নীলফামারীর সৈয়দপুর দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা, বিমানবন্দর, সফল ব্যবসাবান্ধব শহর ও শিক্ষানগরী হিসাবে পরিচিত হলেও ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে ব্রিটিশ আমলে তৈরি চিনি মসজিদের উপস্থিতি সৈয়দপুরের পরিচিত আরো বহুগুন বৃদ্ধি করেছে। চিনা মাটির তৈরি মসজিদের ছাদে ছোট ছোট অসংখ্য মিনার মসজিদটিকে দুর থেকে তার সৌন্দর্য’র যেন জানান দেয়। ভ্রমন পিপাসুদের জন্য চিনি মসজিদ হচ্ছে অন্যতম খোরাক বলে আজও বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশী অনেকেই আসেন এক নজর এই স্থাপনাকে দেখার জন্য। আগে কখনো দেখেননি এমন লোক পাশ দিয়ে গেলেই তিনি থামতে বাধ্য হন, পাশে বসে কিছু সময় ব্যয়, মসজিদের পাশে ছবি তোলা আগতদের যেন আজও বাধ্য করে চিনি মসজিদটি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় ২ কিলো উত্তরে চলে যাওয়া সৈয়দপুর-নীলফামারী রাস্তা ঘেষেই শহরের ইসলামবাগ মহল্লায় মসজিদটি অবস্থতিত। আপনি যদি রেলওয়ে স্টেশনে নেমে মসজিদ গন্তব্যে যেতে চান তাহলে সেখান থেকে মাত্র ১০টাকা রিক্সায় আর অটোবাইকে গেলে ৫ টাকা খরচ পড়ে। আর যদি আপনি ভ্রমন বাসে করেতে চান তাহলে সৈয়দপুর শহরে মোট তিন যায়গায় বাসে করে যাত্রী উঠা নামা করে এক-কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, দুই-ওয়াপদা মোড়, তিন-রাবেয়া মোড়। এই তিন যায়গার মধ্যে ওয়াপদা মোড় থেকে সবচেয়ে নিকটে পড়ে ঐতিহাসিক চিনি মসজিদ। আপনি যদি বাস সার্ভিসের যাত্রী হন ওয়াপদা মোড়ে নামবো বললেই বাসওয়ালা আপনাকে সেখানেই নামিয়ে দেবে, আর যদি ভুলক্রমে টার্মিনাল বা রাবেয়া মোড়ে নামে তাহলে চিনি মসজিদ যেতে আপনাকে কিছুটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। কারন বাসটার্মিনাল থেকে মসজিদ পর্যন্ত আপনার ভাড়া পড়বে ৩০-৪০ টাকা, ঠিক তেমনি রাবেয়া মোড় থেকেই একই ভাড়া গুনতে হবে যদি সেখান নামেন। সেখানে ওয়াপদা মোড়ে নামলে অটো বা ভ্যানে মাত্র ৫ টাকা আর রিক্সায় মাত্র ১০ টাকা খরচ লাগবে।
ঐতিহাসিক মসজিদটির স্থাপনা ও অসাম্প্রদায়কিতার এক অন্যান্য নমুনাঃ
সৈয়দপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র সৈয়দপুর প্লাজা থেকে মাত্র ৫ টাকা অটো ভাড়া করে মসজিদের উদ্দেশ্যে গেলাম। সৈয়দপুর থেকে নীলফামারী যাওয়ার রাস্তার পাশেই শহরের ইসলাম বাগ মহল্লায় মসজিদটি অবস্থিত হলেও লক্ষ্য করলাম এলাকাটি চিনি মসজিদ এলাকা নামে পরিচিত। পুরো মসজিদটির গায়ে চিনা মাটির ছোট ছোট টুকরা দ্বারা আবৃত বলে মসজিদটি চিনি মসজিদ নামে পরিচিত লাভ করে। আপনাকে সেখানে যে জিনিসটি সবচেয়ে মুগ্ধ করবে সেটা হচ্ছে মসজিদের এরিয়াতেই অর্থাত একটি জমিতেই মসজিদ আর খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কবরস্থান অবস্থিত এবং এর দেখাশোনা, খ্রিষ্টানদের কবর খনন দাফন একজন মুসলমানই করে থাকে।এ যেন অসাম্প্রদায়িকতার এক অন্যান্য নিদর্শন। এবং তারচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িকতা মসজিদটি যেকারনে বহন করছে যে এই মসজিদটি যে মিস্ত্রি নির্মান করেন তিনি ছিলেন একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু। শুঙ্খ মিস্ত্রি ছিল উনার নাম।
