যেখানে একজন মেয়ের অনার্স ২য় বর্ষে বিয়ের বয়স হয়ে যায়,৩য় বর্ষে আবশ্যকীয় এবং অনার্সের রেজাল্টের সাথে সাথেই অত্যাবশকীয় হয়ে যায় ।সেখানে একজন ছেলের ক্ষেত্রে মাস্টার্স পাসের পর যদি ধরি সাথে সাথে চাকুরী হয় তারপরও আরও দুই বছর লাগবে বিয়ের বয়স হতে,আবশ্যকীয় আর অত্যাবশকীয় তো আরও দুরের কথা । এটা বোঝার পরও আমার ক্লাসমেটরা কি করে এবং কোন যুক্তিতে একে-অপরের সাথে প্রেম-ভালবাসা করে কে জানে ?
অপর্ণার কথাই যদি ধরি,একসাথে পড়ছি,চলছি,ফিরছি, আড্ডা দিচ্ছি,খাচ্ছি;বুদ্ধিমতী মেয়েটা বলা নেই,কওয়া নেই,হুট করে একদিন আমাকে বলে বসল,''তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে । তোমাকে আমি ভালবাসি ।''হাতে একরাশ টকটকে রক্তলাল ভেজা গোলাপ । উজ্জল শ্যামলা কপালে ছোট্ট একটা কাল টিপ,চোখে কাজল । পড়নে আকাশ রঙা শাড়ি।
এটা কোন কথা হলো । ছ্যাঁ ।
তাকে আমি বাস্তবতা বোঝাই,বলি আমি অন্যসব ছেলের মতো স্বপ্নবিলাসী আর কান্ডঙ্গানহীন নই,আমি বাস্তববাদী । বুদ্ধিমতী মেয়েটা আমার কথা শুনে কাঁদে ।
কাজলের সাথে অশ্রু । কালো একটা অশ্রুধারা নিঃশব্দে বেয়ে আসে তার গাল গড়িয়ে । যেন আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে । কালো টিপটা আর কপালে নেই ।
এরপর ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর আমার বন্ধুরাও আমাকে ধরলো,''দোস্ত অপর্ণাকে ফিরিয়ে দিস না ।''আমি বলি,দূর হো যতোসব অবাস্তববাদী । বন্ধুরা ফিরে গেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে । দীর্ঘশ্বাসটা তাদের জন্য না আমার জন্য তা অজানাই রয়ে গেল ।
দিন যায়,দিন আসে । হঠাৎ একদিন শুনি অপর্ণা হাসপাতালে ।
কেন? ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল ।
কেন? আমার জন্য ।
কেন?আমাকে ভালবাসে,আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না ।
ছ্যাঁ ।
যে নিজেকেই ভালবাসতে পারে না,সে আবার আমাকে কি ভালবাসবে! দুই দিনের ভালবাসার কাছে মা-বাবা,ভাই-বোনদের সারাজীবনের ভালবাসা নিরর্থক !
কিন্তু তার অবুঝ ভালবাসার কাছে কি আমার মতো বাস্তববাদী পরাজিত হবে?
************************************
অপর্ণা হাসপাতালে । তাই অপর্ণাকে দেখতে যাওয়াকে আমি একটা দায়িত্ব মনে করলাম । হাজার অবুঝ হোক, বন্ধু তো । হাসপাতালে গেলাম,তাকে আত্মহত্যা আর এহেন ভালবাসার কুফল বোঝালাম । শেষ-মেশ কি হলো? সবাই আমাকে উপেক্ষা করতে লাগল । অপর্ণাও । যাহ,বাবা!এই জন্যেই বলে যেঁচে উপকার করতে যেও না ।
ছ্যাঁ ।
অদ্ভূদ ! আশ্চর্য ! সেই দিন থেকে কেউ আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না । আমাকে দেখলেই এড়িয়ে যায় । মুখো-মুখি হলে এমনভাবে নাক-মুখ কুঁচকে তাঁকায় যেন আমি কোন দুর্গন্ধযুক্ত কদাকার প্রাণী । আরে এসব হচ্ছেটা কি? কেউ কি আমায় বলবে আমার অপরাধটা কি?
দিন যায়,মাস যায় ।
প্রথম প্রথম বিষয়টা পাত্তা দেই নাই । কারন আমার
বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, বন্ধুদের মাঝে এমন মনোমানিল্য আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায় । কিন্তু এতোদিন পরও যখন ঠিক হচ্ছে না, তখন বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন লাগছে ।
হঠাৎ এক শূন্যতা,এক বিষন্নতা আমায় ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলল। কেমন কেমন যেন লাগে বুকের মাঝে । চারদিকে তাকালেই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে । কি যেন নেই! একেই কি বলে ভালবাসা?
