গত বছর আগস্ট মাসে স্ত্রী ঝুমকিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এর আগে কখনোই সীমান্ত পারি দেইনি আমি। তবে ছোটবেলা থেকেই নানা গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে, আর বিভিন্ন নাটক-সিনেমা দেখে দেখে অনেকটা চেনাজানা ও আপন-আপন জায়গা তৈরি হয়ে ওঠে শহর কলকাতা। তারপরেও কেন জানি না, এক বিমূর্ত ভয় কাজ করছিল আমার ভেতর, সেই সাথে অপার কৌতূহল আর বিস্ময়। কলকাতার পাশাপাশি ছিলাম, কলকাতার কাছেই দুই একটা শহরতলীতে। বেশির ভাগ সময় থেকেছি বাগেরহাটে আমার শ্বশুরবাড়ির একসময়ের পড়শি কাজল দা মানে কাজল মজুমদারের নিউ ব্যারাকপুরের জীর্ণ বাড়িটিতে। (এই কাজল দা’র অনাবিল স্নেহ-ভালোবাসা ও তার ওখানে কষ্টেসৃষ্টে থাকার আনন্দময় খণ্ড চিত্র ওঠে এসেছে আমার ‘দেশ ও একটি বটগাছের গল্প’ নামের গল্পে)। দূর সম্পর্কের এ নিকট আত্মীয়ের বাসায় কোনো একরকম রাত কাটিয়ে বেরিয়ে যেতাম আমি ও ঝুমকি। পরিচিত বন্ধু বলতে কেউ ছিল না তখন। তবে এক সমবয়সী সাংবাদিক বন্ধুর সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল আমার। পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় নাকি তিনি কাজ করেন (যদিও পরে শুনতে পেয়েছি উনি সেই খবরের কাগজে চাকরি করেন না, কন্ট্রিবিউটর হিসেবে খবর লিখেন মাত্র)। পাশাপাশি বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ‘একাত্তর টিভি’র কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। যাই হোক, ঢাকায় আমাদের বাসায় সত্যজিৎ চক্রবর্তী নামের সেই বন্ধুটি এসেছেন একাধিকবার, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা চলছে অবিরাম। যদিও বেশির ভাগ সময় পরনিন্দা কিংবা পরচর্চা ছাড়া, আর উনি 'একটা কিছু' এ বিষয়টি সাব্যস্ত করা ছাড়া খুব বেশি কিছু বলতে শুনিনি তাকে। একসময় আমাদের পত্রিকা ‘পরিবর্তন’-এও কাজ করেছে ও। সেই সাংবাদিক বন্ধুর সাথে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা তার দুই বন্ধু (দীপক দেবনাথ, ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং সুরজিৎ ব্যানার্জি, ‘একুশে টিভি’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি) তাদের সাথেও সেইসাথে আন্তরিকতা বাড়ে আমার ও আমাদের। খুব করে বলেন, কখনো সীমানা পারি দিলে যেন যোগাযোগ করি তাদের সাথে। ফোন নম্বর দেন (যদিও বাসার ঠিকানা দেননি, কেবল একজন সোদপুর আর দুইজন বারাসাত থাকেন, এইটুকুই জানান। যত দূর জানি, জায়গা দুটো নিতান্ত ছোট কোনো জায়গা নয়, যে হাক দিলেই ঘর থেকে বের হয়ে আসবে অমুক-অমুক নামধারী মানুষ)। মনের ভেতর সেই বিশ্বাস ও আস্থা নিয়েই হয়ত, ভারতের সীমানায় পা দেওয়ার পরপরই সেই সত্যজিৎ চক্রবর্তীকে ফোন দিয়ে আমার আসার খবরটি জানাই সাগ্রহে। যদিও এর আগে বহুবার মোবাইল ফোনে তার সাথে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা বিষয়ের পাশাপাশি আমার আসার কথাটিও জানিয়ে রেখেছিলাম তাকে। যাই হোক, ফোন দেওয়ার পর মুহূর্তেই বুঝতে অসুবিধা হলো না, তার কণ্ঠের আন্তরিকতার অভাবটুকু। বরং আমার ফোন পেয়ে সে অনেকটা কণ্ঠের জোর বাড়িয়ে ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয় বসে খাসির মাংসের রান, তার ভাষায় পাঠার মাংসের ঠ্যাং খাওয়ার রসালো বর্ণনা জুড়ে দিলেন। আমি বা আমরা কেমন আছি, সেটা তার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো না। বরং পাশে থাকা নারী কণ্ঠের হাসিটুকু পাওয়ার জন্যই যে তার এই কসরৎ, তা বুঝতে খুব বেশি সময় নিলো না আমার। এরপর লজ্জায়-অপমান চেপে রেখে নিতান্ত সৌজন্যতাটুকু সেরে ফোন রাখলাম। আমাকে তিনি বললেন, “আমি তো দাদা একটু বাইরে আছি, আগামীকাল অমুক সময় আমাকে ফোন দিয়েন।” যদিও আমি আর তাকে ফোন দিইনি। সেও দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেন করেনি, সেটা তার ব্যাপার। আমি তো তার কাছে পয়সা ধার করতে যাইনি, কিংবা আশ্রয় বা চাকরি প্রার্থী হিসেবেও আসিনি। আমি তার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম কেবল সময়টুকু কাটাবো বলে। যাই হোক, তা আর হলো না। কাছাকাছি না গেলে হয়তো দেখাও হতো না এ দৃশ্য। আচ্ছা, নিউ ব্যারাকপুর থেকে কি বারাসাত কিংবা সোদপুর খুব বেশি দূরের পথ? আমি তো চিনি না, তাই...
