বাঘ এক রহস্যের নাম।
বর্তমানে বাংলাদেশে বাঘ বলতে আমরা সকলে বুঝি সুন্দরবনের কোন মতে বেঁচে থাকা শ'খানেক রয়েল বেঙ্গল টাইগারগুলোকে। এক সময়ে বাংলাদেশের ১৭ জেলার(সেই সময়ে) ১১ টিতেই বাঘ ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে সাধারণত বলা যায় বাঘ টিকে আছে শুধু সুন্দরবনে।
আর অফিসিয়ালি বললে সুন্দরবন আর সম্ভবত অল্পকয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে।
অনেকে আবার সিলেটেও গুটিকয়েক বাঘ 'থাকতে' পারে বলে মনে করে। তবে তা অনিশ্চিত। আমার প্রশ্ন এই অনিশ্চিত 'গুটিকয়েক' বাঘ গুলো কে নিয়ে।
বাঘ হলো সবচেয়ে বড় বিড়াল প্রজাতি। বাংলাদেশের বাঘ হলো বেঙ্গল উপপ্রজাতির। আর বেঙ্গল ও আমুর টাইগার গুলো কে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বাঘ প্রজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের সুন্দরবনের বেঙ্গল বাঘগুলো আকারে বেশ ছোট হয়। মূলত খাবারের স্বল্পতা ও লোনা পানির প্রতিকূল পরিবেশের জন্য আমাদের বাঘ মহাশয়ের এ পরিণতি।
যাই হোক আমার প্রশ্ন হল আদৌ কি সুন্দরবন বাদে কোথাও বাঘ আছে ? নাকি সব কিছুই হারিয়ে গেছে। এখানে এক জিনিস বলে রাখা ভালো আমি বাঘ বলতে অবশ্যই আবাসিক বাঘ অর্থাৎ স্থায়ী বাঘকে বুঝিয়েছি আর যে বনে বাস করে তা হতে হবে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর। অপর দেশ থেকে চলে আসা পরিযায়ী বাঘ গুলোকে গুনায়ে ধরলে হয় না। আমি আবার ছোটবেলা থেকেই বাঘ নিয়ে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করি। আমার বাসা সিলেটে হওয়ায় সিলেটে বনাঞ্চল নিয়েই আগে শুরু করা যাক। সিলেটের নেশনাল পার্কগুলোতে বাঘ নেই আমি ১০০% নিশ্চিত। তবে নেশনাল পারক গুলো হয় নির্দিষ্ট ফরেস্ট রিসার্ভের অল্প কিছু অংশ নিয়ে। সাতছড়ি বনে বাঘ নেই জানি। আদমপুর ও লাওয়াছড়া ফরেস্ট রিসার্ভেও সম্ভাবনা নাই। বাকি রইলো একটি রেমা কালেঙ্গা যা সিলেটের সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আর সবচেয়ে রিমোট অঞ্চলগুলোর একটি। তো এখানে কি বাঘ থাকতে পারে ?
আমি আমার জীবনে যত বাঘ নিয়ে গল্প বা সত্যিকারের অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনেছি তার বেশিরভাগ রেমা কালেঙ্গাকে ঘিরে।
প্রথম ঘটনা ২০০৬/৭ এর দিকে। গ্রামে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা লেবার শ্রেণীর শ্রমিক গুলোর সাথে মাঝেমধ্যে বিকেল বেলায় আড্ডায় বসতাম। তখন এক লোকের কাছে শুনেছিলাম কিভাবে তিনি একবার রেমা কালেঙ্গার বনে গাছ কাটার সময়ে বাঘ দেখে পালিয়ে এসেছিলেন। সময়ের হিসেবে সেটি হবে ২০০৫ এর দিকে। আমি গল্প শুনে মনে করেছিলাম বড় আকারের মেছো বাঘের কথা বলছেন হয়ত। পরে তিনি বললেন সেটা বড় বাঘ ছিল। আমি তখনও বুঝতে পারি নাই যে টাইগারের কথা বলছেন। মনে করছিলাম চিতাবাঘের কথা বলছিলেন। পরবর্তীতে মা খাবারের জন্য ডাক দিলে আমি বললাম ''মা নয়নদা'র চিতাবাঘের কাহিনী শেষ করে আসছি"। তখনই তিনি বললেন "ডোরাকাটা বাঘ বাবা..ডোরাকাটা বাঘ"। আমি তো থ হয়ে গেলাম, বলে কি লোকটা সিলেট অঞ্চলে বাঘ ! তখনই মনে বাঘ ও রেমা কালেঙ্গা আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেল ।
যাই হোক তবুও আমার কাছে মনে হয়েছে যে তিনি ভুল দেখেছিলেন.. হয়তবা।
