somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাইওয়ে টু বাইপাস

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। রাতের নির্জনতায় পথ শেষ না হওয়ার হাইওয়ে। ক’দিন হলো হেমন্ত প্রকৃতির কোলে আবাস গেড়েছে। সকালে হালকা কুয়াশা, মিষ্টি রোদ আর ঘাসের ডগায় চিকচিকে নিওর। কাঁপুনি দিয়ে শীত না করলেও এক রকম ভাল লাগার শীত অনুভূত হচ্ছিল শরীরে। প্রকৃতি থেকে অদ্ভুদ রকমের একটা গন্ধ অনুভব করছিলাম। পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে দু’একটা করে ট্রাক যাচ্ছে। আবার কখনও কখনও দূরপাল্লার বাস বিকট শব্দে হর্ন বাজাতে কার্পন্য করছে না। হর্ণের শব্দ প্রবল! বিচ্ছিরি রকমের শব্দ হলেও ভাল লাগছিল তখন। অন্ধকার নির্জনতায় ভয় ভয় মানসিকতা থেকে একটু হলেও সরতে পারছিলাম শব্দের কারণে। হাইওয়ের আশপাশে কাছে কোথাও কোন ঘরবাড়ি নেই! চারপাশে গাছের সারি। বন! কুকুরের চেয়ে শেয়ালের অস্তিত্ব বেশি হবে এই ঘনবনে। আমরা হেঁটে চলেছি লোকালয়ের খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে অনু বললো- জুলফি আর কতদূর? আমরা কি আজ শেয়ালদের রাতের খাবার হতে চলেছি। অনু জানে কথাটা জিজ্ঞেস করলে আমি রেগে যাবো। তবু ইচ্ছে করেই করলো। আমি কোন কথা বললাম না। অনু’র ঘাড়ে আমার বাম হাতটা ছিল। ওকে বাম বুকের সাথে জড়িয়ে কোন কথা না বলে হেঁটে চললাম।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় দূর থেকে একটা আলো চোখে পড়লো। আমরা আলোকে অনুসরণ করতে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর পৌছালাম সেখানে। বাইপাসের মোড়ে একটা চায়ের দোকান। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ১১টার মতো। হেমন্তের এই সময়টাতে ফাঁকা জায়গাগুলোতে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হয়। তাছাড়া মধ্যরাতের সময় হালকা কুয়াশা শীতের আগমনী বার্তা জানায়। পরিবেশটা মনকে নাড়া দিয়ে যায়। চা দোকানী চাচা শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে চুলার পাশে দাড়িয়ে কাপ আর গ্লাসগুলো পরিষ্কার করছিল। দোকানে আর কোন ব্যক্তি ছিল না। চা দোকানী চাচাকে বললাম, চাচা বড্ড খিদে পেয়েছে। খাবার দাবার কিছু আছে? দোকানী চাচা বললেন, বিস্কুট আর কেক ছাড়া কিছু নেই। এমন সময় একটা শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম। অনু বয়াম থেকে বিস্কুট আর কেক বের করছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। অনুকে অনুসরণ ও অনুকরণের উদ্দেশ্যে এগুলাম। দোকানী চাচা বললো, চা কিন্তু পাবেন না। চুলা নিভায়া ফেলছি। আমি বললাম ঠিক আছে, লাগবে না। চাচা বললো, আপনারা কই যাবেন? আমি কিছু না বলে অনুর দিকে তাকালাম। অনু কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো, চাচা আপনি থামেন তো, আমরা যেখানে যাবো, যাবো!
