কতদিন পর চোখে আলো পড়লো কে জানে। চোখ পিট পিট করছে, খোলা রাখাই মুশকিল। তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে বারকয়েক ঘষে নিলেন। মুহূর্তেই ৪০ বছর আগের স্মৃতি যেন ফিরে এল। সেদিন আজকের দিনের মতো এমনই এক অনুভূতি অনুভব করেছিলেন।
নিজেই নিজেকে দেখে চিনতে পারলেন না। হাড্ডিসার দেহে এক্সরে ছাড়াই হাড় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হাড়ের সাথে বাহিরের তফাৎ শুধু ভাঁজ পড়া চামড়া । ফুলে ওঠা শিরা-উপশিরাগুলো আসলে মাংসের অভাবকেই জানান দিচ্ছে। তিনি আরো ছয়জনের সাথে এতদিন একটা অন্ধকার রুমে বন্দি ছিলেন।
কেউ তার চুলের ঝুটি টেনে ধরে বলল, ২৫ হাজার টেকা দিয়া কিনছি। যদি পালাস তাহলে জীবন থাকবে না। যেখানে বসিয়ে দেব সেখানে সারাদিন বসে থাকবি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কিচ্ছু বলবি না। বললে বুঝবি তোর দিন শেষ । যত ভালো ভিক্ষা করতে পারবি ততোই ভালো থাকতে পারবি। বুঝছিস?
তিনি কি বুঝলেন কে জানে তবে উত্তরে বললেন, ভাত নাই, মানচিত্র খা।
কি ভেবে যেন,তার চুলের ঝুটি ছেড়ে দিয়ে আজমল মিয়া এক খাবলা পিক ফেলল। মনে মনে বলল,যত বেশি বুড়া আর অসুস্থ ততো বেশি কামাই। তারপর ঘুরল আরেকজনের দিকে। সেইজনের কঙ্কালসার দেহ দেখে দেড় বছরের পরিশ্রমটাকে সে শিস বাজিয়ে উদযাপন করতে লাগলো, “হাওয়া মে উরতা যায়ে...”
****************************
-স্যার, সাইনটা যদি করে দিতেন...
মন্ত্রী সাহেব বললেন, কিসের সাইন?
-টেন্ডারের স্যার। এই বিদেশী কোম্পানীই আমাদের সবচেয়ে বেশি ইয়ে দেবে।
-কিন্তু এরা তো কাজ ভালো পারে না। দেশের উন্নতি করবে আর কি উল্টো ক্ষতি করে যাবে।
-স্যার, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আমরা টাকা পেলেই হল। দেশ দেশ করে কি হবে। দেশ যতো গরীব হবে আমরা ততো বেশি লোন পাব, যতো বেশি লোন পাব, ততো বেশি ইয়ে... হি হি হি।
-তোমরা আর ঠিক হইলা না। দাও সাইন করে দিচ্ছি। আমারটায় যেন কমতি না পরে।
-তা আর বলতে... হি হি হি।
লোকটা চলে যাবার পর কাচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ভাবেন ঠিক ১৫ বছর আগের কথা। বস্তিতে অনাহারে, অর্ধাহারে ৫ জনের সংসার কোনমতে চলছিল। এর মাঝে আবার শ্রমিক নেতা হবার জন্য লড়তে হবে। অর্ধেকের মতো টাকা জোগাড় হয়েছে, বাকি টাকা কিছুতেই জোগাড় করা যাচ্ছে না।
এমন নড়বড়ে পরিস্থিতে এক লোক টাকা যোগাড়ের একটা পন্থা জানাল। সেই লোকটা চলে যাবার পর তিনি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তার মায়ের দিকে তাকালেন। কারণ, লোকটা তাকে মিলিটারীর হাতে তার মা পড়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে... বীরাঙ্গনা,হাহ।
এতবছর পরে মন্ত্রী তার মায়ের একটা কথা মনে করে নিজের অজান্তেই হেসে উঠলেন, “ভাত নাই, মানচিত্র খা।” কারণ, প্রকৃতপক্ষে, এখন তিনি মানচিত্রই খাচ্ছেন।
অদূরে প্রচণ্ড তাপদাহকে উপেক্ষা করে কয়েকজন শিক্ষার্থী একটা শপিং মলের দরজায় বাক্স হাতে নিয়ে বলছে, একজন মাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। আপনার সামান্য সাহায্যে বেঁচে যাবে একজন মা।
মন্ত্রী সাহেব বিরক্ত। খবর পেয়েছেন তার ছেলে এই গরমে নাকি কোথাকার কোন মাকে বাঁচাতে টাকা যোগাড়ে নেমে পড়েছে।
এইসময় মন্ত্রীর মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায়...”
খুব কাছেই এক ওভারব্রিজে এক অশীতিপর কঙ্কালসার বৃদ্ধা অপেক্ষায় আছে কখন তার সামনের স্টিলের বাটিতে পয়সা পড়ার টুং করে শব্দ হয়। কারণ সেই শব্দ তার হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে, গত ১৫ বছরে।