ইতিহাসটা জানা আছে এমনভাবেই, সম্রাট আকবর বাংলা-বিহারের দেওয়ান নিযুক্ত করেন রাজা কংসনারায়ণকে। তবে বয়সের কারণে কংসনারায়ণ দেওয়ানী ছেড়ে রাজশাহীর তাহেরপুরে এসে আত্মনিয়োগ করেন ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে। আহ্বান করেন তাহেরপুরে এসে তার জমিদারির ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মহাযজ্ঞের জন্য।
ওই সময় নাটোরের বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা ছিলেন বংশানুক্রমে তাহেরপুর রাজাদের পুরোহিত। এদের মধ্যে ছিলেন রমেশ শাস্ত্রী নামে একজন বাংলা-বিহারের বিখ্যাত পণ্ডিত। তিনি শাস্ত্রমতে বললেন, বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেদ ও গোমেধ- এই চারটি মহাযজ্ঞ রয়েছে। বিশ্বজিৎ ও রাজসুয় নামক মহাযজ্ঞ শুধু সম্রাটরা করতে পারবেন। অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞ দুটিও নিষিদ্ধ। একমাত্র দুর্গোৎসব ছাড়া অন্য কোনো মহাযজ্ঞ করা সঠিক নয়। রাজা রামচন্দ্রের বিধানে ভক্তিসহ দুর্গোৎসব করলে সর্বযজ্ঞের ফল লাভ করা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন রমেশ শাস্ত্রী। উপস্থিত অন্য পণ্ডিতরাও ওই মতামতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। আর রাজা কংসনারায়ণ সে মতেই পূজার বিশাল আয়োজন করেন। ওই সময় সাড়ে ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজকীয় পরিবেশে দুর্গোৎসব শুরু করেন তিনি। আর এই বিশাল পূজার পূরোহিত ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। আর এখান থেকেই শুরু হয় মহা ধুমধামে দুর্গোৎসব। এই মহাযজ্ঞে আনন্দ, ধুমধাম ও উৎসাহে সবাই মোহিত হয়েছিলেন সেসময়ে। পরের বছর থেকে এ অঞ্চলের অনেক সামন্ত রাজা ও ধনী ব্যক্তি বিখ্যাত পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পদ্ধতি অনুসারে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু করেন। মার্কন্ডেয় পুরাণে যদিও দুর্গোৎসবের কিছু বৃত্তান্ত রয়েছে, কিন্তু সমগ্র যজ্ঞটির বিধান প্রাচীন কোনো গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে নেই। এ কারণে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর প্রণীত আচারেই সনাতন হিন্দুসমাজ সানন্দে দুর্গোৎসব পালন শুরু করে আসছে।
তবে এতদিনকার এ ইতিহাসে দেখা দিলো মতান্তর। সম্প্রতি ইতিহাস পর্যালোচনা করে কয়েকজন বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন : কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু দিকে। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য সূত্রে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত, যে বিপুল ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন, তা-ই সেযুগের জনমানসে দুর্গাপূজার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিল। আর সেই থেকেই কংসনারায়ণী মিথের উৎপত্তি। একথা সত্যি যে দুর্গাপূজার ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে, বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। শরৎঋতুর আরম্ভেও হত। ‘এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হইয়া দুর্গাপূজা হইয়াছে।’ তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। দুর্গার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে, ‘আয়ুরারোগ্যং বিজয়ং দেহি দেবি নমস্তুতে। রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে। পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্ব্বকামাংশ্চ দেহি মে।।’ (হে ভগবতী, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাকে রোগমুক্ত করুন, বিজয়ী করুন, যশ ও সৌভাগ্য প্রদান করুন, পুত্র ও ধন দিন এবং আমার সকল কামনা পূর্ণ করুন।) যোগেশচন্দ্র আরও দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা। বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাতেও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ গ্রহণে আহ্বান জানানো হচ্ছে (‘দেবি যজ্ঞভাগান্ গৃহাণ’) এবং পশুবলি দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে, যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি (‘যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ তস্মিন্ যজ্ঞে বধোঽবধঃ’)। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদ যজ্ঞই তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। হৃদয়ে যা জাগে, শরৎমেঘে তাই তো দেখা যায়।
বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চণ্ডী অংশটি পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের (১৫৪০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থটি। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পণ্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। এই সব বিধান তিনি নিজে সৃষ্টি করেননি। বরং আগের পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে পূজাপদ্ধতি লিখেছেন। কোনো কোনো বিধানের পৌরাণিক প্রমাণ দিতে পারেননি। তাকে তিনি বলেছেন আচার–দেশাচার বা কুলাচার। আচার তাকেই বলে যা, দেশে বা বংশে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। স্মৃতিশাস্ত্রের ধর্মঃ যা কিছু পুরনো, সে পৌরাণিকই হোক আর আচারগতই হোক, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুনকে বাতিল করা। স্মার্ত রঘুনন্দনের দেওয়া স্বীকৃতি দেখলে মনে হয়, দুর্গাপূজার যাবতীয় রীতিনীতি বহু বছর আগে থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল। সম্ভবত, প্রাচীন দুর্গাপূজাকে রঘুনন্দন তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। সেই কীর্তিই নতুন করে এই পূজার প্রতি বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কালক্রমে ঘটনাচক্রে তা বাঙালি হিন্দুর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, কংসনারায়ণের বংশে প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা উদয়নারায়ণ। সে ছিল ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ। রঘুনন্দন তখন বাঙালি হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রতীক।
কারো মতে, বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃণ্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরী–মল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন। সেই পূজাপদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃণ্ময়ী দেবী সপরিবার বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতীর স্থানবদল করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও পূজিত হয় জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি। তাছাড়া মল্ল রাজবাড়ির পূজায় দেবীপটের যে ব্যবহার লক্ষিত হয়, তা অনেকটাই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না। এই পূজাও কংসনারায়ণ প্রবর্তিত পূজার অনেক আগে প্রচলন লাভ করে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন। সেও কংসনারায়ণের বহু আগের ইতিহাস।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৩৮