দূর থেকে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হয়তো খুব কাছেই রেলক্রসিং। শব্দটা আরো কাছে চলে এলো। ঘুমন্ত এলাকা কিছুক্ষণের জন্য জেগে উঠলো। আমরা ট্রেন দেখতে পেলাম। পশ্চিম থেকে ট্রেনটা পূর্বমুখে কিছু না বলে শব্দ করতে করতে চলে গেলো। চাচাকে বললাম, চাচা এখান থেকে শহর কতদূরে? চাচা জানালো, ৭ কিলো’র মতো হবে। আশপাশে কোন হোটেল আছে জিজ্ঞেস করতেই চাচা বললো, ‘হ’ আছে। এখান থেকে ৩-৪ কিলো পরে একটা ফিলিং স্টেশন আছে। ওপাশে একটা হোটেল। কিন্তু মাইয়া লোক নিয়া থাকতে পারবেন না। আমি আবার অনুর দিকে তাকালাম। তারপর অনুকে বললাম চলো। চাচা বললো, ঐদিকে একা একা কই যান, বিপদে পড়বেন কিন্তু। রাতটা না হয় আমার বাড়িতেই থেকে যাবেন। তখন অনু আবার বললো, চাচা আপনি থামেন তো। আমরা যাবো, যাবো। বিপদে পড়লে, পড়বো। চাচা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করলো। আমরা বাইপাস দিয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। দু’পাশ দিয়ে ছোটবড় গাছপালা। মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্ট। ল্যাম্পপোস্টের লাইটে আলো পোকাগুলো উড়াউড়ি করছে।
অনু বলে উঠলো, ধুর তোমার বুড়া চাচা। আমি তোমার সাথে হেঁটে বেড়াবো আর বুড়ায় কয় রাতটা ওর বাড়িতে থেকে যেতে। তারপর বললো, শোনো জুলফিকার, আমি যখন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়বো তখন একটা সুপারম্যান গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গ দিয়ে নিয়ে যাবে। আমি কিছুক্ষণ কোন কথা বললাম না। অনু বললো, জুলফিকার কথা বলো। এবার বললাম, তুমি ক্লান্ত হওনি? অনু বললো, না তো! আমি বললাম-তাহলে ওভাবে বিস্কুট কেক খেয়ে ফেললে কিভাবে? অনু জানালো, আমার তো ক্ষুধা পেয়েছিল। ক্লান্ত হইনি বলেই আমার হাত ছাড়িয়ে অনু এক দৌড় দিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা ব্রীজের উপর গিয়ে থামলো। দক্ষিণপাশটায় গিয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে দু’হাতে ব্রীজের রেলিং ধরে শ্বাস নিচ্ছে অনু। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো, দক্ষিন দিক থেকে ভেসে আসা বাতাস আর মাথার উপরে দাড়িয়ে থাকা চাঁদ। সবকিছু মিলিয়েই অনুকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি পকেট থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বাললাম। অনু সিগারেটের ধোয়া উড়া দেখেই আমার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে বললো, ওই থাম, থাম। অনু আমাকে ধরে ফেলবে এমন দুরত্বে থাকাবস্থায় আমি সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলাম। সিগারেট ফেলে দেওয়ায় অনু আমার হাত কামড়ে দিল। বললো, ঐ গাধা আমাকে সিগারেট দিলি না ক্যান? কোন কথা বললাম না। অনু বকে যাচ্ছে। এবার অনুকে থামিয়ে বললাম, নিকোটিন সর্বস্ব ভাবনাগুলো আজ গোলকধাধায় ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে, লাল মাংসে দাঁত বসিয়ে কুকুরগুলো এ্যালকোহলিক ঢেঁকুর তুলছে। অনু বললো, তাতে কি? আমি বললাম, তাতে বাধা নেই মোটেও, বিপত্তিটা মূলত সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। স্যাঁতসেঁতে মেঝের শ্যাওলাগুলো কেন চোখ পাকিয়ে তাকায়। ওখানেই জন্মিবে, ওখানেই মরিবে, বিস্তৃতি লাভের আশায় ঠোট কেন কামড়ায়? অনু বললো, তুমি ওদেরকেই জিজ্ঞেস করো তো। আমি জানি না ওসব। অনুর বকে যাওয়ায় মনোযোগ দিলাম না। অনুকে সাথে নিয়ে হেঁটে চললাম।
আমরা হাটছি। অনু আমার হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো, জুলফিকার, আমি গাড়ি থেকে ওভাবে দৌড় দিলাম। তুমি ওভাবে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলে, তোমাকে বিরক্ত করলাম আমাকে বকা দিলেনা কেন? কোন উত্তর দিলাম না। ওর দিকে তাকালাম একবার। কথা বললাম না। অনু বকেই যাচ্ছে। নির্জন রাত রাস্তার দুপাশে ঝোপঝাড়। ঝিঝি পোকাগুলোর চেচামেচি কান ভেদ করে হৃদয় স্পর্শ করছে। অন্যরকম ভাল লাগছিল। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম অনুর জন্য। মাঝরাতে পায়ে হেঁটে চলা যুগলের শত্রু বোধহয় সবকিছুই। মাথার উপর দিয়ে একটা হুতুমপেঁচা উড়ে যাওয়া দেখে অনু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, জুলফিকার, জুলফিকার দেখ ওটা। আমি কথা না বলে হেঁটে চললাম। হঠাৎ অনু দাড়িয়ে গেল। এবার বললো- দাড়াও জুলফিকার। দাড়িয়ে গেলাম। তারপর বললো, কথা বলছো না কেন? তুমি বকা দিচ্ছ না কেন? তুমি কি ভেবেছো এভাবে চুপচাপ থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? শোনো আমি আবার পালাবো।
- বললাম, অনু তোমায় ভালবাসি।
- ভালবাসো তো মেরেছো কেন?
