পুরো সোশ্যাল মিডিয়া টা আজকাল চিড়িয়াখানার বানরের খাঁচা হয়ে গেছে। কেউ শো-অফ করছে, কেউ বা আবার হুজুগে মাতাল। একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, নতুন খাবার গোগ্রাসে গেলার মত সেগুলো গিলে যাচ্ছে, তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলো আবার ‘বর্জ্য’ অবস্থায় স্ট্যাটাস হিসাবে উগ্রে দিচ্ছে।
রাজন গেল, সিজার গেল, জাপানি নাগরিক গেল, ৮০০ কোটি ডলার গেল, নিজামির ফাঁসি গেল, তনু গেল, রূপবানের সম্পাদক গেল...(মাঝখানে আরও অনেক কিছুই গিয়েছে) এবার শুরু হয়েছে সংখ্যা লঘু এক শিক্ষকের কানে ধরা পর্ব স্ট্যাটাস প্রসব পর্ব! ...
বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই অনেক শান্তিপূর্ণ একটা দেশ। বিক্ষিপ্ত কিছু হাতাহাতি, মারামারি বা খুনোখুনির ঘটনা ছাড়া এদেশের অধিকাংশ সহিংসতা হয় রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো হয় আবার ক্ষমতার অধিগ্রহণ, আদর্শিক মতবাদ সংক্রান্ত বিভেদ এবং প্রতিহিংসার কারণে। সাম্প্রতিক কালে ব্লগার হত্যাকাণ্ড বা মুক্তচেতনার লেবাসধারিদের হত্যাকাণ্ড যদিও অনেকটাই নতুন সংযোজন।
এদেশের মুসলিম এবং অমুসলিমরা অতীত থেকে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে একসাথে মিলে মিশে বসবাস করে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু অমুসলিমদের পুঁজি না করলে দেশটাকে সাম্প্রদায়িক বা জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা যাবে না, সে কারণেই আঁতেলদের দ্বারা স্বীকৃত কিছু ব্লগার, কিছু মিডিয়া কর্মী, কিছু দালাল সাংবাদিক, শ্রেনি বদ্ধ টক শো সেলিব্রেটি এবং ইমরান এইচ সরকারের মত লোক দেখানো সরকার মদদপুষ্ট activist গুলো বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, নিজেদের প্রচারণা বাড়ানোর জন্য এবং আখেরে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যেই অমুসলিমদের পুঁজি করে সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক এই নাটকগুলো অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে। অমুসলিমরা বাস্তবিক যতটা না অনিরাপদ বোধ করেন, এই ধরণের প্রচার প্রচারণা তাদের অতোধিক শঙ্কিত করে তোলে। ইংরেজদের দ্বি-জাতি তত্ত্বও বোধ করি এতো টা বিদ্বেষ মুসলিম আর অমুসলিমে তৈরি করতে পারে নি আজকের মুক্তমনারা তা যতটা করতে পারছেন। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত শিক্ষক শ্যামল চন্দ্র ভদ্র কে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। শিক্ষকেরা জাতির প্রকৃত অভিভাবক। তাই একজন শিক্ষক কে এমন অপমান করা হলে সেটা হয়ে যায় পুরো জাতির অপমান। ... কথা সত্যি। এই ধরণের ঘটনা সত্যি অনাকাঙ্খিত। এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত। ...
