‘অসহ্য ব্যথা নিয়ে লিখছি। আঙ্গুলটা আর কতক্ষণ বশে রাখতে পারব তা জানি না। প্রতিটি গিঁটে ব্যথা। নিজের কষ্টের কথা লেখার জন্য এই লেখা না, কয়েকটা কথা জানানোর জন্য। তোমাকে খুব মনে পড়ছে। তোমার লম্বাটে মুখটা দেখতে ভারী ইচ্ছা করছে। অনেক কিছুই ইচ্ছা করছে। শেষ ইচ্ছা তো, তাই ঠিক করতে পারছি না। প্রথম দেখা হবার দিনটার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার কথাও। কতকিছু মনে পড়ছে। দিনের শেষ প্রহরে কি এভাবেই সবকিছু ফিরে আসে, যেভাবে দিন শেষে নীড়ে ফেরে পাখি। তোমার হাতটা যদি একটু ছুঁয়ে দিতে পারতাম, খুব ভালো লাগতো। আমি নাকি তোমার প্রদীপের আলো ছিলাম। সেই প্রদীপ নিভিয়ে আমি পালিয়ে এসেছি। দেখেছ, আঙ্গুল কথা শুনতে চাচ্ছে না। কাঠপেন্সিলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাচ্ছে। অনেক তো কথা শুনলো। আচ্ছা, আমি যখন থাকব না, তখন কি এভাবেই গোধূলি আভা ছড়াবে? জানি তোমার জন্য সবই একই। আচ্ছা আমি এভাবে সময় নষ্ট করছি কেন? জানি আমার প্রতি তোমার অনেক রাগ, অনেক অনেক অভিমান। জানি না এভাবে কেন ফেলে চলে এসেছিলাম। এটাও জানি না কেন ফিরে যাইনি। কিন্তু এখানে অনেক কিছু পেয়েছি যা হয়তো না এলে পেতাম না। এই আঙ্গুল যে কথা শুনতে চাচ্ছে না, সে যে কতগুলো কাজ করেছে তা তুমি ভাবতেই পারবা না। এই চিঠি কি তুমি পাবা? তুমি কি জানতে পারবা তোমার কাছে থেকে আমি এখন কত দূরে? আমরা সবাই কত অল্প সময়ের জন্য আসি। আঙ্গুলগুলো কথা শুনছে না। পেন্সিলটাকে গুণে গুণে চারবার ফেলে দিয়েছে। আর পারছি না। চোখদুটোও আঙ্গুলগুলোর সাথে তাল মিলিয়েছে। পা দুটোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা করছে, তোমাকে ফেলে আসার জন্য আমাকে কি ক্ষমা করে দেবে?
দেহের সবকিছু বিদ্রোহ করছে। আর পারছি না। শেষে এসে দেখছি সম্বোধনটাও দেওয়া হলো না।’
পত্রবাহকের চিঠিটা পড়ে শোনানো শেষ হলে লাঠিতে ভর করে উঠে মাটিতে টুক টুক শব্দ করে চলে গেলেন মধ্যবয়স্ক অন্ধ মহিলাটি। মনে হয় প্রাপক এখনো প্রেরককে ক্ষমা করতে পারেননি।
পত্রবাহক নিজের রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ঠিক পিছনে হেলে পড়া সূর্য। কিছুক্ষণ পড়েই আসবে আভা ছড়ানো গোধূলি। পত্রবাহক সময় হিসেবে করে নেয়, ভোরের পাখি ডেকে ওঠার আগেই ফিরতে হবে গন্তব্যে, মাকে যে হানাদারদের কাছে থেকে মুক্ত করতে হবে।