নাবিলা এ খেলায় নতুন। নাবিলাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বউ-ছি খেলা। এ খেলা তেমন কঠিন না। বুদ্ধির সাথে সুযোগ বুঝে বউ নিজ ঘরে ফিরে আসতে পারলেই হয়। এ খেলায় দু’টি দল থাকে। দু’দলের মতে নির্দিষ্ট দূরত্বের মাঝে কোট কেটে খেলার শুরু হয়। এক দলের বউ নদীর ঘাটে পানি আনতে গিয়ে আটকা পরে। সে নিজ ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করে। অপর দল তাকে বাঁধা দেয়, মানে ছুইয়ে দেয়। ছুইতে পারলেই তার দলের হার হয়। না পারলে জিত। বউ-এর দলের সদস্যরা অপর দলের সদস্যদের ছি-দম করে তাড়া করে। ছি-দম করে কাউকে ছুইতে পারলে সে মারা যায়। এভাবে যাকে তাড়া করে ছুইতে পারা যায়, সে মারা যায়। কিন্তু ছি-দম করে অপর দলের সদস্যকে মারতে গিয়ে দম শেষ হলে আবার নিজেই মারা যাবে প্রতিপক্ষের হাতে।এভাবে ক্রমান্বয়ে দু-দলের সদস্যই কমতে থাকে। সুযোগ বুঝে বউ ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করে।একবার নিজ দলের সবাই মারা যায়। নাবিলাকে চোখ বেঁধে ঘরে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়। এতেও দলের মন রক্ষা করতে পারেনি সে। অবশ্য খেলায় যে এরকম একটা নীয়ম আছে নাবিলাকে কেউ আগে বলেনি। তিন তিনবার খেলায় হেরে নাবিলার মন খারাপ। তবু কেউ কিছু বলছে না। অথচ পড়া-শোনার সামান্য কমতি হলেই গৃহশিক্ষক শাস্তি দেয়। মা বকুনি দেয়। মাঝে মাঝে বাবার কাছে নালিশ করে। নাবিলা শহরের মেয়ে। শহরের কেউ এ খেলা কখনো খেলে না। খেলার সুযোগও নেই। বাবার সাথে নাবিলা বড় চাচ্চুর বাসায় বেড়াতে এসেছে। নাবিলা ভাবতে লাগল- আগামীকাল খুব মনোযোগ দিয়ে খেলবে। জিতার চেষ্টা করবে।এ খেলায় সে নতুন বলে কেউ তাকে দম দিতে দেয়নি। শুধুমাত্র বউ বানিয়ে খেলা শেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। আগামীকাল আবার খেললে তাদের দলকে জিতাতেই হবে।
মাগরিবের আযান হবার সাথে সাথে সবাই খেলা শেষ করল। একে একে সবাই চলে গেল যে যার বাড়ি। নাবিলাও তার চাচাত ভাই রতন ও বোন সুমির সাথে ফিরছে। গ্রামে খেলাধূলার জায়গার কোন অভাব নেই। খোলামেলা সব জায়গায় এ খেলা খেলা যায়। খেলার জন্য প্রস্তুত থাকে ফলের বাগান, নদীর পাড়, খোলা মাঠ আবার কখনো কখনো বড় কোন বাড়ির দুয়ার। চারদিক হতে কিছুটা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আবচ্ছা অন্ধকারে হাঁটাটা রীতি মতো নাবিলার অভ্যাসের বাইরে। ভয়ে ভয়ে পা ফেলছে নাবিলা। আবার মনে মনে ভাবছে বাবা বকবে কিনা?
বড় চাচি বকবে কিনা?
হঠাৎ দেখা যায় কতগুলো প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করেছে। এতো প্রজাপতি কোথায় থেকে এলো?-নাবিলা বলল।
সুমি তেমন কিছু না বলে তার চেয়ে বয়সে বড় রতনের দিকে তাকালো। রতন বলতে লাগল-
বাবার কাছে শুনেছি প্রজাপতি, ফড়িং এরা নাকি মশা খায়। এ সময় মশারা ডোবা-নালা হতে ছুটে আসে গ্রামের বিভিন্ন ঘর লক্ষ্য করে। ঘরের মানুষেগুলোকে ইচ্ছে মতো কামড়াতে থাকে সারা রাত।
যাদের রক্ত মিঠা তাদের নাকি বেশি কামড়ায়। যাদের বাড়িতে মশারি আছে তারা বেঁচে যায়। তবে যারা গরীব মশারি নেই, তাদের কিছুই করার থাকে না। এতোটুকু শুনে নাবিলা চিন্তায় পড়ে গেল তার চাচ্চুর বাসায় মশারি আছে কিনা? ততক্ষণে সুমি বলে উঠল-
আপু চিন্তা করো না। আমাদের তিন ঘরেরই মশারি আছে। আবার নাবিলা মনোযোগ দিল প্রজাপতির দিকে। নানান রকম প্রজাপতি। বইয়ে কোন কোন প্রজাপতির ছবি সে দেখেছে তা মেলানো সম্ভব হচ্ছে না। বইয়ের প্রজাপতিগুলো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে প্রজাপতি আর ফড়িংগুলো যেন লুকোচুরি খেলছে। আবচ্ছা অন্ধকারে প্রজাপতিগুলো কখনো ফুলের উপর বসছে। কখনো হাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা পাখিকেও দেখা গেল এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে। ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে সব। আবার তারা পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।
রাতের খাওয়া শেষ। রতন ও সুমি কিছুক্ষণ বই নেড়ে-চেড়ে কি যেন পড়ল। এই ফাঁকে নাবিলা এঁকে ফেলল একটি গ্রামের দৃশ্য। সবাই বেশ প্রশংসার করল নাবিলার। প্রশংসার মাত্রা আরও একটু বাড়াতে নাবিলার বাবা বলতে লাগল-দেখতে হবে না মেয়েটি কার। সপ্তাহে তিনদিন করে একজন চারুশিক্ষকের কাছে আর্ট শিখাচ্ছি। এমন সুনামে নাবিলা খুশি হল কিনা বুঝা গেল না। নাবিলা এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো। তারা চাচাতো ভাই রতনও একই শ্রেণিতে। সুমি পড়ে ক্লাস থ্রীতে। সুমি থ্রী বানানটাও ঠিক করতে পারবে না। লেখাপড়ার প্রতি সুমির তেমন আগ্রহ নেই। তবে সুমি মাঝে মাঝে আজব সব প্রশ্ন করে বসে, বলে- পড়া-শোনা কে বানিয়েছে?
