সকালের শিহাব স্যারের ক্লাসটা হলো না। মেজাজটাই খিঁচড়ে গেলো তিন্নির। এমনিতে সে এমন একটা যে ক্লাসে আসে- তা না। তার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ১১টা বেজে যায়। তারপর ফেসবুক ঘেঁটে, গোসল করে, মেকআপ করে, দেড় স্লাইস পাউরুটি গিলে গাড়িতে করে ভার্সিটি আসে। ল্যাবগুলো সাধারণত হয় দুপুরের পরে; সেগুলো না করলে চলে না। তাই ভার্সিটি আসতে হয়। হঠাৎ কখনো যদি ভুল করে সে সকালের ক্লাস করতে চলে আসে, সেটা প্রফেসর মশাইয়ের ভাগ্য। আর আজ সে এসেছে, কিন্তু স্যার আসেননি, এটা কোনো ভাবেই সে মেনে নিতে পারছে না।
এসেছিলো কি সাধে? সামনে পরীক্ষা। নোটপত্র, ক্লাস লেকচার জোগাড় করতে হবে। পরীক্ষার আগে আগে স্যারদের রুমে গিয়ে দেখা করলে স্যাররা সাধারণত একটু আধটু সাজেশন দেন। সেটা দিয়ে পাস মার্কটা তুলতে পারলেই তার চলে। কিন্তু ক্লাস হবে না; ধর্মঘট ডেকেছে কোন একটা বামদল যেন। তার বান্ধবীরা প্রায় কেউই ক্লাসে আসেনি। যে কয়টা মেয়ে এসেছে- তাদের কারো সাথেই ভালো পরিচয় নেই তার। ওরা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করছে কি নিয়ে যেন। একবার ভাবলো- ওদের গিয়ে ধরবে লেকচারের জন্য। কয়েক পা এগিয়েই আবার পিছিয়ে গেলো সংকোচে। তারপর গুটি গুটি পায়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো।
আবছা অন্ধকার করিডোর পার হয়ে গেটের কাছে পৌঁছে হঠাৎ কি মনে করে যেন পিছন ফিরে তাকালো তিন্নি। খেয়ালই করেনি, মেঝেতে ল্যাচা দিয়ে বসে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে একটা ছেলে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটাকে। মুখে খোঁচা খোঁচা অযত্নের দাড়ি। চোখে চশমা; মনে হচ্ছে, একদিকে ভাঙা, স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। শার্টে ইস্ত্রি নেই। প্যান্টটাও ময়লা। ছেলেটা দেয়ালের দিকে যে শুধু চেয়ে আছে- তাই নয়, কি যেন বিড়বিড় করছে আপন মনে। কোথায় যেন দেখেছে সে ছেলেটাকে। কিছুতেই মনে করতে পারলো না তিন্নি! ধুৎ! কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলো ছেলেটির সামনে। ছেলেটি তাকে দেখতেই পায়নি। মানসিক বিকারগ্রস্তের মত গভীর মনে বিড়বিড় করে চলছে। তিন্নি হেঁটে হেঁটে নিচে নেমে এলো।
গাড়ীতে উঠেই মনে পড়লো ছেলেটি কে! এতো তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ইমন! প্রায় তিন মাস ওকে দেখেনি সে! (ক্লাসে আসে না, দেখবে কিভাবে?) ইমন অনেক শুকিয়ে গেছে এর মধ্যে। দাঁড়ি না কেটে কেটে চেহারাটাকে নোংরা করে ফেলেছে। চেনাই যাচ্ছিলো না তাকে একেবারেই! নিজের মাথায় নিজে চাঁটি মারলো একটা। ফার্স্ট বয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো, নোটের জন্য চিন্তা কিসের? একে একটু ভজিয়ে ফেললেই সব কেল্লা ফতে হয়ে যাবে! আর এই জিনিসটা সে ভালোই জানে! সে আদুরে গলায় কোনো ছেলের কাছে নোট চাইলে, কার সাধ্য ‘না’ করে? যেই ভাবা সেই কাজ। দো’তলায় উঠে সোজা ইমনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ‘কেমন আছিস ইমন! তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না!’ ইমন ধ্যান ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসলো।
- তুমি... আমাকে চেন? (ইমন কখনো কাউকে ‘তুই’ বলে না)
- চিনবো না কেন? ফার্স্ট বয়কে আবার কে না চিনে? কিন্তু তুই নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারিস নি! (চেনার প্রশ্নই আসে না! ক্লাসে গোটা ত্রিশেক মেয়ে আছে। এই আধপাগলা ছেলে যে মেয়েদের দিকে চোখ তুলেও তাকায় না, সেটা তিন্নি ভালোই জানে। তবে এখন খাতির করা দরকার। গরজটা তো ওরই!)