মসজিদে অবস্থানকালে মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে যা জানতে পারলাম-
↓
পটভুমিঃ
১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের কথা। কয়া-৯ নম্বর এলাকায় অর্থাৎ সৈয়দপুর শহরের এই ইসলামবাগ এলাকায় তখন কোন মসজিদ ছিল না। উক্ত এলাকার বাসিন্দা হাজী বকর আলী ও হাজী মোখখু কিছু লোকজন নিয়ে পার্শ্ববর্তী মহল্লার বড় মসজিদে যেতেন নামাজ পড়তে। তাই তারা এলাকাবাসীর কাছে নতুন মসজিদ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সবাই সম্মত হলেন প্রথমে তৈরি করা হয় খড়েড় মসজিদ, পরবর্তীতে টিনের। পরে মসজিদকে আরো উন্নত করার জন্য তহবিল গঠন করা হয়।
↓
তববিল গঠনঃ
তখন দুই হাজী, হাজী বকর আলী ও হাজী মোখখু মিলে মহল্লবাসীকে ডেকে তাদের মধ্য থেকে ৬ জন সর্দার নির্বাচন করলেন। প্রত্যেকের অধীনে ৪০ জন করে লোক দেওয়া হয়। এই সরদারগন প্রতি ঘর থেকে তখন দৈনিক এক মুঠো করে চাল সংগ্রহ করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার এই চাল বিক্রি করে টাকায় পরিণত করা হত। এভাবে কিছু টাকা জমা হয়। মহল্লাবাসির সিদ্ধান্তে মসজিদের দালান তৈরি করা হল। মসজিদের উন্নয়নের স্বার্থে এলাকাবাসী স্বেচ্ছায় তাদের ১ মাসের পুরো বেতন দান করেছিলেন বলে জানায় যায়। উল্লেখ্য তখন মাসিক বেতন ছিল ১৩-১৫ টাকা। মসজিদ প্রতি বছর চুন করা হত।
↓
মসজিদের নির্মানকালের ইতিহাস:
মসজিদের ইতিহাস থেকে জানা যায় মসজিদটি যে মিস্ত্রি প্রথম নির্মান করেন তিনি ছিলেন একজন হিন্দু যা অসাম্প্রদায়িকতার আরেক নিদর্শন।মসজিদটি নির্মান করেন শুঙ্খ নামের এক হিন্দু মিস্ত্রি।
তার পারিশ্রমিক ছিল দিন প্রতি ১০ আনা। আর বুনিয়াদ প্রথমে ৩০” তারপর ২০” ও উপরে ১৫”। মসজিদটি তৈরি করতে কোন সহকারি মিস্ত্রির প্রয়োজন পড়েনি তখন। মহল্লাবাসী নিজেরাই এ কাজ সম্পাদন করেন।
↓
মসজিদের গঠনঃ
সে সময় কোন সিমেন্ট ছিল না বলে তখন সুরকি ও চুন দিয়ে গাথুনি দেওয়া হয়। মহল্লার মহিলাগন ঢেকি কুটে সুরকি তৈরি করে মসজিদ নির্মানে পুরুষদের কাধে কাধ মিলিয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন বলে জানা যায়। মহল্লার কিছু লোক তখন কোলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে দেখলেন চীনা কোম্পানির চিনামাটির তৈরি প্লেটের টুকরা পড়ে আছে। কোম্পানির অনুমতি সাপেক্ষে তারা সেগুলো নিয়ে আসেন। শুঙ্খ মিস্ত্রি এবং মহল্লাবাসী মিলে সিমেন্ট দিয়ে সেগুলো মসজিদের দেওয়ালে লাগালেন। তবে এই মসজিদের নকশাকারী ছিলেন মোঃ মখতুল এবং নবী বক্স।
মসজিদটি দুই ভাগে বিভক্ত-
১।– বৃটিশআমলে নির্মিত।
২।– পাকিস্তান আমলে নির্মিত।
প্রথম ভাগটির মেঝেতে মরমর পাথর বিছানো আছে। মসজিদের ডানদিকে বিছানো এই মরমর পাথরটি এলাকাবাসী কোলকাতা থেকে প্রতি টুকরা ৬ টাকা করে কিনে এনেছিলেন। কোলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এখানে এসে পাথরগুলো বসিয়ে যান। বৃটিশ আমলে তৈরিকৃত অংশটুকুর মোট নির্মান ব্যয় ছিল ৯৯৯৯ রুপিয়া ১০ আনা।
দ্বিতীয়ভাগটির মেঝেতে এ ধরনের কোন পাথর নেই। এ ভাগের তৈরিতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন এলাকার তৎকালীন সদর ও সেক্রেটারী জনাব মোঃ ওসমান, মোঃ সুফি, মোঃ ইয়াজদানি, মোঃ মফিজ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
↓