কিন্তু প্লিজ আসুন, একই সাথে আমরা ঘটনাটাকে অন্য ভাবে দেখার চেষ্টা করি। চলুন ধরে নি, শ্যামল চন্দ্র ভদ্রের জায়গায় একই কাজটি করেছেন মৌলানা খবিরুদ্দিন। তিনি ধর্ম ক্লাসে ঠিকমত পড়া বলতে না পারায় ক্লাসের এক ছাত্র কে শাস্তিস্বরূপ মারধোর করেছেন। ... খবরের কাগজে আর সোশ্যাল মিডিয়ার হেড লাইন পাল্টে তখন হয়ে যেত ‘আরবি শিক্ষক কর্তৃক শিশু নির্যাতন’। শ্যামল চন্দ্র ভদ্র একজন অমুসলিম বলেই স্কুলে নিয়মিত ছাত্র প্রহারের মত একটা অমানবিক কাজ তিনি কেন করতেন সেই প্রশ্ন না তুলে একজন শিক্ষককে লাঞ্চিত করার বিষয়টি এখানে মুখ্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে। গৌণ হয়ে গেছে লাঞ্ছিত এই শিক্ষকের ‘তুই নাপাক, তোদের আল্লাহ নাপাক’ জাতীয় প্রলাপ... লিখিত না হলেও আমরা সবাই জানি প্রগতিশীল সমাজ ঠিক যতটা মরমে মরে যাচ্ছেন এই ঘটনায়, ঠিক ততটায় উদাসিন্য দেখাতেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষকের সাথে একই ঘটনা ঘটলে। ...আহা হা, ভাগ্যিস দেশ বিভাগের সময় এ দেশটাকে ভালবাসে কিছু হিন্দু পরিবার এদেশে থেকে গিয়েছিল, তা নইলে দালাল সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী আর জাগরণী মানুষগুলো কিছু করে জৌলুস কোথা থেকে আসতো তাই ভাবি!
হুজুগে জাতি আমরা। আগেও হুজুগে ছিলাম, এখনও আছি। আগামীতেও থাকবো। শ্যামল ভদ্রের অপমানের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে কানে ধরে উঠ বস করতে গিয়ে আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছি ৮০০ কোটি ডলার চুরি যাওয়ার কথা। ... ভুলে গেছি তনুর সুন্দর মুখশ্রীর কথা... আহারে... কতই না বেদনাচ্ছলে তনু হত্যার বিচার চেয়েছিলাম কদিন আগেও... কি সেই আবেগ! অথচ মুস্তাফিজের বোলিং, লা লিগার শিরোপা কে জিতল আর সংখ্যালঘু শিক্ষকের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সেই আমরাই কিনা বেমালুম ভুলে গিয়েছি তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গিয়েছে!
না কোন শাহবাগি, না কোন দালাল সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবী না কোন রাজনৈতিক দল কেউ প্রশ্ন করছে আগের ময়না তদন্তকারী ডাক্তার কে ভুল রিপোর্ট দেয়ায় জন্য কেন আইনের আওতায় এনে ডলা দেয়া হচ্ছে না? কেন বা কাদের চাপে তিনি ভুল রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেই তথ্য কেন এখনও বের হয়ে আসছে না? সার্জেন্ট জাহিদ ও সেপাই জাহিদ কে? তনুর মা সরাসরি তাদের নাম উল্লেখ করা সত্ত্বেও কেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না? কেন তনুর ধর্ষণকারিদের ডিএনএ এর সাথে তাদের টা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে না?
কেউ জানতে চাইছে না কারণ ‘তনু’ পুরনো হয়ে গেছে... ফেসবুক থেকে, আমাদের চিত্ত থেকে তনু হারিয়ে গেছে... এখন হট টপিক অন্য কিছু... তনু হত্যার চেয়ে অন্য টপিকে এখন সেলিব্রেটিদের লাইক আর শেয়ারের কাটতি বেশি।
এই বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ও হচ্ছে ...ক’জন মেয়ের নাম আমরা জানি বলুন তো? তাদের মুখশ্রী কি তনুর মত স্নিগ্ধ ছিল না, তাদের কি পৃথিবীতে ডানা মিলে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন ছিল না? ছিল... তবে তাদের মৃত্যু কেন আমাদের বিচলিত করে নি? কারণ তারা নাট্যকর্মী বা সাংস্কৃতিক কর্মী ছিল না। আজ একজন সাংস্কৃতিক কর্মী বলেই তনু আমাদের প্রোফাইলের ছবি হতে পেরেছে, আমাদের সমবেদনা পেয়েছে, একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হলে এই সমবেদনা তনু পেত না!...
