১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণ আদালতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে সারা বাংলাদেশে আলোড়ন তুলেছিলেন জাহানারা ইমাম। এই রায় বাস্তবায়নের জন্য তিনি এক অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নিহত পূত্র শাফী ইমাম রুমির মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা তাঁকে আম্মা
বলে ডাকতেন। নিজেকে তিনি আম্মা বলেই বিশ্বাস করতেন। সেই শক্তিতেই তিনি ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের দূর্বিনীত সন্তানদের দিয়ে এমন একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি পরলোক গমন করেন।
জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে বাঙালী রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। বাবা ছিলেন অত্যন্ত দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার উদার মানসিকতার জন্য তিনি একজন রুচিশীল এবং আধুনিক মানুষ হতে পেরেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী হয়ে উঠেন। সুদূর মফস্বলে থেকেও জেনেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাস। রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় অঞ্জলী নামের বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মীর সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে শোষিত, লাঞ্চিত, নির্বাক মানুষের কথা জানতে পারেন। কিন্তু অঞ্জলীর সাথে মেলামেশা বাবা পছন্দ করতেননা বলে রাজনীতি আর করা হয়ে উঠেনি।
রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও জাহানারা ইমাম এ সময় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হন।তিনি কিশোরী মেয়েদের নিয়ে মুকুল ফৌজ গঠন করেন। মেয়েদের নিয়ে প্যারেড , কাপড় বুনন, নাচ-গান-নাটকের মহড়া, হাম্দ-নাতের প্রতিযোগিতা,গরিব শিশুদের মধ্যে দুধ বিতরন ইত্যাদি কাজ করতেন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বাড়িতে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত যত বই ছিল সব পড়েফেলেছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তাঁর মধ্যে কোন মিথ্যাচার ভন্ডামি ছিলনা।অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা ও অদ্ভূত সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের এই তরুনী অতি অল্প সময়ের মধ্যে বহুজনের আদর্শ হয়ে উঠেন।
রংপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে ভর্তি হন।তাঁর স্বামী শরিফুল ইমাম আহমেদ ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তিনি ছিলেন মুক্ত ও পরিশীলিত মনের মানুষ।জাহানারা ইমামের জীবনের পরিপূর্ন বিকাশ ঘটেছে স্বামীর ঘর থেকেই। বিয়ের পর তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে গিয়েছেন। ষাটের দশকে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কোন উগ্রতা ছিলনা। হালকা রংয়ের শাড়ী পড়তেন, গয়না পড়তেননা। এমনকি তাঁর বিয়েও হয়েছিল চিরাচরিত বেনারসী শাড়ীর বদলে সাদা সলোয়ার কামিজ আর বেলী ফুলের গয়না পড়ে।
স্বামী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে পরিপূর্ন সুখি ছিলেন। কিন্তু একাত্তরে ছেলে রুমি আর প্রাণপ্রিয় স্বামীকে হারিয়ে নিদারুন শোকের হাহাকারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও নিয়তির কাছে আত্নসমর্পণ করেননি।দুখের অতলে ডুব দিয়ে অভিঞ্জতার সব নির্যাস নিয়ে রচনা করেন 'একাত্তরের দিনগুলি'।এছাড়াও বেশ কিছু গ্রন্হ রচনা করেছেন।
নব্বইয়ের দশকে মুক্তাযুদ্ধের পরাজিত শক্তির উথ্থানে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তার পটভূমিতে ১৯৯২ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হলে জাহানারা ইমাম এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য ১৯৯০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন এই মহীয়সী নারীর মহাপ্রয়ান ঘটে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১২ রাত ৮:০৯