমরা যাতে সেই লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে পারি আর রাজনীতিবিদদের শোষণের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বলতে পারিঃ রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে জনতা!
সবাইকে ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৭ ভোর ৬:৪৯