- চিনেছি। তোমার নাম তিন্নি। তুমি ক্লাসের সবচাইতে...
- সবচাইতে কি?
- (ইমন ইতস্তত করে, আমতা আমতা করে) না.... কিছু না।
- আরে, বল না! আমি মাইন্ড করবো না।
- সবাই বলে, তুমি নাকি ক্লাসের ... সবচাইতে সুন্দরী মেয়ে।
- সবাই বলে! তোরও কি তাই মনে হয়?
- তুমি তো দেখতে ভালোই...
- থ্যাংক ইউ, দোস্ত! তুই আমাকে এই চোখে দেখিস, আমি তো কখনো জানতাম না! (ছেলেদের সাথে ফ্লার্ট করা যেমন তেমন কাজ না। পুরো ক্লাসে একমাত্র তিন্নিই এই সাহস রাখে!)
কথায় কথায় তিন্নি নোটের কথাও পেড়ে ফেলে। ‘দিবো না কেন? অবশ্যই দিবো। আমি কালকে সব ক্লাস লেকচার আর নোট নিয়ে আসবো। তুমি ফটোকপি করে ফেরত দিয়ে দিয়ো’। তিন্নি এতটা আশা করেনি। আনন্দে গদগদ হয়ে বাসায় ফেরে। ফার্স্ট বয়ের নোট পাওয়া তো আকাশের চাঁদা হাতে পাওয়ার সমান!
সন্ধ্যায় রাসেলের বাসায় পার্টি আছে। বাসা থেকে তো গ্রুপ স্টাডির কথা বলে বেরোবে, তবে বদ্ধ দরজার ওপারে কি গ্রুপ স্টাডি হয়- সে আর কে দেখতে যাচ্ছে? রাসেলের সাথে ওর সম্পর্ক প্রায় ৬ মাসের। শরীরের এখানে-ওখানে হাত বোলাতে দিলেও, এখনো সম্পূর্ণভাবে নিজেকে বিসর্জন দেয়নি সে। আজকে বোধ হয় সেই দিন এলো। এতে কোনো আপত্তি নেই তার অবশ্য। বরং একটা নিষিদ্ধ আনন্দ আছে। এর আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথেও দৈহিক সম্পর্ক ছিলো। সে আধুনিক মেয়ে। আজকের দিনে এটা কোনো ব্যাপার নয়।
পার্টিতে গিয়ে দেখে, কেউ আসেনি এখনো। ব্যাপার কি? সাতটায় পার্টি শুরু, রাত সাড়ে আটটা বাজে, কেউ আসেনি কেন? ‘কেউ আসে নি?’ রাসেলকে জিজ্ঞেস করতেই রাসেল চোখ টিপে মুচকি হাসে। ‘আজকের পার্টি শুধু তোমার আর আমার!’ হঠাৎ করে মোমের মত গলে যায় তিন্নি। শরীরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। রাসেল উঠে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।
‘আম্মু, তিন্নি আপু ফোন করেছিলো। ও আজকে বান্ধবীর বাসায়ই থাকবে। পড়া শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই আর বাড়ি ফিরবে না!’ মা শুনলেন, বাবাও শুনলেন। কেউ কোনো উত্তর করলেন না। কারণ, তখন মা ডুবে ছিলেন হিন্দি সিরিয়ালে রিপিট টেলিকাস্টে, আর বাবা অফিসের ফাইলে।
পরদিন দুপুর গড়িয়ে বাসায় ফিরলো তিন্নি। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। চোখের নীচে কালো দাগ পড়েছে একদিনেই। দেখে যে কেউ বলবে, সারা বছরের পড়ালেখা এক রাতে করে বাসায় ফিরেছে মেয়ে! নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয় সে। বাথরুমে গিয়ে কাপড় ছেড়ে, গোসল করে, নরম বিছানায় ডুবে যায়। বিকাল পাঁচটার দিকে মোবাইল ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার। তানিশা ফোন করেছে।
- ‘হ্যালো!’
