ডাক্তার বলেছেন, আমার মেয়ের ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে। কথাটা প্রথম প্রথম কেমন যেন মিথ্যে মিথ্যে লাগত। মন বলতো, ডাক্তাররা টাকা হাতিয়ে নেবার জন্য তো নানা অসুখের গালগল্প করে। কিন্তু পরে যখন আমার ডাক্তার বন্ধুটিও কথাটা স্বীকার করে নিল,তখন থেকে একটু একটু বিশ্বাস হতে লাগলো আর একটু একটু করে ভয় লাগতে লাগলো। হারানোর ভয়।
ডাক্তার বলেছে,আমার মেয়েটা আর খুব বেশিদিন বাঁচবে না। উপরে যিনি রয়েছেন তিনি যদি রহম করেন তবে বড়জোর আর পাঁচ সপ্তাহ। পাঁচ সপ্তাহ! মাত্র ৩৫ দিন! দেখতে দেখতেই না কেটে যাবে।
দিন দিন মেয়েটা শুকিয়ে যেতে লাগলো। কিচ্ছু খেতে চায় না। কেবল বিছানায় শুয়ে থাকে। ওর মা কত চেষ্টা করে ওকে খাওয়ানোর। কোলে নেয়,বুকে নেয়, গল্প শোনায়, রাজা-রানীর গল্প।
জানো, এক দেশে এক রাজা আর এক রানী ছিল। তাদের ধন-সম্পদের শেষ ছিল না। সুখেরও অন্ত ছিল না। দুঃখ ছিল একটাই, তাদের কোন সন্তান ছিল না। তাই তাদের মনে কোন শান্তিও ছিল না। একদিন হল কি জানো? একজন দরবেশ বাবা এলেন... তারপর হল কি জানো?...
হ্যাঁ! আমি জানি, দরবেশের দোয়ায় বা কোন কিছু দ্বারা রাজ্যের সব সুখ নিয়ে রানীর কোল আলো করে কোন রাজকন্যা বা রাজপুত্র এল। কিন্তু আমার এই সংকটে কেন কোন দরবেশ বাবা আসে না ? কেন দেয় না কিছু? কিছু একটা। যা দিয়ে আমার কলিজাটা বাঁচবে, অনন্তকাল বাঁচবে। আচ্ছা আমার মেয়ে কি আমার কলিজা? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু! আত্মা...
মেয়েটা সবে নয়তে পা দিয়েছে। দুনিয়াটার কিইবা দেখেছে! সে কেন এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?কিছু না দেখেই! সে তো দেখেনি তাজমহল, দেখেনি আইফেল টাওয়ার, দেখেনি হাজার বছরের পিরামিড, দেখেনি পাহাড়, দেখেনি নীল সফেন সমুদ্র। কিছু দেখেনি...
ওর মাকে কিছু জানাইনি। তাই সে জানে না কিছুই। কোন কিছুই...
ওর মা ওকে বলে, মনি কিছু খাবে না? না খেলে তো শরীরে শক্তি হবে না। মাথায় বুদ্ধি হবে না। পরীক্ষায় কি লিখবে?সামনে না তোমার পরীক্ষা...
পরীক্ষা? হুম। পরীক্ষাই তো। জীবনের শেষ পরীক্ষা। উত্তীর্ণ না হলেও কোন অসুবিধা নেই। কেউ বকবে না। কেউ না...
মেয়েটাকে কোলে নিয়ে চিড়িয়াখানা যাই। তার মা সাথে নেয় সুজি মেশানো তরল দুধ। ওর খাদ্য যে এখন একমাত্র ওটাই।তাকে বাঁদরের বাঁদরামি দেখাই,সিংহের গর্জন শোনাই,পেখম মেলানো ময়ূর দেখাই। সে দেখে না, শুনে না,ক্লান্ত পথিকের মতো আমার কাঁধে মাথা রেখে ঝাপসা দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি বেশিদূর এগুতে পারে না। সে যেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক।
তার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে দেখতে আসে। তাকে ঘিরে বসে।সে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠোঁটেই সব জড়িয়ে যায়। কেবল ঠোঁট নাড়া বোঝা যায়। তার বন্ধুরা তাকে সান্তনা দেয়। একজন বলে উঠে, জানিস আমারও এমন হয়েছিল। দেখছিস আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি।তুইও হবি। আবার আমাদের সাথে ক্লাস করতে পারবি।
এসব শুনে মেয়েটার নিস্প্রভ চোখে আলোর ঝলকানি দেখি।
মেয়েটা তার হাতে বানানো পুতুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। আর আমি দেখি ওইসব নির্জীব পুতুলগুলির সাথে তার অমিল রয়েছে কিনা। আহারে! মেয়েটা আর পুতুলগুলোর বিয়ে দিতে পারবে না। কখনো না...
আমি আকাশ দেখি। তারা জ্বলা আকাশ দেখি। একদিন দেখি,দুইদিন দেখি।প্রতিদিন দেখি। বারবার দেখি। ভালভাবে দেখি। খুঁজি আমার মেয়েটা কোন তারাটি হবে?কোনদিকে? আমার মেয়েটা আবার একা থাকতে খুব ভয় পায়। ও একা থাকতে পারবে তো? ভয় করবে না?
আজকাল ধূমপানও বিস্বাদ লাগে। অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে।মেয়েটার যে নিকটিনের গন্ধ সহ্য হয় না। ভাবছি ছেড়ে দেব।একসময় সিগারেটের জন্য ভালবাসার মানুষটিকেও ছাড়তে দ্বিধা করতাম না।আর এখন...
মেয়েটা জানালা দিয়ে উঠানটা দেখে। তার হাতে লাগানো কিছু করবীর গাছ আছে। রক্তরঙ্গা...
সময় ফুরিয়ে এল...
মেয়েটা মারা যাবার আগে খুব কষ্ট পেয়েছে। মাথার যন্ত্রনায় চিৎকার চেঁচামেচি। ওফ! ওর মা ওকে বুকে চেপে ধরেছিল। ডাক্তার আমার মেয়েকে ঘুমের ওষুধ দেবে না ব্যথার ওষুধ দেবে টা ভেবে কূল পায় নি। মেয়েটা ওর মায়ের বুকেই খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফটাতে ছটফটাতে মারা গিয়েছে। ওর মা কেবল আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল।
তারপর। ওর মা সারাদিন তার ছবি,তার পুতুল,তার কাপড়,তার বইপত্র,তার রংপেন্সিল নেড়েচেড়ে দেখে, বুকে নিয়ে থাকে। ধরে থাকে অনেকক্ষণ। যতক্ষণ না তার চোখের জল শেষ হয়ে যায়।
আমি আর কি করব? ওর মায়ের একবার এক অপারেশনে ওকে ওর মাতৃত্ব হারাতে হয়েছে। তাই আর কেউ আসবে না, আধো আধো কথা বলবে না, ছোট ছোট পায়ে সারা বাড়ি ছুটে বেরাবে না। আর কেউ আমার মেয়ের জায়গাটা দখল করতে পারবে না। কক্ষনো না। কেবলই শুন্যতা ভেসে বেড়াবে।
আমি ব্যালকনিতে এসে দাড়াই। আকাশে নতুন তারা খুঁজি। ওই যে ধ্রুবতারা, সপ্তর্ষি, লুব্ধক, কালপুরুষ... নতুন তারা কোথায়?
আমার মেয়েটার একা একা থাকতে ভয় করছে না তো?
পড়তে পারেন অণুগল্প : বোবা প্রতিশোধ