‘অনেক পড়লে সব জানতে পারবে’-এতোটুকু বলেই ক্ষান্ত নয় রতন। রতন বলে- তুমি তো কম পড়। কে বেশি কম পড়ে-এ নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়। তবে সুমির বিশ্বাস হয় না বেশি পড়লে সব জানা যাবে। তার মনে হয় পড়া-শোনা হয়তো তার দাদার দাদা বানিয়েছে। বাবার মুখে সুমি শুনেছে- আগের দিনের মানুষ শিক্ষকের বাসায় গিয়ে পড়ত। সুমির ধারণা তারা এখন বেঁচে নেই তাই স্কুলে যেতে হয়। সে আরও শুনেছে- তার এই ছোট চাচ্চু নাকি আগে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াতেন। সুমি মনে করে তার চাচ্চু নিশ্চয় তার দাদার দাদা’র কাছ থেকে সব শিখেছে। এখন অনেক কিছু ভুলে গেছে, তাই ঠিক মতো সব বলতে পারে না, বুঝাতে পারে না। অথচ অন্য কেউ না পারলে শাস্তি দেয়। সবাই পড়া না পাড়লে শাস্তি দেয়। কেউ বলে না, এই পড়াটা পড়তে হবে না।
রাতে নাবিলা, সুমি ও রতন দাদির সাথে দক্ষিণ ভিটের ছোট্ট ঘরটায় থাকবে। অন্য দুইটি ঘরের মধ্যে একটিতে নাবিলার বাবা এবং পাশেরটিতে বড় চাচ্চু ও চাচি। নাবিলা তার বাবাকে ভয় পায়। বাবা যখন নাবিলাকে তার সাথে থাকতে বললে তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দাদি যখনই বলে- সবাইকে নিয়ে আমি আমার ঐ ছোট্ট ঘরটায় থাকব। তিনজন-ই হৈচৈ করে ওঠে। নাবিলার বাবা ব্যাপারটা বুঝতে পারে। রতন আর নাবিলা বুদ্ধি করেছে রাতে দাদির সাথে ঘুমাবে। দাদিকে গল্প বলতে বলবে। রতনের কাছে শুনেছে দাদি অনেক মজার মজার গল্প জানে। কিন্তু একটি মশারির নিচে চারজন একটু কষ্টের হলেও সুমিকে অন্য ঘরে পাঠানো গেল না। সেও হয় তো বুঝতে পেরেছিল- আজ অনেক মজা হবে। যাই হোক, নাবিলাই প্রথম দাদিকে একটি গল্প বলতে বলল। দাদি মুচকি হেসে তাকালো রতন আর সুমির দিকে। রতন ও সুমি তাকিয়ে আছে দাদির দিকে। দাদির বুঝতে বাকী থাকল না- এতো ব্যবস্থা কিসের জন্য। নাবিলা আবার বলল- একটা ভূতের গল্প বল দাাদি।
একটু কাশি দিয়ে দাদি বলল- গল্প তো অনেকদিন ধরে বলি না। যেটা মনে আছে, সেটা বল-রতন বলল।
সুমি বলল- না ভূতের গল্প বলবে দাদি। বলতে শুরু করল দাদি-
একটি পুরনো বাড়ির দেবদারু গাছে থাকতো একটা লম্বা ভূত। ভূতের পা দু’টি অনেক লম্বা ছিল। গাছের ডালে বসে সে পা দুটি নাড়তে থাকত। হাত দু’টিও ছিল আরও লম্বা। মগডালে বসে বসেই হাত বাড়িয়ে দিতো এদিক সেদিক.. ।
হঠাৎ সুমি প্রশ্ন করে বসল- বড়’রা এতো কিছু জানে কি করে?