কলকাতার কিছুই আমি চিনি না। হাওড়া বা শিয়ালদাহ রেলস্টেশন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউজ, পার্ক স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নন্দন- এ সবই বইয়ের পাতায় পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা নামসর্বস্য বস্তু। ঘটনাক্রমে ঝুমকি পড়াশোনা করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বেশিভাগ সময়ই যেহেতু কড়া পাহাড়ায় তাকে হোস্টেলে সময় পার করতে হয়েছে, সেহেতু তার কাছেও সব জায়গা চেনা এত সহজ ছিল না। তাছাড়া ১০ বছরের ব্যবধানে অনেকখানি নাকি পাল্টে গেছে কলকাতা। কে জানে? আমার কাছে তো সবই নতুন। অজোপাড়া গাঁ থেকে শহরে বেড়াতে আসা কিশোরের মতো যা দেখি তাই ভালো লাগে। কে-কী আচরণ করলো তার চেয়ে আমার কাছে কচুরি বা ভেলপুরি খাওয়া অনেক বেশি আনন্দের মনে হয়। ট্রাম গাড়ি, টানা রিকশা দেখে চোখ গোল গোল করে তাকাই। পথের পাঁচালীর অপুর মতো অবস্থা আর কি!
একদিন কোনো এক রোববার বন্ধের দিন গেছি কলেজ স্ট্রিটে। বলতে গেলে ভুল করেই যাওয়া। সেখানে পৌঁছানো মাত্র নামে বৃষ্টি। রাস্তার মোড়ে বৃষ্টিভেজা দুপুরে এক দোকানের ছাউনিতে কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছি আমি ও ঝুমকি। পথ চিনতে পারছি না, কীভাবে দুর্গানগর যাবো। একসময় পৌরসভার এক সুইপারটাকে দেখলাম ময়লার ঠেলাগাড়ি হাতে ঠেলতে ঠেলতে আসতে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম পথের ঠিকানা। উনি টলতে টলতে হেলে দুলে, কণ্ঠ জড়িয়ে, টেনে টেনে যা বললেন, তাতে কিছুই বোঝা গেল না। কেবল হাতের ইশারায় বুঝতে পারলাম এখান দিয়ে ওখান দিয়ে কিছু একটা হবে। মুখ থেকে তার ভকভক করে কাঁচামদের গন্ধ। পাঁড়মাতাল সুইপারটিকে দেখে ভরকে যায় ঝুমকি। কিন্তু কেন জানি আমার কাছে তাকে বেশ আপন-আপন মনে হয়। সেই শীর্ণ দেহের মানুষটিকে নিয়ে অন্য সময় কিছু লিখবো, অথবা আমার কোনো লেখায় তাকে রাখবো আশা করি।
এমন এক অনাত্মীয় শহরে পথ চিনিয়ে দেওয়ার মানুষ অনেকেই আছেন। কেবল একজনও নেই কথা বলার সঙ্গী। যাকে অবলম্বন করে গিয়েছিলাম, সে তো তার স্ত্রীকে পাঠার ঠ্যাং-এর বর্ণনা শোনাতেই ব্যস্ত ছিলেন। সত্যজিতের বন্ধু দীপককে ফোন দিলাম আসার দুইদিন আগে। উনি ফোন ধরে এমনভাবে কথা বললেন, যেন উনার সাথে প্রতিদিনই কথা হয়। নিতান্ত সৌজন্যতা দেখিয়ে আসতে বললেন সোদপুর। আমি গেলাম না। তাছাড়া এর মাঝেই ফেসবুকে পরিচিত অথচ অদেখা দুই একজন কৃত্রিম-ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমার আসার খবর জানালে, ওরা খুব বেশি গা করেননি। একজন আমার কাছে কেবল জানতে চেয়েছেন, আমি কোন পথ দিয়ে এসেছি, বনগাঁ কেমন লাগলো, ট্রেনে নাকি বাসে চড়ে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