- (ওপার থেকে কোনো আওয়াজ নেই)
- তানিশা, কিছু বলবি, নাকি?
- এইটা কি হলো, তিন্নি?
- কেন? কি হলো আবার?
- রাসেল যে এইরকম করবে, আমি চিন্তাও করতে পারিনি!
- রাসেল? কি করেছে ও?
- (এবার তিন্নি খানিকটা অবাক স্বরে বলে) কেন? তুই জানিস না?
- উফ! ঢং না করে বলবি, না কি?
- তোর... ভিডিও পোস্ট করেছে... হিডেন ক্যামেরা... ইন্টারনেটে...
মেরুদন্ডের মধ্যে দিয়ে শিরশির করে একটা ঠান্ডা কিছু নেমে গেলো তিন্নির। ওপার থেকে তানিশা ‘হ্যালো, হ্যালো’ করে যাচ্ছে। উত্তর দেবার মতো শক্তি নেই ওর। একটু পরে একটু ধাতস্থ হয়ে ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ দিলো- ‘Tinni hidden camera’ চারটা ভিডিও ডাউনলোড লিংক চলে এলো। ডাউনলোড হতে মিনিট দশেক সময় লাগলো। তারপর ও উঠে গিয়ে দরজা লক করে দিয়ে এসে ভিডিও ছাড়লো। যা দেখলো, তাতে তার সারা শরীর হিম হয়ে এলো। পুরো ৭০ মিনিটের ভিডিও। ওর চেহারা আর শরীরের প্রত্যেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে পুংখানুপুংখভাবে। কিন্তু রাসেলের চেহারা দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সেখানটা কিভাবে যেন ঝাপসা করে দিয়েছে সে। মুহুর্তের মধ্যে যেন তিন্নির পুরো দুনিয়াটা ভেঙে পড়লো। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। যেখান থেকে সে ডাউনলোড করেছে, সেখানে লেখা, ‘11,345 times downloaded’। আজকের দিন শেষ হতে হতে তো পুরো পৃথিবীর মানুষ দেখে ফেলবে ভিডিওটা! চোখ ভেঙে কান্না আসলো। তার চেয়ে বেশি আসলো ভয়। মা-বাবা-বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে মুখ দেখাবে কিভাবে? নাহ! কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তাড়াতাড়ি মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দিলো। তারপর নিথর নিশ্চুপ হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকলো সে। ঘন্টার পর ঘন্টা একই ভাবে বসে রইলো। মাথার মধ্যে অসংখ্য ভাবনা খেলা করছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই ঝামেলার একটাই সমাধান: আত্মহত্যা! ফ্যানের সাথে ওড়না বেঁধে একবার ঝুলে পড়লেই আর কোনো ঝামেলা নেই। এটাই বোধ হয় সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু সাহসে তো কুলায় না! তাহলে কি ঘুমের ওষুধ খাবে? ও শুনেছে- অনেকগুলো সিডাক্সিন একসাথে খেয়ে ফেললে নাকি মানুষ মরে যায়! এটাই সবচেয়ে সহজ উপায় মনে হলো। মা-বাবা এখনো জানতে পারেনি নিশ্চয়ই। জানতে পারলে তো দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলতো এতক্ষণে! যে কোনো সময় জেনে যাবে। কেউ না কেউ ফোন করে জানিয়ে দেবে। এসব ঘটনা কি চাপা থাকে? কাজেই যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সোজা মায়ের ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে ওষুধের বাক্স খুলে দুই পাতা সিডাক্সিন বের করে নিলো। ‘কি খুঁজিস?’ হঠাৎ মা এসে হাজির। ‘কিছু না। মাথা ব্যাথা করছে। ডিসপ্রিন নিলাম’। সাবধানে হাতের ভেতর লুকালো ওষুধের পাতাগুলো। নিজের ঘরে এসেই সবগুলো ওষুধ খেয়ে নিলো পানি দিয়ে।