- কখন মারলাম!
- না তুমি মেরেছো। তুমি আমাকে মেরেছো। আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তুমি আমাকে মেরেছো। তুমি আমাকে ঐ চেয়ারটা দিয়ে মেরেছো।
- না মারিনি তোমায়।
- আমি দেখেছি তুমি আমায় মেরেছো। মিথ্যা বলছো কেন? আমার সব মনে আছে। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়লাম তখন তুমি আমায় ধাক্কা দিয়ে বালিশ থেকে ফেলে দিয়েছো তারপর তুমি আমায় থাপ্পড় মেরেছো। আমার চুল টেনেছো। আমাকে তুমি মেরেছো।
- আমি তোমাকে মারিনি। তুমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছো।
- তুমি স্বপ্নে আমাকে মারবে কেন? ছাড়ো তো আমার হাতটা ছাড়ো- এই বলে অনু ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে বললো, আমি যাবো না, তোমার সাথে যাবো না, তুমি আবার আমাকে মারবে। তুমি জুলফিকার যাও তো।
অনু আমার বিবাহিতা স্ত্রী। অনুর এরুপ আচরণ বিপদজনক। কিন্তু ওকে আগলে রাখতে আমার ভাল লাগে। আমার সব কিছু জুড়েই অনুময়। দীর্ঘ অবসাদগ্রস্ত জীবনের একবেলায় অনুর আগমন ঘটলো। তখন থেকেই বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ধীরে ধীরে শরতের সাদা মেঘের আকাশে রুপান্তর হতে থাকলো। আমরা নদী বেয়ে কাশবনে হারিয়ে গেলাম। অনু বাম হাতটা আমার বুকে রাখলো। বললাম, অনু, থামো। তারপর শার্টের বোতামটা খুলে বললাম, এবার ছোও। অনু এবার উদল বুকে হাত রাখলো। আমার অবসাদ, হতাশা দিনের পর দিন কমতে থাকলো।
লম্বা রাস্তা। দুর থেকে অনুকে অনেক ছোট লাগছে। আমি হেটে চলেছি। অনু কি বলছে বুঝতে পারছিনা। ওর হাতের ইশারায় জোরে হাটতে শুরু করলাম। অনেকখানি এগিয়েছি। ওর মুখে হয়রানির ছাপ। ওর কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। জুলফিকার তাড়াতাড়ি এসো, ঐ ভাইয়াগুলো আমাকে ধরে ফেলবে। কথাটা বুঝতেই দৌড়াতে শুরু করলাম। অনুর কাছে পৌঁছাতেই দেখি ৫ জনের একদল লোক এদিকে দৌড়ে আসছে। ওখানে দাড়িয়ে থাকলে ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যেই ওরা আমাদের ধরে ফেলবে। ওদের দেখে প্রচন্ড রাগ হলো অনুর উপর। গালে একটা চড় বসিয়ে বললাম, এই মেয়ে ওগুলো তোমার ভাইয়া? তো থাকো এখানে। ডাকছো কেন? বেশি জড়াজড়ি না করে ওর হাত ধরে উল্টো দিকে দৌড় দিলাম। আমরা খুব কাছাকাছি দুরত্বে দৌড়াচ্ছি। দীর্ঘ সময় দৌড়ানোর পর পেছন ফিরে তালাকাম। দেখলাম ওরা দৌড় থামিয়ে দাড়িয়ে গেছে। আমরা পুনরায় ব্রীজটির কাছাকাছি চলে এসছি। হয়তো ওদের সীমানা ও পর্যন্ত ছিল। আরো খানিকক্ষণ দৌড়িয়ে ব্রীজের উপর এসে দাঁড়ালাম। কি বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা। দু’জনেই হাফাচ্ছি। অনু ব্রীজের একপাশে গিয়ে চুপচাপ দাড়ালো। ওপাশে মুখ ফিরিয়ে কি বলছে বুঝে উঠতে পারছিনা । অনুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। চুপচাপ আমি। তখন ব্রীজের নিচের নদীর পানিতে চাঁদের আলো চকচক করছিল। আকাশের তারাগুলো খসে পড়ছিল