উনাদের কথা কি বলবো? সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছি আমার বাংলাদেশের, আমার ময়মনসিংহ শহরের, আমার পাড়ার একসময়ের আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদির কাছ থেকে। শেষের দিকে ওই দিদিকে ফোন না দিলেই বরং ভালো হতো। আপন ভাইয়ের মতো যে আমাকে একসময় দেখতো, সেই ভাইটিকে দীর্ঘ ১৬ বছর পর কাছে পাওয়ার পর উৎফুল্ল হওয়ারই তো কথা ছিল। কিন্তু বিধি বাম! তা না হয়ে বরং কণ্ঠে শোনা গেল তার নির্লিপ্তভাব ও ভয়াবহ আশঙ্কা। যদি তার বাসায় আসি তো মহাবিপদ টাইপ- এমন কিছু একটা হবে। যদিও সোদপুরবাসী দিদিটি দরিদ্র নয়, আর দরিদ্র হলেই বা কি, আমি তো তার বাসায় থাকা-খাওয়া-পরার জন্য যেতে চাইনি। কেবল ফেলে আসা আবেগের তাড়নায় একটু দেখা করতে চেয়েছিলাম মাত্র। পরে যদিও দেখেছি তাকে ফেসবুকে, স্বামী-সন্তানের মাঝে ধনাঢ়্য ও আভিজাত্যের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে। মাঝখানে স্ত্রীর কাছে রীতিমতো বড় বড় বুলি আওড়ানোর মাথা কাটা গেল আর কি!
তারপর সাত দিন ছিলাম। দেশে ফিরে আসার জন্য মন ছটফট করতে থাকে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, “তোমাকে খুব মিস করছি বাংলাদেশ, ফিরে আসছি প্রিয় স্বদেশ আমার”। ফিরে আসার একদিন আগে মনে পড়ে গেল একজন লেখকের কথা। বাংলাদেশে উনি একবার আসার পর পরিচয় হয়েছিল। যুক্তিবাদী লেখক প্রবীর ঘোষের সাথে ঝুমকিরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম সেইবার। মোবাইল নম্বর আছে, থাকেন দমদম রেলস্টেশনের কাছাকাছি, এইটুকুই সম্বল। ফোন দিলাম। অপর পাশ থেকে ভেসে এল আন্তরিকতার হাওয়া। ফোনের ওপর ফোন দিতে দিতে, পথ চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে এলেন নিজের ফ্ল্যাট বাড়িতে। খুব বেশি সময় ছিলাম না উনার কাছে, তবে যতটুকু সময় ছিলাম প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলাম। ঝুমকিও অনেক খুশি হয় দাদা ও বৌদির অকৃত্রিম ভালোবাসায়। কিছুটা লজ্জা ও গ্লানি বোধ কাটে আমার। এ নিয়ে কোনো একদিন বিস্তারিত লিখবো। হয়তো গল্পে, নয়ত স্মৃতিকথায়।
লেখক হওয়ার একটা যন্ত্রণা আছে। এই যে এত কথা লিখছি, কেন লিখছি জানি না। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি বলেই হয়তো। নাকি ভেতরের আবেগগুলো প্রকাশ করতে না পারলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়- এ কারণে? আমার যন্ত্রণা তো আরো বেশি। কোনো স্মৃতিই সহজে ভুলতে পারি না। কখন যে কোন স্মৃতি ভুশ করে ভেসে ওঠে তার নেই ঠিক-ঠিকানা। তবে এ লেখাটির যে কোনোই উপযোগিতা নেই, তা কিন্তু নয়। এই এক বছরের ব্যবধানে সেইসব বন্ধুদের হারিয়ে পেয়েছি অনেক অনেক ভারতীয় বন্ধু। তাদের কাউকে ডাকি দাদা বলে, কাউকে দিদি। কেউ-বা হয়েছে ছোট বোন কিংবা ছোট ভাই। কেউ কেউ লেখক বন্ধু, কেউ-বা শুধুই বন্ধু। তারা সকলেই পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থাকেন। ফেসবুকের মাধ্যমেই পরিচয়, সেই থেকে ঘনিষ্ঠতা। কখনো দেখা হয়নি চর্মচক্ষুতে কারো সাথে। ভারতে আসার জন্য প্রায়ই কেউ-না-কেউ আহ্বান জানান আমায়। প্রতিদিনই কারো না কারো সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা হয় ফেসবুকের ইনবক্সে। আন্তরিকতার সাথেই ডাকেন হয়তো তারা। তবে ঘর পোড়া গরু তো, যেতে ভয় করে। কাছে এলে পরে যদি তারা দূরে সরে যায়?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৯