এর কারণ আমাদের সবটাই লোক দেখানো। কারণ আমরা সমষ্টিক প্রতিবাদ জানানোর জানতে হুজুগে প্রতিবাদে বিশ্বাসে। ৫২, ৬৯, ৭১ বা ৯০...কোন আন্দোলনেই ফেসবুক বা ব্লগ ছিলো না। কিন্তু জন সম্পৃক্তটা ছিল সেখানে ১০০ ভাগ। প্রতিটি আন্দোলন যে সফল ছিল তার প্রমাণ আজকের বা বাংলাদেশ। আসলে সবটাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা মাত্র। আজকে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়... কোন সুলতানা কামাল, মুনতাসির মামুন বা ইমরান এইচ সরকারের দাবি বা চাপে নয়! ... এসব লোক দেখানো বীর্যবিহীন আন্দোলনে পাবলিসিটি ছাড়া আর কিচ্ছু হয় না।
নকল করে পরিক্ষা দিয়ে ভাল ফলাফল করা আর ফেসবুকে লোক দেখানো পোস্ট দিয়ে পাবলিসিটি বাড়ানো, নিজেকে সচেতন প্রতিবাদী নাগরিক প্রমাণ করে বাহবা কুড়ানো দুটি আসলে একই বিষয়! ... বরং দ্বিতীয় টি প্রথমটির চেয়ে বেশি খারাপ... কারণ এটি করে আপনি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কে বিভ্রান্ত ও বিপদগামী করছেন।। ...প্রতিবাদ করতে চাইলে, ঘটনার শেষ টা দেখে ছাড়ুন, অন্যথায় নয়...আজ তনু, কাল প্রফেসর রেজাউল, কাল রূপবানের সম্পাদক, পরদিন শ্যামল ভদ্র... এটা প্রতিবাদ নয় ভাই, স্রোতে গা ভাসানো।
কোয়ান্টাম মেথডে 'আমি পারব', 'আমি পারি' এই কথাগুলো বারবার আওরাতে বলা হয়...এই কথাগুলো কেউ বারবার আওড়ালে, সেই ব্যক্তির ভেতরে একটা পজিটিভ উইল পাওয়ার কাজ করে। এই চেতনাধারী মুক্তমনাগুলো আমাদের সাথেও একই কাজ করে যাচ্ছে। যে অমুসলিম প্রতিবেশীর বারো মাসের তেরো পার্বণে আমার আপনার অংশগ্রহন ছিল অবধারিত আর আনন্দের, সেই প্রতিবেশীকেই আজ অধিকার রক্ষার নামে সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু বলে মুসলিম আর অমুসলিমে তৈরি করা হচ্ছে এক বীভৎস বিভেদ... এই বিভেদ আমার আপনার তৈরি করা না, মুক্তমনা কিছু বিশিষ্ট আঁতেল শ্রেনী আর কিছু দালাল সাংবাদিকের তৈরি এসব না করলে যাদের রুটি রোজগার বা ঠাটবাট চলতো না..সংখ্যালঘু, সাম্প্রদায়িকতা এই শব্দগুলোর অধিক চর্চা, ইসলাম ধর্ম কে ইচ্ছাকৃত নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে চেতনাধারীরা এই কাজগুলো করে যাচ্ছে।
ইতিহাস কোন অন্যায়কারীকে আজ অব্দি ছাড় দেয় নি। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়াটাই বোধ করি তার সবচেয়ে উপযুক্ত প্রমাণ। ... তাই আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাজে ধর্ম কে পুঁজি করে জঙ্গি বাদের উত্থানে উস্কানি দেয়ায় মত জঘন্য কাজটির মূল্য অদূর ভবিষ্যতে এই চেতনাধারীকে দালালগুলোকেও একদিন দিতে হবে!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৩৮