রুমানা আপাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়ে গেছে। ‘লেবু বেশি কচলালে তিতা হয়’, এ লেবু তিক্ত হয়েছে অনেক আগেই। বিভিন্ন ব্লগে দেখলাম- এক শ্রেণীর ‘মানুষ’ তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যাপারটিকে লঘু করার এবং অপরাধীর পক্ষে সহানুভুতি টানার অপচেষ্টা করেছেন। আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, অন্ধ রক্ষণশীলতা ও পুরুষতান্ত্রিকতার কদর্য রুপটি বেশ সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এখন সময় এসেছে এর একটা ইতি টানার এবং এই ঘটনা থেকে আমরা আমাদের সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু বের করে আনতে পারি কিনা- সেটা ভেবে দেখার।
রুমানা আপার প্রতি আমাদের সবার সমবেদনা। তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন যাতে যথাসম্ভব সহজ হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধী স্বামীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি আমাদের সবার। তবে আমরা প্রায়শঃই ভুলে যাচ্ছি, যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের প্রত্যেকের অন্দরমহলের নিত্যকার গৃহনাট্যের একটা ক্ষুদ্র অঙ্ক মাত্র। Domestic violence যেমন একটি-দু’টি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি রুমানা মনজুর অধ্যায়ের মত সরলরৈখিক নয়।
আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত সমাজে বউ-পেটানো কোনো অপরাধ নয়। স্ত্রীরা স্বামী দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েই থাকে। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য এক মেয়ের সাথে ঘর করা শুরু করতে পারে। ফলে প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ওপর দায়িত্ব পড়ে সন্তানদের ভরনপোষণের ব্যবস্থা করার। ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে এহেন উদাহরণ অগণিত। এসব নারীরা সাধারণত কাজের বুয়া, গার্মেন্টস কর্মী কিংবা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। আমি খুব কাছে থেকে এ সমাজকে দেখিনি, কাজেই এর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা বোধহয় উচিত হবে না। তবে আমি অনেক স্বামী-পরিত্যাক্তা নারীকে দেখেছি নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে সন্তানের ভরণপোষণের কাজটি অক্লান্তভাবে করে যেতে। মাঝে মাঝে পুরনো স্ত্রীর কথা মনে পড়লে স্বামীদেবতা ফিরে আসেন কয়েক দিনের জন্য। তখন অনুগত স্ত্রীর মতো স্বামীর শয্যাসঙ্গী হয় সে। তার বহুদিন ধরে তিলে তিলে জমানো টাকাগুলো পকেটস্থ করে স্বামী আবার প্রস্থান করলে কাজের বুয়া ফেরত আসে পুরনো পেশায়।
মধ্যবিত্ত সমাজে নারী নির্যাতনের প্রকৃতি একটু ভিন্নরকম। ছোটবেলায় যখন হৈমন্তী পড়েছিলাম, তখন অবাক হয়ে ভেবেছিলাম- ‘দু’টো কটাক্ষ আর কুটকথা দিয়েই একটা মেয়েকে মেরে ফেলা যায়?’ আমার স্কুলের স্যার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের নায়িকাদের নাকি ‘ইলিশ মাছের প্রাণ’। বাঙালি নারী এত সহজে মরে না। তারা সর্বংসহা। আজ মনে হচ্ছে, আমাদের সৌভাগ্য যে তারা সর্বংসহা। আর কোনো পরিবারের কথা বলতে পারবো না, তবে আমার মা হৈমন্তী হলে তিনি দু’বছরও টিকতেন না। রুমানা আপারা দশ-বিশ বছরের মানসিক অত্যাচারে মরেননা। চোখ গেলে দিয়ে, নাক ছিঁড়ে ফেলে পুরো জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী করে দিয়েও এঁদেরকে হারানো যায় না। এ কারণেই হয়তো আমরা মাতৃভূমিকে মা বলি। এত রক্তক্ষরণ, এত ক্ষত নিয়ে আজো সে টিকে আছে। তার সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা রুপটি এতটুকু ম্লান হয়নি। এত রক্ত দিয়ে যে মায়ের পায়ের বেড়ি ছিঁড়েছি, তার সম্মান রাখতে পারিনি আমরা; সেখানে একজন জন্মদাত্রী পাবার জন্য তো সন্তানকে প্রসববেদনার মধ্য দিয়েও যেতে হয় না। তাহলে এই মায়ের সম্মান করতে শিখবো কোথা থেকে?
কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম! যা বলছিলাম, নারীদের গায়ে একটা আঁচড়ও না কেটে তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করা যায়। নারী নির্যাতন মানে শুধু শারীরিক অত্যাচার নয়। আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন ৯০ ভাগই মানসিক। এর সূচনা হয় বিয়ের পরে নারীর পায়ে বেড়ি পড়িয়ে। ঘর থেকে বেরোবার সময় বাসার সবার অনুমতি নিয়ে বের হওয়া, ফোনে কথা বেশি বলার জন্য তিরস্কার, কথায় কথায় মেয়ের পারিবারিক পরিচয় নিয়ে খোঁটা দেয়া- ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে নারীর ভেতরের মানুষটা মরে যেতে থাকে। সে পরিণত হয় নিছক একজন সেবাদাসীতে। আমার একজন দুঃসম্পর্কের কাকা একবার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। তাঁরা বংশপরম্পরায় মসজিদের ইমাম। শতভাগ ইসলামী পরিবার। সে পরিবারের কোনো নারী বোরকা ছাড়া বাইরে বেরোয়না। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা- তাঁর স্ত্রী হবে আধুনিকা। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা, ইংরেজী জানা, হিন্দী সিরিয়াল দেখা, মেকআপ করা শহরের মেয়ে। ‘তাহলে সে তোমাদের সাথে match করবে কিভাবে?’- আমার মায়ের প্রশ্ন। তাঁর উত্তর, ‘সেইটা সমস্যা না। বিয়ের পরে বোরকা পড়বে!’ ‘কিন্তু শিক্ষিত মেয়ে তো চাকরি করতে চাইবে!’ ‘সেইটা তখন দেখা যাবে’। এই হলো আমাদের দেশের পুরুষ। আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ শিকার করে খাঁচার পোরায় বোধহয় তারা পৌরুষ খুঁজে পায়। একজন নারীর ব্যাক্তিত্বকে খুন করে বোধহয় তারা নিজের পুরুষ-জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।
আমরা সবাই নারী নির্যাতনকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছি। কিন্তু এটা সমস্যা নয়, উপসর্গ মাত্র। সমস্যা আমাদের মানসিকতা। ধর্মে স্বর্গকে নারীর পদতলে স্থান দেয়া হয়, সাহিত্যে নারীকে উপাস্যে পরিণত করা হয়। কিন্তু বই থেকে বেরিয়ে বাস্তব জীবনে এসে আমরা আমাদের মায়ের মাঝে, আমাদের স্ত্রীর মাঝে সেই মহিমাময়ী নারীকে খোঁজার কোনো চেষ্টা করিনা। একটা কন্যা সন্তান কৈশরে পদার্পনের পূর্বেই তাকে বুকে আঁচল টানা শেখানো হয়। কিন্তু একটা পুত্রসন্তানকে শেখানো হয় না দৃষ্টি সম্বরণ করা। একটা মেয়ে বিবাহযোগ্যা হবার পূর্বেই তাকে রন্ধনকর্মে সুনিপুণ করে তোলা হয়, কিন্তু একটা ছেলেকে শেখানো হয় না নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে। ক্ষুধা পেলে আমরা মা’কে জোর গলায় হুকুম করি ডাইনিং টেবিল প্রস্তুত করতে, কিন্তু ঈদের নামাজ পড়ে এসে মা’কে সালাম করতে ভুলে যাই প্রায়শঃই। আমাদেরই বা দোষ কোথায় বলুন? বাবাকে সালাম করতে ভুলে গেলে মা মনে করিয়ে দেন- ‘আব্বুকে সালাম করসো?’ কিন্তু বাবা কখনো জানতে চাননা যে মা’কে সালাম করেছি কিনা। বাবার জন্মদিন ভুলে গেলে মা মনে করিয়ে দেন, কিন্তু মায়েদের জন্মদিন নিয়ে বাবাদের মাথাব্যাথা থাকে না কখনো। এরকম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারগুলো শৈশব থেকেই আমাদেরকে শেখায় সমাজে নারী এবং পুরুষের ভিন্ন অবস্থানের ব্যাপারটি। আর পরিবার নামক পাঠশালা থেকে শেখা এই জ্ঞান আমরা প্রয়োগ করে চলি জীবনভর।
আমি জানিনা এ সমস্যার সমাধান কোথায়। তবে সময় এসেছে ভেবে দেখার। সময় এসেছে আপনার পরিবারের পুত্রসন্তানটিকে তার কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করার। নারীকে সাহিত্যে দেবী আর বাস্তবে দাসী না করে উভয় স্থানেই মানবীর মর্যাদা দেবার। আমার এ লেখাটি পড়ে সমাজে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসবে না। একটা কেন, এরকম একশ’টা লেখায়ও সমাজের কিছু যাবে-আসবে না। তবে এই লেখাটি যদি আপনাকে একটু ভাবায়, আপনি যদি পরিবারের নারী সদস্যটিকে আলতো আলিঙ্গন করে তার অবদান ও আত্নত্যাগের জন্য একবার কৃতজ্ঞতা জানান, তাহলে আমি নিজেকে সার্থক মনে করবো।