বড়দের অনেক কিছু জানতে হয়, অনেক কিছু জানলেই বড় হওয়া যায়- দাদির গম্ভীর উত্তর।
দাদির উত্তর শেষ হতে না হতে রতন বলে উঠল – বড়’রা এতো কিছু কিভাবে জানে?
আগের দিনেও মানুষ গল্প বলত। গল্প বলে ছেলে-মেয়েদের ঘুমপাড়াতো। আনন্দ দিতো। তবে সর্বনাশ হতো ভুলে গেলে। নতুন করে গল্প বানাতে হতো। এখন আর এমন কষ্ট করতে হয় না। বইয়ের পাতায় সব থাকে।
বইয়ে কি সব গল্পই আছে?
কেন থাকবেনা?
বউ-ছি খেলাও কি বইয়ে আছে দাদি? নাবিলা জানতে চাইল।
বইয়ে অনেক মজার মজার অনেক গল্প থাকে। দাদি ওদের কৌতূহলে বেশ খুশি হল।মুচকি হেসে আবার গল্পটা বলতে লাগল, ..ইয়া লম্বা ভুতটা..।
সকাল আটটা বাজে। ঘুম ভাঙ্গল নাবিলার। আশে-পাশে কেউ নেই। সকালে যে যার মতো ওঠে চলে গেছে । হঠাৎ নাবিলার চোখ পড়ল গতকালের আঁকা ছবিটার উপর। ছবিটির মাঝ বরাবর লাল কালিতে লেখা রয়েছে ‘সুমি’। নামটা দেখে সে বুঝতে পারে কাজটা নিশ্চয় সুমি করেছে। নিজের আঁকা ছবিটার উপর সুমির নাম দেখে প্রথমে খুব রাগ হল। একটু পরেই কি যেন কি ভেবে আবার শান্ত হল। বিছানা ছেড়ে উঠতেই দেখা গেল বড় চাচি নাস্তা করতে ডাকছে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকদিন । সকাল- সকাল ঘুম থেকে ওঠা প্রায় অভ্যাস হয়ে গেছে নাবিলার। খেলাধূলার মাঝে মজায় কাটছে দিন। অনেকগুলো খেলা সে এখন ভালোই পারে। না পারার মধ্যে শুধু আছে ‘সাঁতার কাটা’। যদিও সাঁতার কাটা কোন খেলা নয়। তবু গ্রামে নদী বা পুকুরের জলে হাবু-ডুবু খাওয়া আর সাঁতার কাটা অনেকটা খেলার মতো। এতেও অনেক প্রতিযোগিতা হয়। সাঁতার কাটা না জানলে- সেই মজাটা পাওয়া যায় না। পদ্মার পাড়ে যখন সবাই ঝাঁপা-ঝাপি করে গোসল করে তখন নাবিলা দাদিও হাত ধরে কয়েকটা ডুব দেয় মাত্র। এতেই যেন মনে হতে থাকে- আবার কুমির না এসে যায়। পদ্মা নদীতে নাকি কুমির আছে, শিশুক আছে, আছে নানা অজানা প্রাণি। বড় বড় টেউ যখন পায়ের উপর আচড়ে পরে তখন সে দৌঁড়ে চলে আসে ওপরে। দাদি কয়েকবার সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আত্ন ভয়ে নাবিলা যখন দাদিকে জড়িয়ে ধরে তখন উল্টো দাদিই কয়েক ঢোক পানি গিলে ফেলে সবার অজান্তে। অপর দিকে রতন, সুমিসহ বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে একবার নদীর ভিতরের দিকে যায় আবার ফিরে আসে।
পানির ঠিক ওপরের নরম বালুর মধ্যে আছে আরেক চমক। এখানে লাফা-লাফি করলে বালু নরম হয়। এক সময় ভিতরের পানি বালুসহ ফুলে ওঠে। বালু থেকে বের হয় ঝর্ণা। নরম বালু দু’হাতে সরিয়ে কেউ কেউ তৈরি করে গর্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই গর্তে জমে ওঠে টলঠলে পানি। সবার সাথে তাল মিলাতে না পেরে বড় হতাশ নাবিলা। তবে সুখের কথা হল- এসবের জন্যও বকা খেতে হয় বড়দের কাছ থেকে। অনেক মজায় মজায় কাটতে থাকে নাবিলার সময়..।
হঠাৎ একদিন রাতের খাবারের পর সবাই একটু চুপচাপ। নাবিলা বুঝতে পারছেনা ব্যাপারটা কি? বড় চাচ্চু এসে বলল- তুমি আরও কিছুদিন থেকে যাও নাবিলা। চাচি এসে বলল-ঢাকায় গিয়ে সব ভুলে যেওনা কিন্তু। সামনের বন্ধে তোমার আম্মুকে নিয়ে আবার এসো। নাবিলার আর বুঝতে বাকী থাকলনা, আগামীকাল সকালেই হয়তো তারা ঢাকায় ফিরছে।।
[গঠনমূলক সমালোচনা চাই। আপডেট হতে পারে। সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।]