মসজিদ ছোট হওয়ার কারনঃ
মসজিদের পশ্চিম দিকে একটা বাড়ী ছিল। বাড়ির মালিক মোঃ গাউসিয়া জায়গাটি দিতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া সে সময় বৃটিশ সরকার সেখানকার সব বাড়ি সরিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে আসে। সে জায়গায় বৃটিশ সরকার খ্রীষ্টানদের কবরস্থান বানায় যা আজও বর্তমান আছে। তাই সামনে
মেইন রাস্তা ও পিছনে খ্রিষ্টান কবরস্থান থাকায় মসজিদ ছোট হওয়ার মূল কারন।
↓
মসজিদের নামকরণঃ
মসজিদটি তৈরি করতে আরও যে ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন হাজী বকর আলীর পুত্র
হাজী হাফেজ আব্দুল করিম। তিনিই সর্ব প্রথম গোলাহাট রেল লাইনের দু’পাশে কবরস্থানের ব্যবস্থা
করেন। ঐতিহাসিক এই চিনি মসজিদের প্রথম ইমাম ছিলেন মৌলভি আব্দুল্লাহ এবং প্রথম মুয়াজ্জিন জুম্মন মিয়া। মাস্টার ইসরাফিলের ভাই ও আব্দুল গফুরের পুত্র হাফেজ ইদ্রিস এলাকার নতুন নাম করেন ইসলাম বাগ। মসজিদের দেওয়ালে লাগানো চিনা মাটির টুকরার প্রতি খেয়াল রেখে মসজিদের নামকরন করা হয় চিনি মসজিদ।
মসজিদের বর্তমান অবস্থাঃ
ব্রিটিশ আমল তারপর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বে এই মসজিদটির উন্নয়নমূলক ও আরও নতুন নুতন আলোকসজ্জার ব্যবস্থার কাজ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে মুসল্লি বেশি হওয়ায় মসজিদটিকে ডাকদিকে আরো বর্ধিত করা হচ্ছে। মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটির পুরো ছাদ কারুখচিত ছোট বড় মিনার দ্বারা আবৃত। মসজিদটি বর্তমানে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দ্বারা সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ভবিষ্যতে মসজিদকে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করার পরিকল্পনা আছে বলে মসজিদ কমিটির সদস্য শহরের প্রসিদ্ধ নাঁতখা জনাব হায়দার আলী হায়দার এমাদী সাহেব জানান। বর্তমানে মসজিদের খতিব ও ইমামে দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ শাহিদ আল রেজভী সাহেব।
*
যেটা না বললেই নয়ঃ
যদি মসজিদ জিয়ারতের উদ্দেশ্য কোনদিন আপনি যান তাহলে মসজিদের সামনে প্রথমে যে জিনিসটা নজরে পড়বে সেটা হলো, একটি পুরাতোন প্রতিবন্ধি ভাঙ্গচুড়া খাটের উপর বসে অস্পষ্ট আওয়াজে ভাইয়া ভাইয়া বলে কিছু সাহায্য’র জন্য আপনাকে যিনি ডাকছেন তিনি হলেন এই এলাকার অসহায় প্রতিবন্ধি নাম সালাম। তিনি এমনি প্রতিবন্ধি যিনি খাবার গ্রহন করতে অপরের হাতের সাহায্য নিতে হয়, পেশাব পায়খানা করতে অপরের সাহায্য লাগে, এখানে আসতে আবার এখান থেকে যেতে অপরের হাতের সাহায্য লাগে এই অসহায় এর। চিনি মসজিদের সাথে ইনার নাড়ীর সম্পর্ক বলে সেই ছোট কাল থেকেই আজ পর্যন্ত মসজিদের সামনেই বসে ভিক্ষা করেন তিনি। তাই যদি কোনদিন মসজিদ জিয়ারতে যেতে হয় তাহলে অবশ্যই এই প্রকৃত অসহায়কে সহযোগিতা করে আসবেন। কারন এরুপ প্রকৃত অসহায়দেরই সাহায্য করতেই বলা হয়েছে আপনাকে আমাকে......
চিনি মসজিদের একটি সুন্দর মিনার
চিনি মসজিদের অভ্যন্তরীন অংশ
চিনি মসজিদের বারান্দার অংশ
মসজিদের আরেকটি মিনার।
মসজিদের পাশেই খ্রিস্টানদের কবরস্থান।
মসজিদের সামনে অসহায় প্রতিবন্ধি সালাম
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:০৬