জলের গভীরে। হেমন্তের বাতাস ব্রীজের দখিন থেকে উত্তরে প্রবাহিত হচ্ছিল। লক্ষ্য করলাম নদীর ধারে কিছু জনবসতি। অন্ধকারের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসা টিমটিমে আলো চোখে পড়লো। অনু জোরে জোরে শ^াস নিচ্ছে। আমি আর একটু এগিয়ে গেলাম। অনুর কাধে হাত রাখতেই ও বলে বসলো, তুমি আমাকে মেরেছো। আজকেও মেরেছো, কালকেও মেরেছো। তুমি ভাল না, তুমি ভাল না। অনুকে বুকে জড়িয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। বললাম, অনু ভালবাসি।
- ভালবাসো না ছাই। তারপর নদীর ধারের আলো দেখিয়ে বললো, আমি ওখানে যাবো।
- ওর কথায় বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠলো। বললাম, যাবো না। রাস্তা নেই যাওয়ার।
- তুমি পারো না বলেই অনু আমাকে সরিয়ে দিয়ে ব্রীজ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়লো।
নদীর মাঝখানটায় জলের প্রবল শব্দ হল। ব্রীজ থেকে পেছনে ক’পা এগিয়ে এলাম। শূণ্যতায় বুক ভরে উঠছিল। পকেট থেকে একটা গোল্ডলিফ বের করে জ্বাললাম। আমার গা ঘেমে যাচ্ছে। ঠোটে সিগারেট রেখে টান দিলাম। সাথে চোখ দুটো বন্ধ করলাম। নিজেকে অনুর অযোগ্য হিসেবে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম। আমি অনুকে ঘৃণা করতাম নাকি ভালবাসতাম? প্রশ্নটা মনে আসতেই মগজ থেকে উত্তর আসলো তুই ঘৃণা’ই করতি। ধপ করে বুজে ফেলা চোখ খুললাম। তখনও চাঁদটা নদীর মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল। চাঁদের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকলাম। চাঁদের চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে আরো পিছপা হলাম। ব্রীজের ওপাশের রেলিংয়ের সাথে পিঠ ঠেকে গেল। গুটিশুটি দিয়ে বসে পড়লাম সেখানে। একবার বাম পাশটায় তাকালাম। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমার দিকে তেড়ে আসছিল। আমি কিছু বললাম না। কুকুরটা চেচিয়ে যাচ্ছে। খুব বিরক্ত করছে কুকুরটা। আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। পকেট হাতড়ে কিছু পেলাম না। এক টুকরো মাংস দিতে পারলে কুকুরটা হয়তো থামতো নইলে চলে যেত। উহ! অসহ্য লাগছে ওর চিৎকর।
পাশেই একটা বড় ইটের টুকরো দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাঁড়ানো দেখে কুকুরটা একটু পেছনে সরে গেল। ইটের টুকরো টি হাতে নিতেই কুকুরটা আমার কাছে চলে এলো। এবার থেমেছে। আমার হাটুর নিচের অংশে মুখ লাগিয়ে ও শুকছিল। আমি আবারও ঐখানটায় গিয়ে বসলাম। কুকুরটিও আমার কাছে গিয়ে বসে লেজ নাড়াতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ চাঁদ আর কুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কুকুরের গায়ের রং লাল, চাঁদটি সাদা। কিন্তু চাঁদের রং পরিবর্তন হচ্ছে কেন? মাথার ভেতর প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। এক সময় চাঁদের রং পুরোটাই লাল মনে হতে লাগলো। চাঁদের রং লাল কেন! আহ! অসহ্য যন্ত্রণা মাথার ভেতর। মগজে প্রচন্ড শব্দ। চিৎকার, চেচামেচি। কি অসহ্য! আমার এক হাতে বড় ইটের খন্ড এক হাতে শার্টের বোতাম টেনে টেনে ছিড়ছিলাম। খুব জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। আমার চিৎকারের প্রতিধ্বনি আমার কানে এসে বিধতে লাগলো। