মানবিক রসায়ন
মানুষের কাছে মানুষের প্রার্থনা কেমন- জানা নেই সে হিসাব-নিকাশ
উত্তর খুঁজেছি বহুবার বইয়ের পাতায়, পবিত্র গ্রন্থে, মানবিক চেতনায়,
কোথাও মেলেনি উত্তর; পাইনি বাতিঘর অথবা বিধবা বালুচর।
দেখেছি আমি বুভুক্ষু মানুষের মুখ, বিনম্র অথবা অপলক চাহনি
নতজানু হতে দেখেছি কত শতবার উদ্ধত প্রেমিকের মাথা,
সৈনিকের পোশাকে ধাবমান হতে দেখেছি সন্ত্রাসী-শরীর
এমনই হাজারও দেখেছি প্রতিলোম-অনুলোমের অবারিত সঙ্গম।
অজানা রয়ে গেল তবুও মানবিক রসায়নের সকল শাখা-প্রশাখা।
নিজস্ব নির্জন আকাশ
হরিত কচুরি বনে ভায়লেট পুচ্ছ মেলে ময়ূর-পুষ্প দেখি
পেছনে তার দাঁড়িয়ে আছে ভইষা ঘিয়ের আকাশ।
তেমনই একদিন আলটপকা মনে হলো
আমারও একটা ছোট্ট আকাশ ছিল; একান্ত নিজস্ব নির্জন আকাশ;
চারকোণা ফ্রেমে বন্দি- বিস্তৃর্ণ নীলাকাশ।
বাইরের খোলা আকাশের সাথে যার ছিল না কোনো মিল,
ওটা আলাদা রকম।
সে আকাশের কলসিতে কখনও দেখি নি জল।
ঘন ঘোর বর্ষাতেও দেখেছি মরুস্থালীর ঘর।
বুকে তার জমতো না জলধর।
সাদা বা কালো কোনও রঙেরই বিমূর্ত কারুকাজ
দেখি নি তার শাড়ির আঁচলে।
কেবল মন খারাপ হলে তার নীল চাদরে
আমাকে জড়িয়ে নিতে আলিঙ্গনে।
আলপাকা গায়ে শীতের গভীরে-
তেমনই দেখেছি তাকে গোপন চোখে।
বরফযুগের আগুনখেকো মানুষ
পালটিয়া সমুদ্রে ফিরে পকেটে ভরে নিই যাবতীয় ঢেউ
জল থেকে লবন আলাদা করার কৌশল আমার জানা।
সফেন জলের তলে সেরে নিই গোপন অবগাহন
বহুকাল রক্তিম অঙ্গার খাই না;
পাঁজরে তাই জমা শেওলার রং কালচে হয়ে গেছে।
বাতাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে একদিন পথ ভুলে সমুদ্রে এসেছিলাম।
এখানেই গড়েছি আমার মৎস্যকন্যার যাবতীয় সত্যের বসতঘর।
আমার প্রতিবেশীরা কেউ প্রস্তর, কেউবা লৌহযুগের মানুষ,
বরফযুগের আমিই আগুনখেকো পুরুষ-
অগ্নিকন্যার প্রতীক্ষায় আজও জল খেয়ে বেঁচে আছি।
কথার ভূত-ভূতের কথা
শাশ্বত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি বলি আজ
নেই কোনো আর জমা ভালোবাসা ভেতরে-বাইরে,
মিথ্যে নয়; সেকথা মিথ্যা হবে না এতটুকু- সময়ের কাছে
কালের সেইসব আবেগ পচে-গলে একাকার হয়ে গেছে।
ছিল কথা মৃত্যুর ওপারে দাঁড়িয়ে ভেলার কারুকাজে প্রতীক্ষা করার
দোঁহার আলিঙ্গনে জলের ছোট-বড় যাবতীয় ঢেউ ভাসাবার, আর…
ঢেউগুলো আজও বয়ে বয়ে চলে; দিন যায় যেভাবে যাবার ছিল কথা
কেবল কথা-দেওয়া কথাগুলো মরে-পচে ভূত হয়ে আছে।
নাগরিক উদ্বাস্তু
সোনালু আলোর উত্তরীয় গায়ে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমার ভগ্ন নগরী
জানালার ফাঁক গলে ঘরের সারি বাঁধা পিঁপড়ের ওপর আছড়ে পড়ে স্বর্ণমহিমায়;
চাপরাসে ভরে গেছে ঘর।
কল্পনার ভেজা কাচের ভেতর দিয়ে দেখি- আমাদেরও তেমন সাদাকালো অতীত ছিল
অভাব ছিল, বিভাব ছিল, পাওয়ার মাঝে চাওয়া ছিল,
তবুও ভালো। তবুও ছিলাম। হয়ত আমরা ভালোই ছিলাম।
আমরা এখন নাগরিক উদ্বাস্তু- পিঁপড়ের ঘর ভেঙে কেড়েকুটে খাওয়া মানুষ
আমাদের কী আর ওই রঙের জামা গায়ে পরা মানায়?