শ্রদ্ধেয় ব্লগার @চাঁদগাজীর পোস্ট 'সামুর কোন কোন ব্লগার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন?' পড়ে মন্তব্য করতে গিয়েও মনে হল, আস্ত একটা পোস্ট লিখে ফেললেই বা কেমন হয়!
প্রিয় ব্লগার, আপনারা যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা কাছ থেকে দেখেছেন; তারা কি কখনো বিশ্বাস করবেন যদি বলি যে ৭১ পরবর্তি প্রজন্মের একটা বড় আফসোস ৭১-এর যুদ্ধে অংশ না নিতে পারা? আপনারা কি বিশ্বাস করবেন, যুদ্ধের কথা গভীর ভাবে ভাবতে গেলে প্রতিটা সময়ই আমাদের গায়ের রোম শিহরিত হয়! দু-চারজন কুলাঙ্গার বা ৭১-এর সুবিধাভোগীদের রক্তবীজেরা হয়ত এভাবে ভাবেনা; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ, আমি নিশ্চিত আমার সাথে একমত হবেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই চেতনাবোধ বা দেশপ্রেম তৈরি হওয়ার পেছনে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা খুবই কম। রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো ভান করেছে এরকম কিছু ঘটেইনি, আবার কখনো এটাকে পুঁজি করে ব্যবসা করেছে। ৭১-এর জন্য যেটুকু অনুভূতি যা তৈরি হয়েছে, তা মূলতঃ বাবা চাচাদের মুখে গল্প শুনে, তাদের আবেগকে সফলভাবে আমাদের মধ্যে সংক্রামিত করার মাধ্যমে; আর হয়েছে সত্যি বলতে, দেশাত্ববোধক গানগুলো শুনে! বলতে দ্বিধা নেই, ৭১-এর প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্র বা বইগুলো আমার হিসেবে ৭১-কে ধারণ করতে মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। কিছু কিছু সিনেমা বা বইয়ে যুদ্ধের বিভৎসতা বা ভয়াবহতা উঠে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরের গল্পগুলো, দর্শনগুলো যেন অনুপস্থিত। আর হালে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কোন বই পড়ব, কার কথা বিশ্বাস করব, মুক্তি সংগ্রাম আদৌ কোন সংগঠনের একক কৃতিত্ব নাকি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অথবা জহির রায়হানের ভাষায় 'সময়ের প্রয়োজন'; এগুলো নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম খুবই দ্বিধাগ্রস্ত।
আমি নিজেও কিছু বিষয়ে পরিস্কার না, তার কিছু নমুনা তুলে ধরলামঃ
১. একটা সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা শুধু বইয়ে পড়েছি। সাধারণ মানুষ ৭১-কে উল্লেখ করত 'গন্ডোগলের বছর' হিসেবে! অথচ আমি বেড়ে উঠেছি পুরোপুরি আওয়ামী অধ্যুষিত একটা এলাকায়। তাহলে কি ধরে নেব সাধারণ মানুষ ৭১-এর ঘটনাপ্রবাহকে যুদ্ধ হিসেবে না দেখে গৃহযুদ্ধ হিসেবে দেখেছে? এত এত মানুষ মারা যাওয়ার পরেও সেটা কীভাবে সম্ভব? এই মানুষগুলোকেই আমি আবার ৯২-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার পর পাকিস্তান পাকিস্তান করে গলা ফাটাতেও দেখেছি! (মজার বিষয়, এদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছিলেন) এরা কি তাহলে ২১ বছর পরে এসেও স্বাধীনতার ব্যপারটা বুঝতে পারেননি? যেমন পিরোজপুর, ঝালকাঠির অনেকেই এখনও নিজেদের বরিশালের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন? (স্রেফ একটা উদাহরণ।)
২. অনেকের গল্প শুনেই মনে হয়, ৭১-এ তারা সারাক্ষণ আতংকের মধ্যে বাস করলেও পেটের তাগিদে যার যার পেশা চালিয়ে যেতাই হত। বেচাকেনা হোক না হোক দোকানীরা দোকান খুলে বসত, চাষীরা লাঙ্গল নিয়ে ছুটত ইত্যাদি। তারমানে কী যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি সাধারণ জীবনযাপনও নিয়ম মেনে চলত? শুধু পালিয়ে বেড়ানোর গল্পই কি সবটা নয়? তখনও কি বিয়ে কী খাতনা হত মানুষের? রণাঙ্গনের বাহিরে অর্থনীতির অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছিল? নিত্যদ্রব্যগুলি পাওয়া যেত কি?
৫০-এর মনন্ত্বরের সময়ে মানুষ কী খেত, কী পড়ত তার উপরে অনেকগুলো কালজ্বয়ী বই রয়েছে। ৭১ নিয়ে কোন বইয়ে এগুলো জানার উপায় আছে কী?
৩. সংকটময় সেই সময়টাতে মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক, ভাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা কিংবা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়গুলোও খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমার এক বন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা বাবার কথা জানি, রাজাকার হওয়ার অপরাধে তাঁর আপন চাচাকে গুলি করে মেরেছিলেন। আবার আরেকজন বীর যোদ্ধাকে চিনি, যার বাবা ছিলেন আমাদের এলাকায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এই ভদ্রলোককে আমি অপছন্দ করে এসেছি ৭১-এ তার ভূমিকার জন্য। অথচ বড় হয়ে শুনলাম, ইনার জন্যই নাকি পাকিরা কখনো আমাদের এলাকায় রেইড চালায়নি! এজন্য তাকে ক্ষমা করে দেয়া যায় কিনা আমি এখনও জানিনা। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে, যারা পাকিদের সহযোগীতা করেছিল তাদের সবাই কি ধান্ধাবাজ বা ধর্মীয় উস্কানিতে পড়ে কাজগুলো করেছিল; নাকি ব্যতিক্রম হিসেবে কেউ কেউ জান বাঁচাতেও ও পথে হেঁটেছে?
আমি যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছি, হয়ত তার অনেকগুলোই কোন না কোন বইয়ে দেয়া আছে; কিন্তু আমার পড়া হয়নি। পোস্টের শুরুতে তার কারণও বলা আছে - কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ব জানিনা! তাই ব্লগে যারা শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা আছেন, বা যারা সে সময়ের ঘটনা প্রবাহগুলো বোঝার মত বয়সে ছিলেন; তারা যদি এবার নিজেদের সঞ্চয়গুলো নিয়ে কলম ধরতেন! জানি কারও চোখের আলো কমে যাচ্ছে, কারও সময়ের বড় অভাব, কেউ হয়ত বুঝতেই পারছেন না কোথা থেকে শুরু করবেন; তারপরেও! বড় ঘটনার আড়ালেও ছোট অনেক ঘটনা অনুচ্চারিত রয়ে যায়, দৃষ্টিকোণেও থাকে ভিন্নতা। আপনাদের মত রুচিশীল মানুষদের কাছ থেকে যদি কিছু বিচক্ষণ পর্যালোচনা না পাই, তাহলে কোথা থেকে পাব? এটা ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধ দেখা মানুষের সংখ্যা কমে আসছে, এটাও ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রজন্মকেও যতটা শিহরিত করে ৫০ বা ১০০ বছর পরে তার কিছুই করবেনা! তবুও ভবিষ্যতের কোন সন্ধানী মনের গবেষণায় হয়ত ইন্ধন যোগাবে আপনাদের আজয়াকের এই লেখাগুলো।
কে জানে, হয়ত সামুর ব্লগারদের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব শীঘ্রি একটা সংকলনও বের হবে!