একজন টেলিভিশনের ক্যামেরা জার্নালিস্টের অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। বস্তিতে আগুন ধরেছে, মানুষ প্রান বাঁচাতে ছোটাছুটি করছে। যে আগুনের সাথে যুদ্ধ করে ব্যার্থ হচ্ছে, সে পুড়ে হচ্ছে কয়লা। তিনি চেষ্টা করলে হয়ত আরও দুই একজন প্রানে বেঁচে যাবে। কিন্তু তার লক্ষ্য দুজন মানুষের প্রান বাঁচানো না। আরও দুমিনিটের রগ রগে ফুটেজ ক্যামেরায় ধরা।
ট্রেন উল্টে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে চোখের সামনে। কান্না, আহাজারি, রক্ত। তিনি নির্বিকার ভাবে ক্যামেরার ফ্লাস মেরে যাচ্ছেন। চোখের সামনে বৃদ্ধ মানুষের পুলিশ লাথি বসাচ্ছে তার প্রতীবাদের ভাষা নেই। এক ফুট দূরত্বে একজন মানুষকে কিছু অমানুষ নিরন্তর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছে। তিনি ব্যাস্ত ক্যামেরার এপার্চার, সাটার স্প্রিড নিয়ে। তার মনুষ্যত্ব এখানেও বিকল।
-
বিষয়গুলো কত নির্মম তাই না?? কি মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না মা-বাপ তুলে কয়টা গালি দেই?? একটা প্রশ্ন খুব মনে আসে, এরা কি মানুষ?? না অমানুষ??
নারে ভাই। এরা মানুষ না। তবে অতি মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। নিজের চোখের জলকে গোপন করে সত্য জানাতে আমাদের জন্য যারা নিরন্তর কাজ করে যান। দিন শেষে এদেরও বুক ফেটে কান্না আসে। ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন আসে। মানব জনম তো রে ভাই। পাথর তো না।
তিনি বলছিলেন- আগুন ধেয়ে আসছে। আমি ছবি তুলতে তুলতে পেছনে যাচ্ছি। হটাত কি যেন পায়ের নিচে পড়ল। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটি লাশ। ঠিক যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বুক ফেটে হাহাকার নেমে এলো। এ কেমন দায়িত্ব আমার?? চোখের সামনে মানুষ মরে যাচ্ছে আমি কিছুই করতে পারছি না।
-
অনেক দিন আগে এই বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল তানভীর মোকাম্মেল স্যারের বাসায়। উত্তম গুহ বললেন তোমার দায়িত্ব ছবি তোলা তুমি ছবি তুলবে। এটাই তোমার কাজ। তার মেয়ে উত্তর দিয়েছিল- তা হলে আমি এই কাজই করতে চাই না। আমার চোখের সামনে মানুষ মরে যাবে আমি হাত গুটিয়ে থাকব? আমি ক্যামেরার সাটার চেপে যাব?? আমি পারব না। আমার কাছে মানবতাই আগে। (প্রাসঙ্গিক আলাপ মাত্র)
এখানেই দুই প্রজন্মের চিন্তা ধারার পার্থক্য। কিন্তু সত্য ক্যামেরায় বন্ধী না হলে সবাই জানবেই বা কি করে?? অন্যায়ের প্রতিবাদটাই বা হবে কি করে? এই ঘটনা গুলোকে আপনি কখনোই সরলীকরণ করতে পারবেন না। জার্নালিজম এথিক্স বড় বিদঘুটে, জটিল এক তত্ত্ব। মাঝে মাঝে ভাবি এই মানুষ গুলো প্রতিদিন আমাদের সংবাদ, ভালো থাকা, মন্দথাকা জানতে মাইলের পর মাইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোটাছুটি করে। রোদ নাই, বৃষ্টি নাই। খাওয়া নাই, দাওয়া নাই। রোজ ছুটছে। কখনো আগুনের মাঝে, কখনো বুলেটের সামনে। কখনো বন্যার পানিতে, কখনো লাশের ঘরে। দিল খুলে একটু কান্নার সময়ও তারা পায় না। কাল ভোর সকালেই যে আবার অফিসের কল টাইম!! আচ্ছা আমরা সাধারণ মানুষ কয়জন এই মানুষ গুলোর খোঁজ রাখি। কয়জন শেষ অবধি ভালোবেসে আবেগ নিয়ে হাতটা ধরে জানতে চেয়েছি- "ভাই/আপু কেমন আছেন?" জীবন বড় ব্যাস্তরে ভাই। হয়ত আবেগ দিয়ে তাদের মনকে ছুঁয়ে দিতে পারি না। কিন্তু পৃথিবীর সকল ক্যামেরা সৈনিককে তো স্যালুট জানাতে পারি। নাকি এখানেও কার্পন্য করব??
প্রণাম সেই সকল সৈনিকদের পায়ে। যাদের পা নিরন্তর ছুটে চলে আমাদের খবর সংগ্রহের জন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৩২