এতদিন বন্ধুরা আমার শত তাচ্ছিল্য সত্ত্বেও আমাকে ভালবাসায় ভরিয়ে
রেখেছিল, তাই আমি তা অনুভব করতে পারি নাই । এখন সবাই দূরে চলে গিয়েছে,নিয়ে গিয়েছে ভালবাসা,রেখে গিয়েছে ঘৃণা শুধুই ঘৃণা । বুঝলাম আমার এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই । ক্ষমা নেই অপর্ণার নিষ্পাপ ভালবাসা উপেক্ষা করার জন্য । ক্ষমা নেই আমার কিছুতেই । এখন বুঝি বন্ধুদের দীর্ঘশ্বাসটা আমার জন্যে ছিল ।
মাস যায়,মাস আসে ।
পড়াশুনা শেষ,চাকুরী করছি । অপর্ণাকে আর বলা হয়নি যে,তাকে আমি ভালবাসে ফেলেছি। আমি তাকে ভালবাসি।কোন মুখে বলব, সেইবা কেন আমায় আর ভালবাসবে?
শুনেছি অপর্ণার একটা ছেলে হয়েছে । আমার আর বিয়ে করা হলো না । হলো না ঠিক না নয়, আসলে পারলাম না । অপর্ণাকে এত ভালবেসে ফেলেছি যে তের জায়গাতে আর কাউকে বসাতে পারব না । অথচ যে অপর্ণা আমার জন্য আত্মহত্যা(!) পর্যন্ত করতে চেয়েছিল, সেই অপর্নাই আজ অন্যের ঘরে এক সন্তানের গর্বিত জননী হয়ে সুখে আছে ।
হায়রে ভালবাসা, অসময়ে এলি,যাতনা দিয়ে গেলি ।
এমনি কি আর বলে মেয়েরা ছলনাময়ী । অপর্ণাও তাই । মিছে সব ভালবাসা । সব মিছে। সব মিছে।
****************
বছর যায়, বছর আসে ।
এবারের পোস্টিং চট্টগ্রাম । রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছি । ট্রেন থামল । নামল কে? অপর্ণা,সাথে তার ছেলে । সময় যেন থমকে গেল । থমকে গেল চারপাশ । অপর্ণা চমকে উঠেও সামলে নিল । কথা হলো কিছুক্ষন। প্রায় সাত বছর পর কিছুক্ষন কথা!
ট্রেন ছাড়ার সময় হলো । অপর্ণা বলল, বুকপকেটে ওভাবে কলম রাখবে না ,শার্ট ইস্ত্রি করে পড়বা, চুল চিরুনী করবা ঠিকমতো,শেভ করবা যত্ন করে যেন কেটে না যায় । আর হ্যাঁ, বিয়েটা করে নিও । বাস্তবতা যতই নির্মম হোক না কেন,তা মেনে নিয়ে তো আমাদের চলতে হবে, তাই না । আচ্ছা যাই ।
এবার আমার চমকাবার পালা । আমার চিরকালের বদঅভ্যাসগুলোকে সে সযতনেই মনে রেখেছে । কেন মনে রেখেছে?!
ট্রেন দরজায় দাঁড়ালাম । অপর্ণা তার ছেলেকে ডেকে কোলে নিল ,''এই রুদ্র,আসো, আম্মুর কোলে আসো ।''
অদ্ভুত, আমার নাম রুদ্রাক্ষ,কিন্ত অপর্ণা ডাকতো রুদ্র বলে । তাহলে কি সে আজ ও আমায় ভুলে নি ?
ট্রেন রওনা হলো । ছেড়ে যাচ্ছে প্লাটফর্ম । অপর্ণার প্রতি যত ছিল অভিমান, তা যেন প্লাটফর্মের সাথে সাথে ছেড়ে যাচ্ছি । নিয়ে যাচ্ছি ভালবাসা । শুধুই ভালবাসা ।
আজ বুঝলাম,ভালবাসা কোন বাস্তবতা মানে না । নেই এর কোন সময়,নেই এর পেছনে কোন যুক্তি ।
ভালবাসার তুলনা কেবলই ভালবাসা ।
''যদি এই হৃদয় ,
করতে চাই বিনিময়,
মিথ্যে মূল্য প্রনয়-সময়,
ভালবাসার চেয়ে বড় কিছু নয় ।''