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। সাথে কুকুরটির চিৎকার, মগজের ভেতর আওয়াজ, আকাশে লাল দগদগে চাঁদ! হাতে থাকা বড় ইটের খন্ডটি দিয়ে বাম হাতের আঙ্গুলগুলো থেতলে দিতে লাগলাম। আমার শরীর ঘামছে, কাঁপছে। এক সময় থেমে গেলাম। কুকুরটিও শব্দ করতে করতে থেমে গেল।
কিছুক্ষণ নিরবতার পর হাত উচিয়ে চোখের সামনে ধরলাম। আঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরছে। লক্ষ্য করলাম কুকুরটি সেই রক্ত রাস্তা থেকে চেটে চেটে খাচ্ছে। আমি রক্তমাখা হাত কুকুরটির চোখে মুখে মুছে দিতে লাগলাম। কুকুরটি আমার হাত জিভ দিয়ে চাটছে। আমার মাথার উপর লাল চাঁদ, আগুনের মতো তারা, চারদিক থেকে গরম বাতাস আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অন্য কোথাও। আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
আমার এই আচরণ নতুন নয়। প্রায় রাতেই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি কেউ একজন ছুরি হাতে আমাকে তাড়া করছে। তারপর সামনে থেকে দু’জন মুখে কাপড় বেধে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে বেধে ফেলে। তারপর ছুরি হাতে থাকা লোকটি আমার পা থেকে ছুরি দিয়ে কোপাতে শুরু করে। লোকটির মুখে কোন কাপড় বাধা না থাকলেও তার চেহারাটা ঝাপসা মনে হয়। আমার মস্তিস্কে ভয়ানক চিৎকারের শব্দ আঘাত হানে। আমি অস্থির হয়ে যাই। লোকটি যখন ধীরে ধীরে উর্ধাঙ্গে কোপাতে শুরু করে তখন আমার মাথার উপর চাঁদ দেখতে পাই। ঐ চাঁদটার রঙ দগদগে লাল।
অনুর সাথে বিয়ের পর প্রথম যেদিন এমন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় তখন অনেক বেশি হাঁপাচ্ছিলাম। অনুও ধরমর করে লাফিয়ে উঠে। কি হয়েছে প্রশ্নটি করার পরপর অনুকে বেশ ক’বার থাপ্পড় বসিয়ে দেই। জুলফিকার মারছো কেন প্রশ্নটি মগজে খুব বেশি আঘাত হানে। চোখ বড় বড় করে অনুর দিকে আরো প্রবল বেগে ঝাপিয়ে পড়ি। অনুর গলা টিপে দেই। অনুর চিৎকারে বাড়ির সবাইে এসে দরজায় খটখট শব্দ করছিল। আমি আরো বেশি করে অনুর গলা টিপে দিচ্ছিলাম। ওরা জানে আমার সমস্যাটি। তাই দরজা ভেঙে আমাকে বেধে ফেলেছিল। সেদিন এই সমস্যাটা হয়েছিল দীর্ঘদিন পর। কিন্তু অনুর সাথে বিয়ের পর সমস্যাটা খুব বেড়ে গেল। প্রায় রাতেই এমন হতো। ডাক্তার বলেছেন মৃত্যু ভীতি থেকে এই সমস্যার সৃষ্টি কিন্তু এরকম সমস্যা নাকি তার দেখা এটাই প্রথম। ডাক্তারের চিকিৎসাতেও মুক্তি পাইনি। বরং দিনদিন সমস্যাটা বেড়েই চলছিল।