ঘুম ভাঙলো ধবধবে সাদা একটা ঘরে। সাদা বিছানা, তার গায়েও সাদা পোশাক। আশেপাশে অনেক যন্ত্রপাতি, সব সাদা। কিন্তু ঘরে কেউ নেই। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো তিন্নি টিউব লাইটের দিকে। ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়তে থাকলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু কান্না করার মত শক্তিও নেই শরীরে। চোখ থেকে শুধু ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরতে থাকলো। দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার শক্তি নেই তার। নার্স নিজেই ওর সামনে এলো। ওর চোখ খোলা দেখে এক লাফে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। প্রায় সাথে সাথেই ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকলো এক দঙ্গল নার্স, আর একজন বয়স্ক ডাক্তার। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকলেন ওর সাথে।
পনেরো দিন কোমা-য় থাকার পর জ্ঞান ফিরেছে ওর। এই পনেরো দিন দিন-রাত তার শয্যার পাশে বসে ছিলেন তার মা। বাবা তো পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররাও কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। এটা শুধুই আল্লাহর রহমত- যে সে বেঁচে গেছে এ যাত্রা! সব শুনে চোখ বন্ধ করলো তিন্নি। বাঁচার জন্যই তো বিষ খেয়েছিলো সে! মরে গেলেই তো বেঁচে যেতো সে!
ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেতে থাকে সে। মা-বাবা-চাচা-চাচী-মামা-মামী সবাই দেখতে আসে। দামী পারফিউমের গন্ধে নাক জ্বলে, মাথা ঝিমঝিম করে তিন্নির। সবাই হাসিমুখে কথা বলে, তবে সবার চোখে ঘৃণা দেখতে পায় ও। ও মরে গেলেই যেন খুশি হতো সবাই। ক্লান্তিতে কিংবা অসহায় ক্ষোভে চোখ বন্ধ করে সে। পরের দিন বন্ধু-বান্ধব আসে দল বেঁধে। বান্ধবীদের মধ্যে তানিশা ছাড়া কারো চোখে সহানুভুতি দেখতে পায় না সে। সবাই যেন শুধু দায়িত্ব পূরণের জন্য দেখতে এসেছে ওকে। আর ছেলেরা! ওদের চোখের দিকে তাকাতে পারেনা সে। একেকজন যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ওকে। সাদা চাদরে ঢাকা ওর বুকের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে ভিডিওতে দেখা বুকদুটোর সাথে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বারবার দেখে দেখে যেন ওকে ভার্চুয়ালি উলঙ্গ করছে সবাই। ওর মনে হলো, সবার সামনে যেন ধর্ষিত হচ্ছে সে! ওই হিংস্র হায়েনার দৃষ্টি সইতে না পেরে দু’হাতে চোখ ঢাকলো ও।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ভিজিটিং আওয়ার প্রায় শেষ। ভিজিটররাও সবাই চলে গেছে। হঠাৎ দরজা খুলে ঢুকলো দিনের শেষ ভিজিটর। ইমন। হাতে এক গোছা ফুল, আরেকটা পলিথিনের ব্যাগ। দরজা দিয়ে ঢুকেই সোজা ওর চোখে চোখ রেখে তাকালো। আজকে ও ক্লীন শেভ করে এসেছে। পরনের প্যান্ট-শার্টও আগের চেয়ে অনেক ভালো, ঝকঝকে। তিন্নি বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উঠলো। সারা দিনের এই ধকলের পর আরেকটা দর্শনার্থী সইতে হবে! ‘কেমন আছো, তিন্নি?’ ওর গলার আওয়াজে কি যেন ছিলো! অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো তিন্নি। না, ওর বুকের দিকে নয়, শরীরের অন্য কোনো অঙ্গের দিকে নয়, এখনো চোখে চোখ রেখেই তাকিয়ে আছে ইমন। ব্যাপারটা নতুন ঠেকলো তিন্নির কাছে, একটু ভালোও লাগলো। দুর্বল কন্ঠে বললো, ‘ভালো’। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বিছানার ধারে বসে আলতো করে ওর কপালে হাত রাখে ইমন। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এখনো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সে চোখে কেমন যেন একটা অদ্ভুত মায়া, পরম সহানুভুতি। যেন চোখ দিয়ে চেয়ে থেকেই ওর সব দুঃখ শুষে নিতে চাইছে। হঠাৎ তিন্নির সারা শরীর কেঁপে উঠলো কান্নার দমকে। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। এতগুলো ঘৃণা ভরা আর লালসা মাখা দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিলো সে। সব অভিমান, সব কষ্ট, দুঃখ, অভিযোগ, অনুতাপ- এক নিমেষে চোখের পানির সাথে বেরিয়ে আসে তার। চুপ করে ওর পাশে বসে, ওর গালটাকে আলতো করে ছুঁয়ে বসে থাকে ইমন। ওকে কাঁদার সময় দেয়।
কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হয় তিন্নি। তারপর কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা। হঠাৎ তিন্নি প্রশ্ন করে বসে, ‘ভিডিওটা দেখেছ তুমি?’ ‘না...’ ‘কেন?’ এবার ইমন অবাক হয়ে বলে ওঠে, ‘কেন দেখবো?’ হঠাৎ ইমনের কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হয় তিন্নির। প্রসংগ পাল্টানোর জন্য ইমন বলে, ‘তুমি নোট চেয়েছিলে। আমি সবগুলো সাবজেক্টের নোট আর লেকচার ফটোকপি করে নিয়ে এসেছি। এই ব্যাগে আছে। ডাক্তার বললো, এক-দুই দিনের মধ্যেই বাসায় ফিরতে পারবে। বাসায় ফিরেই পড়া শুরু কোরো। পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। কোনো দরকার লাগলে আমাকে ফোন কোরো। কেমন? তাহলে আজকে আমি আসি, আচ্ছা?’ দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে আবার পেছন ফেরে ইমন। ‘দেখো, তিন্নি, পরীক্ষাটা দিও। পরীক্ষার দিন মাথা উঁচু করে ক্যাম্পাসে এসো। পরীক্ষায় তোমাকে ভালো করতেই হবে। জীবন তো এখানে শেষ নয়! দোষটা তো তোমার একার নয়। একটা ছেলেকে বিশ্বাস করেছিলে। সে তার মর্যাদা রাখেনি। দোষটা তারও। আর দোষটা সেইসব লোকেরও, যারা ইন্টারনেট থেকে সেগুলো ডাউনলোড করে দেখেছে। তাহলে তুমি কেন মরবে? তুমি ওদের দেখিয়ে দাও, যে তুমি কাপুরুষ না। তুমি হোঁচট খেয়ে উঠে দাঁড়াতে জানো। তুমি সমাজের কটাক্ষ উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে জানো। সবাইকে দেখিয়ে দাও, যে তুমি নারী!’
ঘটনাটা তিন বছর আগের। তিন্নি বিয়ে করেছে। একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে ওর। এখনো ইমনের ওই কথাগুলো ওর কানে ভাসে। ‘তুমি নারী! তুমি নারী!!’ নারী হওয়া যে গর্বের বিষয়- সেটা তাকে ইমন শিখিয়েছিলো। সত্যিই তো! নারীরাই পারে হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে। নারীরাই পারে শত অন্যায় অত্যাচার মুখ বুঁজে সহ্য করেও শতভাগ আন্তরিকতার সাথে ঘর-সংসার করতে, সন্তান মানুষ করতে। সেদিনের পরে সে আর পেছন ফিরে চায়নি। কারো চোখের সামনে কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায়নি কখনো। মাথা উঁচু করে পরীক্ষা দিয়েছিলো সে। রেজাল্ট আহামরি ভালো হয়নি, কিন্তু উতরে গিয়েছিলো ঠিকই। আজো, কখনো মনের কোণে কোথাও কোনো হীনমন্যতা জন্ম নিলে ও নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, ‘তুমি নারী! তুমি নারী!!’