গত ৩ এপ্রিল ওপার বাংলার নন্দিত অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় তার নিজের পেজে ক্রিকেট নিয়ে জাতিগত বিদ্বেষ প্রসঙ্গে তার একটি লেখা শেয়ার করেছেন। লেখাটি বেশ আলোচিত হওয়ায় এখানে সকলের পাঠসুবিধার্তে ছবি থেকে লেখাটি তুলে দেওয়া হলো।
বাড়ির পাশেই আরশিনগর
-পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
আবেগ এবং তার বহিঃপ্রকাশটাই আমাকে এবং এই উপমহাদেশের মানুষকে রক্তমাংসের মানুষ করে তোলে, সাহেবসুলভ যান্ত্রিকতার থেকে দূরে রেখে। কিন্তু এই আবেগই আবার আমাদের ভিতরের জান্তব প্রবৃত্তিগুলোকে লাগামছাড়া করে দিতে পারে। ভাল আর খারাপ আবেগের ভারসাম্য রাখাটা আবার সাহেবদের কাছে থেকে শিখতে হয়। সবথেকে খারাপ আবেগ বোধহয় ঘৃণা। বিশেষ করে সেটা যদি জাতিতে জাতিতে হয়। ইদানীং ভারত-বাংলাদেশ খেলা হলে, ফেসবুক খুলে ভাবতে বসি, মানুষ এত ঘৃণা পায় কোথা থেকে? যাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি প্রায় এক, বন্ধু পড়শি বলে যারা অনেক দশক ধরে পরিচিত, তাদের মধ্যে এতটা বিদ্বেষ! অবাক লাগে। ওদিকে ‘রেডিও মুন্না’র অকথ্য ভাষায় ভারতকে সম্বোধন করা, তো এদিকে ‘কাংলাদেশ; বলে ডাকা ওপার-কে। ওদিকে যদি ভারতের মুখে মলমূত্র ত্যাগ করার আহ্বান, তো এদিক থেকে উড়ে যায় পদ্মানদীর পারে গিয়ে বিশেষ কর্ম করার অশ্লীল ইঙ্গিত। এরকম উদাহরণ অগুনতি। ভাবা যায়, এই পদ্মানদী নিয়ে আজও কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের। এই পদ্মা নিয়ে লেখা হেমাঙ্গ-সলিল-আব্বাসউদ্দিনের গান শিখে বড় হয়েছে দু’পারের বাঙালিই।
একটু চোখ-কান খোলা রেখে তলিয়ে দেখলেই কিন্তু কারণগুলো একটু একটু স্পষ্ট হয় তার জন্য তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
প্রথমে আসি ভারতের কথায়। উপমহাদেশের বাকি দেশগুলোর তুলনায় বড় হওয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে তুলনামূলকভাবে অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুলভ একটা ভূমিকা পালন করে ইদানীং। মার্কিন বড়দার সঙ্গে হালের সুসম্পর্কের ফলে সেই ভুমিকাটা আরও জোরদার হচ্ছে ক্রমেই। বড়ভাইসুলভ আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য কখনও বাংলাদেশকে, কখনও নেপালকে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ভারতের সাহায্যের নজির তো আছেই। এইসবের মধ্যে দিয়ে প্রতিবেশীদের অর্থনীতি, সংস্কৃতির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা কিন্তু চলতেই থাকে তলে তলে। সবথেকে বড় সাংস্কৃতিক হাতিয়ার বলিউড আর বেসরকারি টিভি চ্যানেল গুলি। বাংলাদেশের দেশজ টিভি শিল্প যা একসময় বিশেষ সম্বল ছিল, তা আজ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর দৌরাত্ম্যে। মজাটা এখানেই যে বাংলাদেশের অতি বড় ভারতবিদ্বেষীও কিন্তু জেনেও সন্ধে নামলে বুঁদ হয়ে যান এপারের সিরিয়ালে।
সময়ের সঙ্গে ভারতের এই রাষ্ট্রনীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় মনোভাব ঢুকে পড়েছে ভারতের কিছু মানুষের মধ্যেও। অধিকাংশ অবাঙালি ভারতীয় বাংলাদেশের গঠন ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্ব ও ইতিহাসের সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। তাঁদের কাছে বাংলাদেশ মানে পূর্বদিকের একটি ভূখণ্ড। ভারতের জন্যই যারা স্বাধীনতা পেয়েছিল। আজও যারা বেঁচেবর্তে আছে ভারতেরই আনুকূল্যে। বিশেষ করে দ্বিতীয়টি ভেবে তাঁরা তুমুল আমোদ লাভ করে থাকেন। বরঞ্চ চিরবৈরী পাকিস্তানকে কিছুটা হলেও সমকক্ষ মনে করা চলে। তাই ভারতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলা হলে এদের কেউ কেউ পাকিস্তানের হয়ে গলা ফাটাতেও কসুর করেন না। অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি কথাগুলো। কারণ সবকটি আমার নিজের প্রত্যক্ষ করা। বাংলাদেশিরা আবার সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করার কথা বলছে? চোখ রাঙাচ্ছে? ভারতের বিরুদ্ধে যাচ্ছে সেদিনের পুঁচকের সাহস তো কম নয়! ভাবটা এমন।
