বইয়ের নাম ঃ নিঃসঙ্গ পাইন
লেখক ঃ জাহানারা ইমাম
"গাড়ি যাচ্ছিল লোন-পাইন রোড ধরে। রাস্তার পাশে খানিক দূরে-দূরে সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম লেখা। এ-রকম একটা সাইনবোর্ড পার হবার পর সাকিনা বলল, ‘কী অদ্ভুত নাম! লোন-পাইন রোড। মানে, নিঃসঙ্গ একাকী একটি পাইনগাছের রাস্তা।
স্ট্যানলি গম্ভীর-মুখ করে বলল ‘কী জানি। দেখা হলে জিজ্ঞেস করব। তবে আমার কী মনে হয় জানো? পাইনগাছ সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় একজায়গায় অনেকগুলো একসঙ্গে জন্মায়। মনে হয় কেউ কোনো পাহাড় থেকে একটা পাইন-চারা তুলে এনে এই রাস্তার ধারে লাগিয়েছিল। সেই নিঃসঙ্গ, একাকী গাছটার জন্যই হয়তো এ রাস্তাটার এই নাম হয়েছে।’"
খুব সাধারণ চোখ না পড়ার মতো ছোট্ট দুটো লাইন, কিন্তু গভীর তার ভাবার্থ.মানুষ যদি একটি গাছ হয়,তবে জীবন নামের রাস্তায় সে আসলেই বড়ই নিঃসঙ্গ।
নিঃসঙ্গ পাইন টার সাথে যেন মিল খুজে পাওয়া যায় নায়িকা্র জীবন প্রবাহের অভিজ্ঞতায়
চিরচেনা শহর, দেশ আর আত্মীয়স্বজনকে পিছনে ফেলে নতুন সংসার গোছাতে আমেরিকায় পারি দেয় সাদাসিধে সহজ-সরল মেয়ে সাকিনা।
"জীবনটা কি অতই সোজা, অঙ্কের মতো? এখানে সবসময় কি দুয়ে দুয়ে চার হয়?"
নতুন দেশে, নতুন জায়গায় স্থির হতে না হতে জীবনে একটা বিশাল ধাক্কার মুখোমুখি হয় সে। গল্পটা সাকিনার একার.. ঠিক ওই নি:সঙ্গ পাইন গাছটার মতোই।
"খালাম্মা বলেছিলেন, ‘কী করবে, সে সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে সাকিনা।’
সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে? সে কি জীবনে কোনোদিন নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? না, কেউ তাকে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিয়েছে? সে কী পড়বে, বাবা-মা ঠিক করে দিয়েছেন; সে কাকে বিয়ে করবে, বাবা-মা-খালা ঠিক করে দিয়েছেন। প্রথম বাচ্চা হবার সময় বাবা-মা ভাই-বোনের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে অচেনা দেশে এসেছে— সেটাও তার স্বামী ঠিক করে দিয়েছে। আর এখন তার জীবনের কঠিনতম সংকট ও সর্বনাশের সময় সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে!"
"না, জীবন নষ্ট হতে সে দেবে না। মনে পড়ল গতরাতে খালাম্মার ‘লেকচারের’ কথা : কোনো একজন মানুষের অভাবে অন্য একটি মানুষের জীবন নষ্ট হয় না, হতে পারে না। স্বামী চলে গেলে শুধু বাঙালি মেয়েরাই এ-ধরনের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু জীবন তো তা বলে না। চারদিকে চোখ মেলে দেখ। পৃথিবীতে অহরহই মানুষ এ-ধরনের চোট পাচ্ছে। আবার সেরেও উঠছে কিছুদিন কষ্ট পেয়ে। আসল কথা হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তুমি যদি নিজে রোজগার করতে পার, খাওয়া-পরা-থাকার জন্য কারো ওপর নির্ভর করতে না হয়, তাহলে দেখবে এসব মনের কষ্ট কাটিয়ে ওঠা যায়। ক্ষতচিহ্ন অবশ্য একটা থাকবে। হাত-পা ভাঙলে বা কাটলে যেমন সেরে যায়, ক্ষতচিহ্ন একটা থাকে কিন্তু তাতে আর ব্যথা লাগে না। তেমনি মনের মধ্যেও একটা ক্ষতচিহ্ন তোমার থাকবে। কিন্তু দেখবে, তাতে পরে আর কোনো কষ্ট থাকবে না মনে।"
বইয়ের সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় জাহানারা ইমাম নিজে। কারণ এই খালাম্মা আর কেউ নয়, জাহানারা ইমাম নিজে।
সেখানে বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘর ভেঙে যাওয়ার পর একা লড়াইয়ের পথটা বেশ সুখকর নয়,বিশাল পৃথিবী বহু দিকে এগিয়ে গেলেও আজন্ম সংস্কারে মানসিকভাবে পরনির্ভরশীলতার পরগাছা হয়ে
" আমি তোমার বধূ , তুমি আমার সবামী।
খোদার পরে তোমায় আমি বড় ব লে জানি।
এই বানী দিব্যজ্ঞানে আজো বাঙালির অস্থিমজ্জাগত।
এরকম একটি জায়গা থেকে জীবনের এক ভ্রান্তিকে ভুলতে অন্য ভ্রান্তিতে জড়িয়ে না পরা এক আটপৌরে সাধারণ মেয়ে গল্পের কারিগর জাহানারা ইমাম মনের অন্ধি-সন্ধিকে উলট পা ল ট র্করে পুনরায় ভাবতে বাধ্যই করে।
সু খ পাঠ্য বই টিকে সবারই ভাল লাগবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১:২২