তার ক’দিন পর সমস্যাটা এত তীব্র মনে হয়েছিল যে ঘুমের মাঝ থেকেই চিৎকার করতে করতে অনুকে ধাক্কা দিয়ে বালিশ থেকে নিচে ফেলে দিই। অনু দৌড়ে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ডাক্তার বলেছিল সমস্যাটা হলে অন্ধকার ঘর আলোকিত করতে। তবে মৃত্যু ভীতিটা কাটাতে পারলেই সমস্যাটা থেকে মুক্তি মিলতে পারে। তারপর প্রায় রাতেই এরকম ঘটনা ঘটতো। গতকাল সত্যিই আমি অনুকে চেয়ার দিয়ে খুব মেরেছি। যে কারণে অনু পালিয়ে যাচ্ছিল। অনুকে আমি খুব ভালবাসি তাই ওর সাথে বিচ্ছেদ মানতে পারছিলাম না। তাই ওর পেছনে ছুটেছি। কিন্তু অনু যে নদীর জলে ভেসে ওপাড়ে গেল!
ভাবতে ভাবতেই মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে গেল। চাঁদটা আবার দগদগে লাল রঙের মনে হচ্ছে। কুকুরটা আমার হাত তখনও চাটছিল। আবারও মগজের ভেতর শব্দ, চিৎকার চেচামেচি! আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। অনুভব করছিলাম কেউ একজন পেছন থেকে ছুরি হাতে এগিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করতে করতে কুকুরটিকে দু’পা দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। বাম হাত দিয়ে ওর নিচের পাটির দাঁত ধরে ওর মাথায় ইটের বড় খন্ডটি দিয়ে আঘাত করছি আর চিৎকার করছি আর ও আমার হাতের আঙ্গুল কামড়ে দিচ্ছে। এক সময় কুকুরটি নিস্তেজ হয়ে গেল। আমার মাথার যন্ত্রণাটা বেড়েই চলছে। মৃত কুকুরটিকে উঠিয়ে ব্রীজের উপর থেকে নিচে ফেলে দিলাম। নদীতে আবারও একই ধরণের শব্দ।
সংজ্ঞায় ফিরে এলাম। একটু আগে অনু ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকালাম চাঁদের সাদা আলো নদীতে ভাসছে। হাতে ক্ষতের ব্যাথা অনুভব করলাম। হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। অনু বলে চিৎকার করলাম। দৌড়ে গেলাম ওপাশটায়। ব্রীজের রেলিং ধরে চিৎকার করে কাঁদছি। নিচ থেকে আওয়াজ এলো, জুলফিকার.... জুলফিকার.....। নদীতে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম মাঝখানটায় অনু ভেজা শরীরে দাড়িয়ে আছে। শুনতে পেলাম, তুমি ভালো না। চেচিয়ে চেচিয়ে আমার গলা শেষ। তুমি শুনছো না কেন? আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছি। জুলফিকার তুমিও এসো না। দেখো নদীতে পানি নেই। এসো, আমরা ওদিকটায় যাই। বললাম, তোমায় ভালবাসি অনু। আমি আসছি। ব্রীজ থেকে ঝাপিয়ে পড়লাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্রগ্রামে যৌথবাহিনীর ওপর ইসকনের এসিড হামলা সাত পুলিশ আহত।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩

এসিড নিক্ষেপে আহত পুলিশ সদস্য



চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি তাদের কাছেই যাবে তারা তোমার মূল্য বুঝবে....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৪


মৃত্যুর পূর্বে একজন পিতা তার সন্তানকে কাছে ডেকে বললেন, 'এই নাও, এই ঘড়িটা আমি তোমাকে দিলাম। আমাকে দিয়েছিলো তোমার দাদা। ঘড়িটা দুইশত বছর আগের। তবে, ঘড়িটা নেওয়ার আগে তোমাকে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×