অবাঙালিদের না হয় ইতিহাসের দায় নেই, ভাষার দায় নেই। বাঙালিদের তো আছে! তাদের মুখে বা কলমেও যখন একই মনোভাব দেখি তখন বাঙালি হিসেবে খুব কষ্ট হয়। ফেসবুক-এ যাঁরা হঠাৎ বাংলাদেশকে হেয় করে জাতীয় বীর হতে চাইছেন তাঁদের মনে করাতে ইচ্ছে করে যে আমাদের শিকড়টা কিন্তু এক। মুর্শিদাবাদ থেকে ময়মনসিংহ, বর্ধমান থেকে বরিশাল, ঢাকা থেকে কলকাতা, শিকড়টা কিন্তু বাংলা ভাষা। যে শিকড়ের হাত ধরে দশকের পর দশক ধরে আদান-প্রদান ঘটে চলে সাহিত্য-সংগীত-সিনেমা ও নাটকে। ওপারের কিছু উগ্র প্রচারে (তার কথা বলব একটু বাদে) তেতে গিয়ে যাঁরা বাংলাদেশকে এখনও পূর্ব পাকিস্তান বলে ডাকছেন, তাঁরা কিন্তু ৩০ লাখেরও বেশি শহিদকে এক লহমায় অপমান করছেন। যাঁরা, আমরা যেটাকে মাতৃভাষা বলি, সেই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এমনকী ওপার থেকে যারা চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় আসেন তাঁদেরকেও আপনাদের বিতণ্ডার মধ্যে জড়াতে ছাড়ছেন না। আমার একটি বক্তব্যের জেরে একজন আমাকে লিখেছেন আমি নাকি জীবিকার খাতিরে দু’পক্ষ ব্যালেন্স করে লিখছি। বাংলাদেশকে ভাল বলছি। খাতির বা তাগিদ যা-ই বলুন সেটা আমার না হয় জীবিকা। তাঁকে জিগ্যেস করি আপনি কীসের তাগিদে এত ঘৃণা পুষছেন ভাই? আসলে শুধু ঘেন্নাটা দেখেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসাটা দেখেননি কখনও। বাংলাদেশের সেই প্রগতিশীল মানুষরা যাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার, একটা মুক্তমনা সমাজ বজায় রাখার, তাঁদের কথাও জানার আপনাদের সুযোগ হয়নি। আর কীসের তাগিদে বলছিলেন না? তাগিদটা শিক্ষার, শিকড়ের, ভাষার।
এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে, যেকোনও ভারতীয় বন্ধুকে ইন্টারনেট যুদ্ধ বন্ধ করতে বললেই তিনি বলেন, “ওপার থেকে এরকম ভাষায় আক্রমণ চললে আমরাও তো আর ফুল ছুড়ব না? ওরাই তো প্রতিবার শুরু করে! কে শুরু করে– এই উত্তেজনার উত্তর খুঁজতে যাওয়া, ডিম আগে না মুরগি আগের সমাধান খুঁজতে যাওয়ার মতো।” তবে একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ প্রবল। একটু আগে ভারতের যে দাদাগিরির কথা বললাম তা বিদ্বেষকে তৈরি বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দেশকে গালাগাল দেওয়ার মধ্যে একটা স্বাভাবিক আনন্দও থাকে। কিন্তু এর মূল আরও গভীরে বলেই আমার ধারণা।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে মধ্য সাত থেকে মধ্য নয় অবধি দু’দশকের সামরিক শাসন অপূরণীয় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের সমাজের বলে আমার মনে হয়। নির্বাচন না হওয়া, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিকাঠামো না চলা। এগুলো তো আছেই, তা ছাড়াও এই সামরিক শাসন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মুক্ত আবহাওয়াকে অনেকটাই নষ্ট করেছে। সামরিক শাসনের নিয়মই হল উগ্র জাতীয়তাবাদ জিইয়ে রাখা মানুষের মধ্যে। আর তা করতে গেলে সবসময়ের জন্য একটা শত্রু দরকার হয় রাষ্ট্রের। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের থেকে ভাল শত্রু আর কে? আর শত্রু হওয়ার মতো প্রতিবেশী বলতে ভারত। নিষিদ্ধ ইসলামিক উগবাদী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াটা আরও বেশি সাহায্য করেছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতকে শত্রু হিসেবে কল্পনা করাতে। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম ও অন্যান্য জিগির তুলে ভারত- বিদ্বেষ বৃহৎভাব ছড়ানোর কাজে কিন্তু তাঁরা আজও সক্রিয়।
