ক্রাচের কর্নেল পড়ছি। আমার পড়া শাহাদুজ্জামানের প্রথম বই। বইটা বিপ্লবী কর্নেল তাহেরের জীবন কাহিনী নিয়ে। সে সূত্রে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল, জাসদের কথা। আগে এত বিস্তারিত জানতাম না কর্ণেল তাহের সম্পর্কে। যা হোক এ সম্পর্কে যা মনে হইছে তা কিছু কই, ভুলত্রুটি ধরায়া দিবেন।
১) এ গল্পে মেজর জেনারেল জিয়া যদি ভিলেন হন, তাইলে কইতে হবে ভিলেন হিসেবে তারে পছন্দ হইছে আমার। লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে জিয়াউর রহমান অদ্ভুত রোল প্লে করছেন পুরো গল্পে। তাহের আর জিয়া যেন সম্পূর্ণ বিপরীত দুই চরিত্র। কর্নেল এর পুরা জীবন যেখানে নিবেদিত ছিল এক মিশনের জন্য সেখানে জিয়ারে মনে হইছে নিরাসক্ত এক দর্শকের মতো। স্রেফ দূর থেকে চেয়ে দেখছেন সব। ঘটনাচক্র যখন তাকে সামনে এনে দিয়েছে তখনও তিনি খেলেছেন ধীরে। ঠান্ডা মাথায়। নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য যেন ছিল না তার। তিনি স্রেফ সেরা চালটা চেলেছেন প্রতিবার।
২) কর্নেল তাহের ক্যান ৭ নভেম্বরের ঘটনায় তারে বিশ্বাসঘাতক বলেছেন সেটা আমার মাথায় ধরে নাই। অবশ্য একটা কারণে বলা যায়, তিনি ও জাসদ হয়তো বিশ্বাস করছিল মুক্ত করার পরে কৃতজ্ঞ জিয়ারে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যাবে। তিনি তা করতে দেন নাই। বিষয়টা আসলেই বিশ্বাস ভঙ্গের বিষয়।
৩)আর কর্নেল তাহেররে হত্যার বিষয়টা। ওটা হত্যাই, রাজনৈতিকভাবে খুন করেছেন তাকে মেজর জিয়া আর ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের গদির নিশ্চয়তার জন্য (কিংবা দেশের স্থিতীশীলতার জন্য) বিপ্লবীদের মরতেই হয়। এটাই নিয়ম।
৪) একটা ব্যাপারে হতাশ হইলাম। খালেদ মোশাররফ। তার সম্পর্কে যে হিরোইক ইমেজ ছিল আমার মনে, ক্রাচের কর্নেল যেন কিছুটা ধাক্কা দিল তারে। তার অভ্যুথান ও পরবর্তী ভূমিকা ক্যামন হাবিজাবি মনে হইলো।
৫) অনেকটা জানলাম সিরাজ শিকদার, জাসদ ইনু এনাদের ব্যাপারে। এটা ভাল্লাগছে। একটা খটকা রয়ে গেল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বেশ প্রচলিত ঘটনা হল, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ইনু, মতিয়াররা নাকি আনন্দ উল্লাস করেছেন! কিন্তু এখানে তো তার কোনো ক্লু দেখলাম না। এ বইয়ে জাসদরে তো ততটা উল্লাসিত মনে হইলো না, আর মস্কোপন্থি মতিয়ারা নাকি ততদিনে শেখ সাহেবের সাথে জয়েন করেছেন। (এ বিষয়ে জ্ঞান কম। অজ্ঞতা মাফ করিয়া কেউ জ্ঞান দান করলে খুশি হব।) তাহলে কোনটা ঝামেলা? শাহাদুজ্জামান কিছু গোপন করেছেন নাকি ভুল তথ্য প্রচলিত আছে?
৬) কেউ যদি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনি ও ক্রাচের কর্নেল পাশাপাশি পড়েন, একটা চক্র নজরে পড়তে পারে। পাকিস্তান হওয়ার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর যেই আক্ষেপ ছিল, শাহাদুজ্জামানের আক্ষেপ যেন একই রকম। অবশ্য শাহাদুজ্জামানের আক্ষেপ অনেক তীব্র, মুক্তিযুদ্ধের পরের এ অবস্থাও অনেক গুরুতর। কিন্তু সেই আক্ষেপগুলা একইরকম যেন, হতাশার বিষয় হলো এবার ক্ষমতায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। জিন্নাহর পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দের থেকে জাতি বঞ্চিত হয়, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে তাজউদ্দীনদের থেকে। ওখানেও সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার স্বাদ পান যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে ছিলেন নামমাত্র, এখানেও যারা মুক্তিযুদ্ধ রেখে পালিয়ে ছিলেন তারা এসে বসেন ক্ষমতায়। কষ্টের বিষয়।
৭) দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অধিকারসুলভ ভালোবাসারে শাহাদুজ্জামান ঠিকভাবে দেখাইতে পারছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৮ রাত ১২:৫৬