পরবর্তীতে ২০১২ তে সাতছড়ি বনে কালো ভল্লুক খুজছি। গাইডও আমাকে ভল্লুকের পায়ের ছাপ দেখাচ্ছিল। তো আমার সাথে আরও ছিলেন আমার বাবার বন্ধু অর্থাৎ আমার আঙ্কেল। উনার বাসা আবার চুনারুঘাট টাউনে। কাঠ মিস্ত্রির ব্যবসা উনার। আর কাঠ মানে গাছ। আর গাছ কাটা হয় বন জঙ্গল থেকেই। ফিরে যাওয়ার সময়ে তাকে এমনিতে জিজ্ঞাসা করলা "রেমা ও কালেঙ্গা পাহাড়ে ভল্লুক আছে নাকি, আঙ্কেল?।" তিনি বললেন "অবশ্যই।এমনকি গত ২ বছর আগেও ইয়া বড় টাইগার দেখলাম রেমা পাহাড়ে। আমার জীপ গাড়ির সামনে এসে হাজির..কিছুক্ষণ পর ঝোপে চইলা গেলোগা। অনেক ডর পাইছিলাম।" আমি বেশ অবাক হলাম। 'সঠিক দেখছেন তো' জিজ্ঞেস করার আগেই সাতছড়ির গাইড টা বলা শুরু করল "ভুল দেখছেন মনে হয়, চাচা। চিতাবাঘই আর নাইগা আর বাঘ ( হাসি )। মনে হয় রাস্তা ভুইলা চিড়িয়াখানায় ঢুইককা পরছিলেন..।" আঙ্কেল বললেন 'ফাইজলামি করছি না। যা দেখছি তাই বললাম। মিছা মাত মাতার লোক আমি না। ভুলও দেখি নাই'।
যাই হোক বাসায় বাবা কে আঙ্কেলের কথাটা বললে বাবা হেসে ফেলল, 'খুব বেশি হইলে মোটাতাজা মেছো বিড়াল দেখতে পারে।'
আমারও মনে হইল উনি ভুল দেখছেন।
কিন্তু... কিন্তু মেছো বিড়াল যতই বড় হোক খুব বেশি হইলে চিতাবাঘ মনে হতে পরে। আবার মোটাসোটা চিতা বিড়াল কে দুর থেকে ছোটখাটো চিতাবাঘ মনে করা ভুলের কিছু না। কিন্তু বাঘ ভাবা কখনও সম্ভব না। আকারের কথা বাদই দিলাম চিতা বিড়াল বা মেছো বিড়াল কারওর গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ নাই। বরং চিতাবাঘ এর মতো গোল গোল কালো বৃত্তের মতো সারা দেহ জুড়ে থাকে। আবার আঙ্কেল 'বাঘ' টাকে বেশ কাছ থেকেই দেখেছেন। স্বাভাবিক থেকে একটু বড় মেছো বিড়ালকে(আই মিন ডোরাকাটা মেছো বিড়াল ) কে এত কাছ থেকে 'বাঘ' মনে করার কোন কারণ নেই। হ্যা তবে যদি কেউ বাঘ সেজে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে থাকে.. তাহলে অন্য কথা ।
এরকম আরোও কিছু 'রিপোর্ট' আছে বাঘ এর সেখানে।
এখনও আমার ব্যক্তিগত অভিমত রেমা কালেঙ্গাতে 'বাঘ' নেই। কিন্তু এতজনের বাঘ দেখা কি সবই ভুল ?
আমার দাদুর কাছে বাঘ ধরার বেশ কিছু কাহিনী শুনেছি । সবই আদমপুর রিসার্ভ ফরেস্ট কেন্দ্রিক। এবং ৪০-৫০ দশকের কথা।
আমদের দাদুবাড়ির বাসার বেশ কাছেই আদমপুর বন এলাকা। তখন তো একদম কাছেই লাগোয়া ছিল। যখন শীতকালে নদী শুকিয়ে গভীরতা কমে যেত তখন বাঘ মাঝেমধ্যেই লোকালয়ে চলে আসত। বাঘ ধরার এক প্রকার খেদা ব্যবহার করা হত তখন। বেশ রোমাঞ্চকর কথাই। এখন কিছুইনাই।
যাই হোক রেমা কালেঙ্গা বাদে আরেকটা সিলেটিয় গভীর বন এলাকা যেখানে 'বাঘ' কে দেখেছে কেউ কেউ তা হলো ভারতীয় সীমান্তের লাগোয়া 'লাঠিটিলা' বনাঞ্চল।
তবে সবকিছু হলো লোকমুখে 'সে দেখেছে.. ও দেখেছে'। কিন্তু নিজে দেখেছে এমন লোক পাই নি। আর আমিও কখনো সে দিকে যাই নি। আর দাদুবাড়িও সে দিকে নাই আর তাই পরিচিত লোকও খুব একটা নাই। তাই এ বিষয়ে আমার মতামত শুন্য।
আমি অবশ্য এখনো সিলেট বনাঞ্চলে বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান। সিলেটের বনাঞ্চল কোন ক্রমেই বাঘের জন্য সুইটেবোল না। থাকলেও তা পথ ভুলা ভারতের বাঘ বা হয়তবা মানুষের চোখের ভুল। আর তাছাড়া যারা গভীর বনে নিয়মিত কাজ করে তাদের মধ্যেও বাঘ দেখেছে এমন লোক পাওয়া বেশ দুষ্কর।
সবমিলিয়ে বলা যায় সিলেটে বনাঞ্চলে বাঘ দেখা আর ভুত দেখা একই জিনিস। যে স্বচক্ষে দেখেছে তার কাছেই সেটা সত্য। অন্য কারও তা বিশ্বাস হতেও পারে নাও হতে পারে। এটা যার যার বিষয়।
প্রকৃতি সত্যিই বেশ রহস্যময় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৪