যাঁরা এইরকম নানান প্রচারে মেতে খারাপ ভাষায় ভারতকে আক্রমণ করছেন, যাঁদের উগ্র পাকিস্তান সমর্থন দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় পাকিস্তানের কাছে হারাটা বোধহয় আপনাদের ভারতের কাছে হারার থেকে কম শোকের বা লজ্জার। তাঁদেরকে আমার একটাই কথা বলার, আপনারা যাকে খুশি সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু এই উগ্র কুরুচিকর আচরণের ফলে কিন্তু আপনাদের দেশেরই স্বাধীনতার শহিদরা অপমানিত হচ্ছেন। আর তার সঙ্গে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে হাজার হাজার ভারতীয় সেনার আত্মত্যাগ, যাঁরা আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন ’৭১ সালে।
সর্বোপরি, এই বাংলায় কিন্তু এখনও এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের ফেসবুক-এ দেখা যায় বা যায় না, যাঁরা আজও ওপারটাকেই নিজের আসল ভূমি বলে মনে করেন। বাংলাদেশ খেলায় জিতলে যাঁরা অভাবনীয় আনন্দ পান। এপারে আমরা বাংলা ভুলে যাচ্ছি বলে অভিমান করেন আর আপনাদের বাঙালিয়ানা নিয়ে গর্ব করেন। দেশভাগের প্রসঙ্গ উঠলে যাঁদের আজও গলা বুজে আসে কষ্টে। এই মানুষরা কিন্তু সত্যি খুব কষ্ট পান। আহত হন। আর যাঁরা এদিককার উগ্র জাতীয়তাবাদের মতো কিছু মানুষকে দেখিয়ে গোটা বাংলাদেশের সম্বন্ধে ভারতীয় বাঙালিদের ব্রেনওয়াশ করার।
বাংলাদেশিদের তরফে আরেকটা অভিযোগ প্রায়শই চোখে পড়ে। তা হল আমরা এপারের বাঙালিরা নাকি বাঙালি কম, ভারতীয় বেশি হয়ে গিয়েছি। ভারতীয় ক্রিকেট টিম-এ তো একটিও বাঙালি নেই এই মুহূর্তে। তা হলে তাদের নিয়ে এত উদ্বেল হওয়ার কী আছে?
এর উত্তরে বলি, স্বীকার করে নিচ্ছি আপনারা অনেক বেশি বাঙালি। আপনাদের ভাষার গর্বে আমরাও গৌরবান্বিত হই।
আমরাও কিন্তু আমাদের মতো করে লড়াই করি ভারতীয়ত্বর পাশাপাশি নিজেদের বাঙালিত্ব বজায় রাখার। বিশেষ করে আমরা, যাঁরা বিশালাকায় বলিউডের সামনে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বাংলা ছবির জন্যে হল-এ টানার চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু কী জানেন, ভারতীয়ত্ব ও বাঙালিয়ানা, এই দুইয়ের সহাবস্থানের ফলে আসলে দুটো সত্তাই লাভবান হয়। আমরা যতটা বাঙালি, ততটাই ভারতীয়। এই দ্বৈত সত্তাটা আমি হয়তো এই স্বল্প পরিসরে ঠিক বোঝাতে পারবো না আপনাদের। এই বহুত্ববাদের জন্যেই কিন্তু প্রায় ৭০ বছর ধরে এর ভাষাগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন টিকে আছে। কোনও ক্ষমতা যখন ভারতের এই ‘বিবিধ’ চরিত্র বা ‘ডাইভারসিটি’ নষ্ট করতে চেয়েছে, যদি সেটা কেন্দ্রীয় সরকারও হয় আমরা তার বিরোধিতা করেছি, করি, এবং করব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রায় এক সপ্তাহ পরে যতদূর মনে হয় এই লেখা প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি এই পড়শি বাঙালির তরফ থেকে রইলো অনেক ভালবাসা। যদিও যে ভালবাসা আপনাদের কাছে থেকে পাই, তার তুলনায় হয়তো কিছুই দিতে পারি না। ধর্মকে গৌণ করে, ভাষা এবং স্বাধিকারের জন্যে আপনাদের যে শহিদরা লড়াই করেছেন, যার বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা, সেই শহিদদের আমার শ্রদ্ধা, প্রণাম।
পরিশেষে একটা কথা। খেলা দেখতে আমরা সবাই ভালবাসি। নিজের দেশ জিতলে আনন্দ হয় সব্বার, হারলে চোখের জলো ফেলি। কিন্তু খেলাটা খেলাই। সেটা মাঠে হোক। আমাদের জাতীয়তাবোধ যেন শুধু খেলার সময়ে উথলে উঠে উগ্র রূপ ধারণ না করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাস রেখে সে যেন তার নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে চলে প্রতিবেশীকে সম্মান করে, ঘেন্না করে নয়। আমরা তো এমন পড়শি যাঁদের দেখে সারা বিশ্বের শেখা উচিত। সেই গর্ব আমরা খর্ব হতে দেব কেন? বাড়ির পাশেই থাকুক আরশিনগর যেখানে পড়শিদের হোক নিত্য দেখাশোনা, কোলাকুলি, বিজয়া কিংবা ঈদের।
(বিঃদ্রঃ লেখাটি গত ৩ এপ্রিল পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় নিজের পেজে ছবিকারে পরমব্রত শেয়ার করেছেন। সেই ছবি থেকে আমি হুবহু তুলেছি। তাই এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য তার পোস্টে জানাতে এই লিংকে বাড়ির পাশেই আরশিনগর যান।)